কৃশন চন্দরের একটি উর্দু গল্পের অনুবাদ পড়ছিলাম কিছু দিন আগে। গল্পের নাম ‘অমৃতসর, আজাদি সে পহলে, আজাদি কে বাদ’। সেখানে দেখা হল পারো, জৈনাব, শ্যাম কৌর ও বেগম নামের চার অমৃতসরবাসিনীর সঙ্গে। চার গৃহিণী যাঁরা বিকেলে বাজার করতে বেরিয়েছেন। বাতাসে বারুদের গন্ধ। ‘খুনী বৈশাখী’-র পরই চালু হয়েছে সামরিক শাসন। কার্ফু-র ঘণ্টা পড়ার আগে সবজি কিনে বাড়ি ফেরার তাড়ায় ওই চার জন একটা গলি দিয়ে শর্টকাট করবেন বলে এগিয়েছেন। কিন্তু গলির মুখে তাঁদের পথ আটকাল গোরা সৈন্য।
তার পর কী হল সেটায় যাচ্ছি না। না, গোরা সৈন্যদের হাতে ওই পঞ্জাবি মেয়েরা সে দিন ধর্ষিত হননি। তেমন কিছু ঘটে থাকলে পৌরুষবাদী জাতীয়তাবাদের ইতিহাস বইয়ে ফুটনোট থাকত। কিন্তু সে সময় পঞ্জাবে গোরাদের হাতে সম্ভবত মেয়েদের ধর্ষণ ঘটেনি। জালিয়ানওয়ালা বাগে এক জন মেয়েও ‘শহিদ’ হননি। রাওলাট সত্যাগ্রহের ছোট-বড় নেতৃত্বেও কোনও মেয়ে ছিলেন না। তাই কি আজাদির আগে ও পরে, এমনকি এই শতবর্ষেও জালিয়ানওয়ালা বাগ নিয়ে চর্চায় পঞ্জাবের মেয়েরা পুরোপুরি অদৃশ্য থেকে যান? যেন তাঁদের গায়ে আঁচ লাগেনি, যেন তাঁদের কোনও ভূমিকা ছিল না ‘খুনী বৈশাখী’-র পরের প্রতিবাদ-প্রতিরোধে!
রত্তন দেবী নামে এক জনের উল্লেখ অবশ্য বহু জায়গায় পাওয়া যায়, যিনি স্বামীর দেহ আগলে সারা রাত বসে ছিলেন মৃত্যুভূমিতে, হাতে একটা লাঠি নিয়ে কুকুরদের দূরে রাখার চেষ্টায় সেই ভয়াবহ রাত তাঁর কী ভাবে কেটেছিল, সে বর্ণনা প্রায়ই উদ্ধৃত হয়। কিন্তু আমরা ক’জন জানি যে সেই দিন যে পুরুষরা আর ঘরে ফেরেননি, তাঁদের স্ত্রীদের মধ্যে কয়েক জন সন্তানসম্ভবা ছিলেন। দেহ সৎকার করার পূর্বমুহূর্তে সমবেত জনতাকে পরিবারের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হত যে ঘরের বৌটির গর্ভে লালিত হচ্ছে ‘শহিদ’ স্বামীর সন্তান! পরে যদি কলঙ্ক রটে! মেয়েটির শোক-নিভৃতি ধর্তব্যের মধ্যেই নয়! পূরণ দেবী নামে এ রকমই এক শহিদ-পত্নী নিজের একমাত্র ছেলেকে বড় করার পাশাপাশি হৃষিকেশে পরিবার-পরিত্যক্তা মেয়েদের জন্যে গড়ে তুলেছিলেন আশ্রয়। আত্তর কৌর নামে এক সন্তানসম্ভবা বিধবা ফিরিয়ে দেন ইংরেজ সরকারের পাঠানো ‘কম্পেনসেশন’-এর টাকা। স্মারক স্তম্ভে লেখা থাকে না এঁদের নাম।
রত্তন দেবী ও তাঁর মতো স্বজন-হারানো অনেক মেয়ে জালিয়ানওয়ালা বাগ স্মারক তহবিলে দান করেছিলেন মুক্ত হস্তে। যাঁর টাকা দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না, সন্তানহারা সেই অপরিচিতা দিয়েছিলেন তাঁর ছেলের ব্যবহৃত জামাকাপড়। সামরিক শাসনে পুরুষদের ধরপাকড়ের ফলে বহু পরিবারের ভার এসে পড়েছিল গৃহিণীদের ওপর। তাঁদের জন্য গড়া তহবিলেও বিশেষ অবদান ছিল পঞ্জাবের মেয়েদের। যাঁদের স্বামীদের আন্দামানের সেলুলার জেলে পাঠানো হয়েছিল, তাঁরা নিজেদের হাতের সোনার বালা খুলে দেন ওই সব তহবিলে। লাহৌরবাসিনী সরলা দেবী চৌধুরানি (ছবিতে), বিশ্বযুদ্ধের সময় বাঙালি ছেলেদের সেনাবাহিনীতে যোগদানে উদ্বুদ্ধ করার স্বীকৃতি হিসেবে যে ‘ব্যাজ’টি পান, সেটি প্রতিবাদস্বরূপ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ১৯১৯ সালে।
রাওলাট সত্যাগ্রহের সময় থেকেই লাহৌর, অমৃতসর এবং অন্যান্য জায়গায় মেয়েরা চার দেওয়ালের মধ্যে আলাদা মিটিং করেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্বে যে ভাবে পঞ্জাবের গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে জবরদস্তি করে ছেলেদের ব্রিটিশ ফৌজে নাম লেখাতে বাধ্য করা হয়, তার জেরে পরিবারের মেয়েদের মধ্যে দানা বেঁধেছিল শাসক-বিরোধিতা। তার পর ১৩ এপ্রিলের ঘটনায় শোকস্তব্ধ থাকার সময়ও পাননি পঞ্জাবের মানুষ। মিস্ শেরউড নামে এক ইংরেজ মহিলাকে অমৃতসরের রাস্তায় ১০ এপ্রিল এক দল গুন্ডা আক্রমণ করে। তার প্রতিশোধে জেনারেল ডায়ার পঞ্জাবিদের উচিত শিক্ষা দিতে কোনও কসুর করেননি। জনসমক্ষে ‘অপরাধী’ পুরুষদের চাবকানো, রাস্তায় হামাগুড়ি দিতে বাধ্য করা, কার্ফু-সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা ও নানাবিধ উদ্ভাবনশীল অত্যাচার তো ছিলই। সেই সঙ্গে পুরুষদের অনুপস্থিতিতে বাড়িতে ঢুকে গোরাদের অশ্রাব্য হুমকি, অশালীন আচরণ, বাড়িঘর তছনছ করে দেওয়ার মুখে মেয়েদের পড়তে হত আকছার।
গাঁধী ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ কাগজে নিয়মিত লিখতেন মেয়ে-বৌদের ওপর এ সব অত্যাচার নিয়ে। তার পর ১৯১৯-এর অক্টোবরে যখন তাঁর পঞ্জাবে ঢোকার অনুমতি মিলল, তখন বহু জায়গায় মেয়েদের আলাদা মিটিং হয়েছিল যেখানে তাঁরা ভিড় করে আসতেন লোকলজ্জা এবং পুলিশ-প্রশাসনের ভয় ভেঙে। গাঁধীর সঙ্গে সর্বত্র চষে বেড়িয়ে, সভায় মেয়েদের নিয়ে আসায় যাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল, তিনি সরলা দেবী চৌধুরানি— যাঁর স্বামী রামভজ দত্ত চৌধুরী তখন কারাবন্দি।
এর কয়েক বছর আগেই ১৯১০ সালে সরলা দেবী স্থাপন করেছিলেন ‘ভারত স্ত্রী মহা মণ্ডল’ নামে মেয়েদের প্রথম সর্বভারতীয় সংগঠন, যার শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে ছিল করাচি থেকে কানপুর হয়ে কলকাতা পর্যন্ত। অনেকটা সেই সাংগঠনিক আন্তর্জালের জোরে বিধ্বস্ত পঞ্জাবের আনাচে কানাচে মেয়েদের কাছে পৌঁছনো গিয়েছিল। কিন্তু আমাদের ইতিহাস/সমাজচেতনা এতটাই পুরুষতান্ত্রিক যে পঞ্জাবে রাজনৈতিক কর্মী ও গাঁধীর সহযোগী হিসেবে সরলার ভূমিকা সম্পূর্ণ চাপা পড়ে গিয়েছে অন্য একটি পরিচয়ের তলায়। বছর দশ-বারো হল সরলা পর্যবসিত হয়েছেন গাঁধীর জীবনে রহস্য-মানবী হিসেবে। পঞ্জাবপর্ব নিয়ে লেখার সময় রাজমোহন গাঁধী থেকে শুরু করে রামচন্দ্র গুহ, কেউই সরলার রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে একটি বাক্যও ব্যয় করেননি। তাঁদের বয়ানে মুখ্য হয়ে উঠেছে ১৯১৯-এ লাহৌরে সরলা দেবীর বাড়িতে বেশ কিছু দিন অতিথি হয়ে থাকার সময় গাঁধীর সঙ্গে সরলা দেবীর নৈকট্য। ভাগ্যিস বহু আগে যোগেশচন্দ্র বাগল লিখে গিয়েছেন যে, ‘‘দৈহিক মৃত্যু না ঘটিলেও কোনও বিশেষ আদর্শ বা মতবাদের জন্য যিনি আত্মবলি দেন তাঁহাকেও শহিদ বলা যায়। এই অর্থেই সরলা দেবী চৌধুরানী মহাত্মা গাঁধী প্রবর্তিত অহিংস আন্দোলনের প্রথম মহিলা শহীদ।’’
শুধু সরলা নন, চাপা পড়ে গিয়েছে জালিয়ানওয়ালা বাগ-পরবর্তী স্বাধীনতা আন্দোলনে পঞ্জাবের মেয়েদের ভূমিকাও। ভাগ দেবী, ফুল কৌর, পুষ্পা গুজ়রালের মতো মেয়েদের শাসক-বিরোধিতার ধরন থেকে শতবর্ষ পরেও অনেক কিছু শেখার আছে। অবশ্য যদি আমরা পপকর্ন খাওয়ার ফাঁকে জাতীয় সঙ্গীতের জন্য উঠে দাঁড়ানো ছাড়া দেশের কথা আর একটুও ভাবতে চাই...।
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy