প্রতীকী ছবি।
কথায় আছে ‘কালো জগতের আলো’। সেই কবিগুরুর আমল থেকে কৃষ্ণকলিদের ‘কালো হরিণ চোখ’ আর ‘পিঠের প'রে মুক্ত বেণী’তেই নাকি মোহিত গোটা দুনিয়া। তবে সত্যিই কি তাই, না কি সবই শুধু কথার কথা! এর উত্তর হয়তো লুকিয়ে আছে পত্র-পত্রিকার ‘পাত্র-পাত্রী চাই’-এর শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপনের মধ্যে।
একটি সমাজকে চেনা ও জানা যায় অনেক ভাবে। যার যেমন রঙিন চশমা, সে তেমন দেখে। তবে এই পাত্র-পাত্রী চাই বিভাগ থেকে যোগ্য পাত্রী হওয়ার ফর্দটা মোটামুটি সবার কাছেই একই ভাবে স্পষ্ট। বিয়ের বাজারে কার দর কেমন হবে, তার মাপকাঠিটা দশকের পর দশক একেক রকম ভাবে নির্ধারিত হয়ে আসছে। সময়ের পরিবর্তনে চাহিদারও পরিবর্তন হচ্ছে। একটা সময় মেয়ের বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক স্বীকৃতি— এগুলিকে প্রাধান্য দেওয়া হত। এখন সে সব ছাপিয়ে গিয়েছে মেয়ের গড়ন ও রং। শিক্ষাগত যোগ্যতাও আজ তার কাছে তুচ্ছ।
এক দিকে পাত্রের বাড়ির পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে ‘ফর্সা, স্লিম, সুমুখশ্রী, শিক্ষিতা পাত্রী কাম্য’। অপর দিকে, পাত্রীপক্ষও ঘরের মেয়েটির অন্য সব যোগ্যতার আগে উল্লেখ করছেন— গৌরবর্ণা, অপরূপ সুন্দরী, বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে, মেয়ের নামে বাড়ি আছে ইত্যাদি। একটি বিজ্ঞাপনে তো পাত্রীকে ‘এ গ্রেড’ বলেও চিহ্নিত করা হয়েছে। এর সঙ্গে চুল, ত্বক, নাক, উচ্চতা, বয়স, জাত, ধর্ম, পৈতৃক সম্পত্তির হিসাব, আয়ের ধারণা— এ সব তো আছেই।
দেশ হয়তো অনেক এগিয়েছে, শিক্ষিত মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু বিয়ের ক্ষেত্রে নারী সেই পণ্যই রয়ে গিয়েছে। সেই পণ্যের দাম ও পছন্দ-অপছন্দ নির্ভর করে অন্য পণ্যের সৌন্দর্যের সাপেক্ষে। ছেলে যতই ডিভোর্সি বা স্কুলের গণ্ডিতে আটকে পড়া হোক না কেন, পাত্রী কিন্তু হতে হবে ‘প্রকৃত সুন্দরী’। এঁরা ‘প্রকৃত সুন্দরী’ বলতে গায়ের রংকেই বিচার করেন। আচার-ব্যবহার, নিজের যাবতীয় গুণ, শিক্ষা-দীক্ষা, রুচিশীলতা প্রভৃতির মাধ্যমে যে আসল সৌন্দর্য ফুটে ওঠে— তা তাঁদের বোধগম্য নয়।
অন্য দিকে, মেয়ে ফর্সা না হলে, বয়স পঁচিশের চৌকাঠ পেরিয়ে গেলে, পূর্বে কোনও বিয়ে বা সন্তান হয়ে থাকলে মেয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে দেওয়া বিজ্ঞাপনের ভাষায় অসহায়ত্বের মাত্রাটা বাড়তে থাকে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা বা সুশ্রী পাত্রীর একটি নিজস্ব বাড়ি আছে কিংবা সরকারি অফিসে কর্মরতা নতুবা পিতা এক্স ব্যাঙ্ক অফিসার ইত্যাদি বলে পুষিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালানো হয়। এ ক্ষেত্রে পাত্রের বয়স বেশি হলেও খুব একটা সমস্যা নেই তার প্রমাণও পাওয়া যায়। এমনকি, বিপত্নিক হলেও দিব্যি চলনসই— ‘‘প: ব: ব্রাহ্মণ কাশ্যপ ৩০+/৫'১" স্নাতক ফর্সা সুশ্রী। ব্রাহ্মণ পাত্র চাই। ডিভোর্সী/বিপত্নীক চলিবে।’’
খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এ হেন বিজ্ঞাপনের পাকেচক্রে যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের মধ্যেও বৈবাহিক অসন্তোষ লেগেই আছে। এত রঙিন পোশাকি আয়োজনের অন্তরালে চাপা পড়ে যায় নিজস্ব সত্ত্বাটুকু।
একটি গবেষণায় উঠে এসেছে সমাজে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত পাত্রী সে, যার গায়ের রং ফর্সা। প্রায় ৬০ শতাংশ বিজ্ঞাপনে সরাসরি গায়ের রং ফর্সা অর্থাৎ গৌরবর্ণা উল্লেখ করা হয়েছে। মাত্র ১৩ শতাংশ বিজ্ঞাপনে পাত্রীর শ্যামলা রঙের কথা উল্লিখিত। যদিও সেখানে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা, সুশ্রী প্রভৃতি অলংকার যুক্ত করা হয়েছে। আর ফর্সার চেয়েও বেশি কিছু বোঝাতে অতীব সুন্দরী, অপূর্ব সুন্দরী, যথার্থ রূপসী— এ ধরণের বিশেষণ ব্যবহার করে মেয়েদের সৌন্দর্যকে বিজ্ঞাপিত করা হয়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ ক্ষেত্রে।
অন্য দিকে, পাত্রীপক্ষ সুদর্শন পাত্র দাবি করেছে এমন উদাহরণ হাতেগোনা কয়েকটি। অর্থাৎ উভয়পক্ষ এটাই মনে করে, নারীকে বাহ্যিক ভাবে সুন্দরী হতেই হবে। এর অন্যথা হলে শহরে-গ্রামে অসংখ্য নারী গঞ্জনা, নির্যাতন সহ্য করে ধুঁকে ধুঁকে বাঁচা অথবা আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া। কিন্তু পুরুষের সৌন্দর্য নিয়ে পাত্রীপক্ষের অন্তত তেমন মাথাব্যথা নেই। আবার, ৮৬ শতাংশ বিজ্ঞাপনে সরাসরি লম্বা, স্লিম বৈশিষ্ট্যকে মাপকাঠি হিসাবে ধরা হয়েছে। শুধু তাই নয়, পাত্রপক্ষ পাত্রীর কাঙ্ক্ষিত উচ্চতাও বলে দিচ্ছে ফুট-ইঞ্চি সমেত। আরেকটি সূচক হল স্বাস্থ্যবতী। যদিও জানা নেই এই শব্দের দ্বারা তাঁরা ঠিক কী বোঝাতে চান! মাত্র ১০-১২ শতাংশ ক্ষেত্রে ভদ্র-নম্র-মার্জিত পাত্রী চাওয়া হয়, যদিও সেখানে বাকি বৈশিষ্ট্যগুলি থাকা আবশ্যিক।
ভারত ও তার পার্শ্ববর্তী অনেক দেশেই এখনো ঘটা করে পাত্রী দেখতে যাওয়ার রেওয়াজ বিদ্যমান। শাড়ি-অলঙ্কারে সজ্জিত হয়ে এসে দাঁড়ালে জনসম্মুখে তার চুল থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ নিরীক্ষণ করার পর তার সাংসারিক গুণের সঠিক ধারণা পেতে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হয়। কেউ ভুলেও তার মানসিকতা, মানবিকতা, সহমর্মিতাকে বোঝার চেষ্টা করেন না। প্রকৃতপক্ষে এটা মনে করা হয় বিবাহের মাধ্যমে পারিবারিক বন্ধনের সূত্রপাত হয়। তাই জীবনকে সুখী করতে ছেলে-মেয়ের উভয়পক্ষের মন ও মতের মিলকে বাতিলের খাতায় রেখে আত্মীয়-পরিজন সকলের গ্রহণযোগ্য কী ভাবে হবে, তার দিকেই বেশি খেয়াল দেওয়া হয়। তাই বিজ্ঞাপনগুলিকে সাধ্যমতো আকর্ষণীয় করার চেষ্টা চলে।
এ সবের ফলশ্রুতি তাৎক্ষণিক না হলেও অদূর ভবিষ্যতে প্রভাব ফেলে নিঃসন্দেহে। পাত্রপক্ষের চাহিদা বা পাত্রীপক্ষের দেখনদারিতা আকাশছোঁয়া হলে এবং বাস্তবিক জীবনে তার কিছুমাত্র ঘাটতি ধরা পড়লেই সাংসারিক গোলযোগের সূত্রপাত হয়। মেয়েদের পৈতৃক সম্পত্তির হিসাব দেখে লালসার বশবর্তী হয়ে ছেলেপক্ষ পণ দাবি করে বসে। এমনকি, বিয়ের পর দাবির পরিমাণ আরও বাড়তে থাকে। কন্যাপক্ষ তা দিতে নারাজ হলে শুরু হয় বধূনির্যাতন। সব চেয়ে দুঃখের বিষয়, এই নারী নির্যাতনের শীর্ষে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্যে শাসকের ভূমিকায় বা যে কোনও উচ্চপদে আজ যতই মহিলারা থাকুন না কেন, চলতি দশকেও এই চিত্রের একটুকু বদল ঘটেনি। শ্যামলা মেয়ে, স্থূলকায় মেয়ে, খর্বাকৃতি মেয়ে, দরিদ্র পরিবারের মেয়ে— এদের যেন কোনও মূল্যই নেই সামাজিক দরাদরিতে। বরং দিনে দিনে দাম ও চাহিদা বাড়ছে ফেয়ারনেস ক্রিমের। আপন মানুষ এ সব বোঝে না কিংবা মানে না। জীবনের বাইরের মতো ভিতরটাও দেখবে, এমন কেউ নেই।
পরিষ্কার ভাবে বলতে গেলে, যে যত বড় ডিগ্রিধারী হোক, গাড়ি-বাড়ির মালিক হোক, প্রবাসে সুপ্রতিষ্ঠিত হোক— এখনও এই সমাজব্যবস্থায় মানুষ হিসাবে নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে মৌলিক কোনও পরিবর্তন আসেনি অভিভাবক বা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের। বিশ্বায়নের যুগে নারী যতই স্বনির্ভর হোক, ‘মেয়ের সবই ভাল, কিন্তু...’ এই কথাটার কোনও নড়চড় হয়নি।
দিন আসে, দিন যায়। তেমনই বছর বছর ৮ মার্চ ও ২৫ নভেম্বর আসে, চলেও গেল। ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ আর ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ ক্যালেন্ডারের পাতাতেই বন্দি হয়ে থাকে। তবে কি দাবি-দাওয়ার বেড়াজাল থেকে মুক্তি মিলবে না! আর কত কালই বা থাকবে অধরা?
ঘাটেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, ধুবুলিয়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy