প্রতীকী ছবি
একটি মেয়ের জন্ম থেকে বড় হয়ে ওঠা, জীবনযাপন সবই নির্ভর করে সমাজের গঠন, কাঠামো ও প্রকৃতির উপর। নারী নির্যাতন ও তার প্রতিকারের চেষ্টা, নারীর সমানাধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে আলোচনা, ভাষণ, অঙ্গীকারের অন্ত নেই; কিন্তু হাতে গোনা কয়েক জনের কথা বাদ দিলে, আপামর নারীর অবস্থা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থেকে গিয়েছে। আমাদের সমাজ পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মেয়ের জন্ম মানেই পরিবারের ভয়, নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা, মেয়ে মানেই দুর্বল যা তাকে পরনির্ভরশীল করে তোলে। সমাজ নিজের প্রয়োজনে ছোটখাটো পরিবর্তন এনে মেয়েদের কিছু সুযোগ সুবিধা দিলেও মূল কাঠামোতে কোনও পরিবর্তন আনতে পারেনি। বদলায়নি সমাজের মানসিকতাও। সমাজ মেয়েদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রাচীন ভারতের মনুর নিষেধাজ্ঞা বা উনিশ শতকের ইংল্যান্ডের ভিক্টোরীয় সামাজিক আদর্শ সযত্নে লালন করে চলছে নতুন নতুন রাংতায় মুড়ে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টায় নারীকে নিরাপত্তা দেওয়ার অঙ্গীকার থাকলেও তাকে সমানাধিকার দেওয়ার ভয় অবিরাম তাড়া করে চলছে।
আপনি ভাবছেন, আপনি ঠিক এমন নন, ছেলে মেয়েকে সমান দেখেন। আপনার মধ্যে নিশ্চয় উদারতা আছে, কিন্তু সমাজ আপনাকে উদারতা দেখানোর যতটা ছাড় দিয়েছে আপনি তার মধ্যেই আসা যাওয়া করেন, বেশি উদার হতে গেলে যে আবার সমাজ বহির্ভূত হবেন। যুগ যুগ ধরে বড় বড় রথী মহারথী, শাস্ত্রকার, পণ্ডিত সমাজের নিয়ম বা কাঠামোতে মাটি লাগিয়ে তাকে মজবুত ও অনমনীয় করেছেন। স্থান, কাল, পাত্র নির্বিশেষে মেয়েদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাটা প্রায় একই রকম। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ছাড়া অন্যত্র রাজা বা শাসকের পুত্রসন্তান না থাকলে বা অযোগ্য প্রমাণিত হলে তবেই কন্যাসন্তানকে সিংহাসনে বসানোর কথা ভাবা হয়েছে। নারীর স্থান পুরুষের পরেই রয়ে গিয়েছে প্রাচীন কাল থেকে।
খুব সম্প্রতি, অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, এস্থার দুফলো এবং মাইকেল ক্রেমার। তাঁদের মধ্যে শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এস্থার দুফলো সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী। আমাদের সমাজের মানসিকতা বদলায়নি কোনও অংশেই, নারীকে সব-সময় স্বামীর আলোকেই আলোকিত হয়ে থাকতে হবে, এখানে এস্থার দুফলোর মতো এক জন অসামান্যা মহিলারও তার থেকে নিস্তার মিলল না। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামের সঙ্গে ‘সস্ত্রীক’ শব্দটি জুড়ে দিয়ে দুফলোর কৃতিত্বকে কোনও মতে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। তা হলে ভাবুন এক বার,আজও আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে!
সমাজে একটি বড় কাঠামোর ভিতরে আরও একাধিক ছোট ছোট কাঠামো থাকে। প্রচলিত ঐতিহ্য, আচার-আচরণ, সামাজিক রীতি-নীতি, ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কার, আইন, বিবাহ ব্যবস্থা ও অন্য সব কিছু নিয়ে একাধিক কাঠামো, আর সেই সব কাঠামো নিয়ে বৃহৎ কাঠামো গড়ে উঠেছে। মানুষ জন্মের পর থেকে ধীরে ধীরে সমাজবদ্ধ জীবে পরিণত হয়, সমাজ তাকে কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত শুধু করে না, বরং সে চেতনে বা অবচেতনে ওই কাঠামোর ধারকে পরিণত হয়। মনে রাখতে হবে পিতৃ-তন্ত্র যখন ক্ষমতা বা কর্তৃত্বের উৎস, তখন তাকে ধরে রাখতে পুরুষদের থেকে মহিলাদের (কর্ত্রী হিসাবে) তাগিদ কিছু কম নয়।
যখনই সমাজ-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের উপর চাপ এসেছে সমাজের মাথায় থাকা মানুষ ছোট ছোট সংস্কারের মাধ্যমে মূল কাঠামোকে অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। আজও সমাজ-ঐতিহ্য, প্রচলিত সংস্কার নিয়ে প্রশ্নকে সুনজরে দেখা হয় না। সমাজ আধুনিক হচ্ছে, সমাজের প্রয়োজনে মেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে, উচ্চ-শিক্ষা লাভ করছে, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজের মতো জীবনযাপন, জীবিকা নির্বাচন ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাধা পাচ্ছে। জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে আজও সমাজ তার রক্তচক্ষু দেখিয়ে কত মানুষকে বিচ্ছিন্ন রেখেছে। মেয়েদের উপর চাপ যথারীতি একটু বেশিই কঠোর। একা মহিলা, অবিবাহিত বা বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে যাঁর বা এক জন বিধবা, এঁদের সমাজ নিয়ন্ত্রণের রাখতে অতিমাত্রায় যত্নশীল। সমাজের বেশিরভাগ মানুষ একা মহিলাকে নানা ভাবে অপদস্থ করেন, প্রত্যেকটা মুহূর্তে তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, তিনি একা তাই সমস্যা, যদি ‘সিঙ্গল মাদার’ হন, তাঁর সন্তানকেও সহ্য করতে হয় নানা গঞ্জনা– বাবার পরিচয় ছাড়া বুঝি বাচ্চা মানুষ হয় না; সমাজের চাপেই বাড়তে থাকে হতাশা। আবার অনেক মহিলাও আছেন যাঁরা মহিলা হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ নেন, সেক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যকে মহিলারা নিজেই স্বীকৃতি দেন বলে তাঁদের নিয়ে সমাজের বিশেষ সমস্যা থাকে না।
এই সমাজে সমানাধিকারের কথা বললেই নারীবাদী বলে তির্যক মন্তব্য করা হয়। সমাজের রক্ষণশীল মানুষই শুধু নন, বরং অধিকাংশ মানুষ মনে করেন নারীবাদীরা সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক, তাঁদের প্রভাব নেতিবাচক এবং নারীবাদ মেয়েদের উশৃঙ্খলতার পথ দেখায়। নারীবাদ আসলে বহুমাত্রিক; একই সঙ্গে বৌদ্ধিক চর্চা ও রাজনৈতিক আন্দোলন যা লিঙ্গ বৈষম্যের অবসান ও সমানাধিকারের কথা বলে; যাঁদের আন্দোলনের ফলেই মেয়েরা ভোটদানের অধিকার, সম কাজে সমান বেতন লাভের অধিকার, আরও অন্য অধিকার উপভোগ করছে। তবে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জনের সুযোগ দেওয়া হলেও যুগ যুগ ধরে নারীকে পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার জালে আবদ্ধ রাখা হয়েছে। মেয়েদের চালচলন, পোশাক, চরিত্র নিয়ে সমাজের কৌতূহল ও সমালোচনার শেষ নেই। এই প্রসঙ্গে সুকুমারী ভট্টাচার্যের লেখা ‘অপসংস্কৃতি?’ (২০০৩) নামে একটি বইয়ের কথা মনে পড়ল। তিনি দেখিয়েছেন যে, হঠাৎ করে সমাজ অশালীন হয়নি, রুচি বা সৌন্দর্যবোধ যুগ নিরিখেই পাল্টেছে। কিন্তু এই পরিবর্তনকে ‘অপসংস্কৃতি’ বলা যায় কি না তা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন।
মনে রাখা ভাল, সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল, ‘অপসংস্কৃতি’ শব্দের মধ্যে একটা স্থবিরতা রয়েছে। যাঁরা অপসংস্কৃতিতে বিশ্বাস করেন, তাঁরা বেশিরভাগই এর দায় সিংহভাগ মেয়েদের উপর চাপিয়ে দেন! শিক্ষার যথেষ্ট প্রসার হওয়া সত্ত্বেও আজও ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাক বা আচরণকে দায়ী করা হয়, ধর্ষকের উদ্দেশ্য বা মানসিকতাকে নয়! কিছু মানুষ অবশ্যই আছেন যাঁরা প্রচলিত ধারণাগুলিকে প্রশ্ন করেন, কিছু পুরাতন ধারণা ভাঙার চেষ্টা করেন, মানসিকতা বদলের কথা বলেন। আবার সমাজ বিশেষ প্রয়োজনে কখনও কিছুটা উদার হয়, মেয়েদের সুরক্ষায় আইন তৈরি হয়, এর ফলে আমরা কিছু পরিবর্তনের আশা দেখি, কিন্তু মূল কাঠামো এক থেকে যায়। পিতৃতন্ত্র এমনই এক কাঠামো, যা যুগ যুগ ধরে অটল। নারীকে সম্মান দেওয়ার যে শিক্ষা সমাজ দেয় সেটি আরোপিত, অনেকাংশে বাহ্যিক যা নারীকে অবদমনের পথ খুলে দেয়।
সমাজ ও পরিবার আজও কন্যাসন্তানের জন্মকে ভয় পায়, এ দেশে ভ্রূণহত্যা এখনও বেশ প্রচলিত; এই সমাজই নারীকে পণ্য করে; অসহায় ও নিরুপায় বহু মহিলাকে উপার্জনের জন্য দেহব্যবসার দিকে ঠেলে দেয়। যখনই কোনও মহিলা মূল কাঠামোকে মানতে নাকচ করেন বা তাতে বিন্দুমাত্র আঘাত হানেন, তখনই সেই মহিলাকে অপদস্থ করতে তথাকথিত ‘আধুনিক’ শিক্ষিত মানুষেরাও সমাজের আরোপিত শিক্ষা ভুলে নিজেদের রুচি ও শালীনতার পরিচয় দেন। মেয়েদের জীবনে যে সব সমস্যা আছে তা মূলত মানুষেরই সৃষ্টি, তাকে টিকিয়ে রাখতেও মানুষের ভূমিকা যথেষ্ট; এতে প্রগতির গতি শ্লথ হলেও মেয়েদের সমানাধিকার দেওয়ার সাহস দেখান ক’জন?
শিক্ষিকা, ডোমকল গার্লস কলেজ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy