—ফাইল চিত্র।
থাপ্পড়টা খাওয়ার পর থেকেই ক্রমশ টের পেতে থাকে অমৃতা যে, তার আর তার স্বামী বিক্রম-এর বর্গ দু’টি আলাদা। স্বামী যতই ভালবাসুক না কেন, বড় জোর শিক্ষিত গৃহবধূর বেশি কিছু তাকে ভাবতেই পারে না। বিক্রম কর্পোরেট দুনিয়ায় উদীয়মান, কর্পোরেট-কর্তা হওয়ার দিকে ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে। সে তার হাবভাব চালচলনের জেরেই প্রতি মুহূর্তে টের পাওয়াতে থাকে অমৃতাকে— তাদের দু’জনার যোগ্যতা কখনওই তুলনীয় নয়, হতে পারে না।
যতই লেখাপড়া শিখে থাকুক, আসলে তো অমৃতা গৃহবধূ, তার কাজই গেরস্থালি সামলানো। রান্না ভাল না জানলেও চলবে, কিন্তু পরিচারিকার কাজের তদারকি করা, শাশুড়ির স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রেখে তাঁর রক্তে শর্করা বাড়ছে কি না মেপে দেখা, কাজে এতটুকু ঢিলে দিলে চলবে না। প্রতি দিন বরকে ঘুম থেকে তুলে তৈরি করে অফিসে পাঠানো, গাড়িতে ওঠার মুহূর্ত পর্যন্ত অফিসের টিফিন থেকে ফাইল হাতের সামনে জুগিয়ে দেওয়া, অফিস থেকে ফিরে ফের সে কাজে বসলে প্রিন্টারে কাগজ ভরে দেওয়া, প্রয়োজনীয় ফাইল নিয়ে আসা, কফি বানানো, রাতের সহবাসে তার নিত্যসঙ্গী হওয়া।
এই রোজকার রুটিনের মধ্যেই এক দিন অমৃতা জিজ্ঞেস করে ফেলেছিল বিক্রমকে, গাড়ি চালানোটা সে সড়গড় করে নেবে কি না। বিক্রম তখন বেশ তাড়াহুড়োয়, অফিসে যাওয়ার জন্য। রোজ নিজেই গাড়ি চালিয়ে অফিস যায় তো, গাড়ির দরজাটা খুলে বসতে বসতে অমৃতাকে বলে যায়: আরে, পরোটাই এখনও পর্যন্ত ভাল করে বানাতে শিখলে না!
এ-সমস্তই কিন্তু নিজের বিবাহিত জীবনে যুক্তিগ্রাহ্য করে নিয়েছিল, বা মেনে নিয়েছিল অমৃতা, কারণ সে বিক্রমকে ভালবাসত, কারণ সে বিক্রমকে ভালবেসে দুনিয়ার সেরা গৃহবধূ হতে চেয়েছিল। থাপ্পড়টা খাওয়ার পর সেই ভালবাসাই নড়বড়ে হয়ে যায়। তার মনে পড়ে যায় নিজের কলেজ-জীবনের কথা, যখন সে সম্মানের সঙ্গে ভবিষ্যৎ-জীবনটা বাঁচার স্বপ্ন দেখত, নৃত্যশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখত।
নারীদিবসের সপ্তাহখানেক আগে আসল থাপ্পড়টা মারলেন অনুভব সিংহ, বলিউডের চিরকেলে প্রথামাফিক একঘেয়ে মেনস্ট্রিম ছবিগুলির গালে। ‘মুল্ক’ বা ‘আর্টিকেল ফিফটিন’ বানিয়েই দেশের প্রতাপশালী শাসক সরকারের যথেষ্ট চক্ষুশূল তিনি, নতুন মুক্তি-পাওয়া ছবি ‘থাপ্পড়’-এ নারী-পুরুষের ‘মধুর’ সম্পর্কের মধ্যে ঘাপটি-মেরে-লুকিয়ে-থাকা পিতৃতন্ত্রের স্বরূপটা ফাঁস করে দিলেন।
বরাবরই বাজার বজায় রাখার জন্য, আমজনতার কাছে পৌঁছনোর জন্য বাঁধা ছকে সাজানো ছবিগুলিতে প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধ বুনে দেওয়াই বলিউডের কাজ। আর এ ব্যাপারে তার মস্ত সহায় পিতৃতন্ত্র, যা অলিখিত শর্তে সমাজ শাসন করে। দশকের পর দশক ধরে বলিউডের ছবিতে পর্দা আলো-করে-রাখা ঐতিহ্যবাহী মেয়েদের জীবন, যে জীবন দাঁড়িয়ে আছে ঘোর পারিবারিকতা অবলম্বন করে, যে জীবনে বিয়ে থেকে মাতৃত্ব অবধি সব কিছুই আবশ্যিক। মেয়েরা প্রেমকে কী ভাবে নিজের জীবনে ঠাঁই দেবে, কতটা উপভোগ করবে তা পুরুষেরা ঠিক করে দেয়— এটাই পুরো গল্পটা নয়। গল্পের আরও একটা অংশ আছে। সেটা হল মেয়েরা কী ভাবে পুরুষদের এই ঠিক করে দেওয়া মূল্যবোধ বিশ্বাস করে, বহন করে। বলিউডের এই ছবিগুলি দেখতে-দেখতে মনে হতে থাকে যেন মেয়েদের গোটা জীবনটারই নিয়ন্ত্রক পুরুষ, আর নিয়ামক পিতৃতন্ত্র।
ঘটনা হল, দখলদারির অভ্যেস থেকে পুরুষ কিছুতেই নিজেকে মুক্ত রাখতে পারে না। অনুভবের ছবিতেও থাপ্পড় মারার পর বিক্রম বারবার অমৃতাকে মানিয়ে বুঝিয়েসুঝিয়ে নিজের কাছে, নিজের পরিবারে ধরে রাখতে চায়, ওই এক দখলদারির অভ্যেস থেকে। অমৃতার কাছে মাপ চাওয়া তো দূরের কথা, বিক্রম তাকে ফিরে পাওয়ার জন্য বারে বারে বোঝাতে চেষ্টা করে, রাগ-উত্তেজনার মুহূর্তে ‘এমনটা তো ঘটে যেতেই পারে’। অমৃতার উপর এই যে দখলদারি মানসিকতা, এটাকে তাদের দু’জনের সম্পর্কের ‘স্বাভাবিক’ শর্ত বলে মনে করে বিক্রম। পিতৃতন্ত্রের শাসনে এ ভাবেই চলে গোটা সমাজ।
বিক্রমের এই যুক্তিকাঠামোকে যেমন পুরুষেরা— তার নিজের ভাই, সহকর্মী, আইনজীবী, এমনকি শ্যালক (অমৃতার ভাই) পর্যন্ত লাগাতার সমর্থন করে চলে, তেমনই সমর্থন করেন বিক্রমের মা এবং অমৃতার মা-ও— দু’জনেই অমৃতাকে মানিয়ে নিতে বলেন। বিবাহবিচ্ছেদের মামলায় না যেতে বলেন। এতেই বিপজ্জনক ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে আসে। আসলে, পিতৃতন্ত্র-শাসিত সামাজিক ব্যবস্থার অংশীদার নারী-পুরুষ উভয়ই, একেবারে সাবলীল ভাবে। পিতৃতন্ত্র তার ক্ষমতা জারি রাখতে তার মূল্যবোধ চারিয়ে দেয় নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যেই, নিপুণ ভাবে।
মেয়েদের জীবনে সাতপাকের বাঁধনে পুরুষ-স্বামীরা প্রায় দেবদূত হিসেবে আবির্ভূত, এ ধারণা মেয়েরাও কমবেশি বয়ে বেড়ান। জ়োয়া আখতারও তাঁর ছবিতে এই বিপজ্জনক প্রবণতাকে চিহ্নিত করেছেন। ‘দিল ধড়কনে দো’ ছবিতে প্রিয়ঙ্কা চোপড়া অভিনীত কর্মনিষ্ঠ চরিত্রটি যখন জানায়, কাজের ক্ষতি করে সে তড়িঘড়ি মাতৃত্ব চায় না, তাকে শোধরাতে উঠেপড়ে লাগেন তার মা ও শাশুড়ি। ‘জ়িন্দগি না মিলেগি দোবারা’-তেও দেখেছি এমন মেয়ে (কল্কি অভিনীত), পছন্দের পুরুষকে বশে রাখতে তাকে সন্দেহ করে তার জীবন দুর্বিষহ করে দেওয়াই বাতিক ছিল যার।
ছবির শেষ পর্বে অবশ্য অমৃতাকে তার শাশুড়ি বলেন, তিনি যেমন নিজের ছেলেকে মানুষ করতে পারেননি, তেমনই অমৃতার মা-ও অমৃতাকে বড় করার সময় সব কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে বলে ঠিক শিক্ষা দেননি। কথাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক কিছু নির্ভর করছে এর উপরই। কোনও অপমান, কোনও অসম্মানের সঙ্গে বিন্দুমাত্র সমঝোতা করে নয়, রুখে দাঁড়িয়ে নিজের ইচ্ছেমতো বাঁচার ব্রত নিলে তাকে অন্তত মেয়েরা আলাদা ভাবে দেখবে কি না, সেই অতি গুরুতর প্রশ্নটিতে এসে পৌঁছই আমরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy