বহরমপুরের এক অভিজাত পরিবারে জন্ম মেয়ের। কোনও দিন সেই মেয়েকে নিয়ে বাইরে যেতেন না পরিবারের সদস্যেরা। কারণ, মেয়ের রং কালো। সেই কালো মেয়ে গুমরে গুমরে বড় হল। আজ সেই মেয়ে চিকিৎসক। ভালবাসার অভাববোধেই কি তা হলে শৈশব কেটেছে? ছলছল চোখে সেই মেয়ে বলছেন, ‘‘আসলে আমি তো জানতাম না আমায় কেউ কেন ভালবাসে না। যখন বুঝলাম, তখন খুব মনখারাপ হয়ে গেল। খেতে ভাল লাগত না। ঘুমোতেও পারতাম না। শুধু হলুদ মাখতাম। ভাবতাম, এমনি করে যদি ফর্সা হওয়া যায়!’’
কিছু পরিবারে বলা হয়, কালো চলবে! কিন্তু স্কিনে গ্লো আনতে হবে। তাই বিয়ের আগে নিয়ম করে চলে ফর্সা হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। আবার বিয়ের দিন যাতে কালো না লাগে তার জন্য মেকওভারের শর্ত রাখে ছেলের পরিবার। বহরমপুরে এক বনেদি পরিবারের ছেলে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে পড়তে গিয়ে দক্ষিণ ভারতের এক মেয়েকে পছন্দ করে। একমাত্র ছেলের পছন্দের কাছে পরিবারকে সমঝোতা করতে হয়। মেয়ের বাড়িতে টেলিফোনে জানানো হয়, ‘‘পরিবারের একটা মান আছে। বিয়ের দিন খুব কালো দেখালে কিন্তু চলবে না!” গর্বের সঙ্গে পরিবারের সদস্যেরা এ কথা গল্পও করেন। শুনে কেউ অবাক হন না! কালো মেয়ের পরিবার এমন নির্যাতনেরই শিকার। এটা মেনে নেওয়াটাই যেন বিধান।
অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ এক আধিকারিক নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। কালো হওয়ার কারণে তাঁকে বিখ্যাত এক নামী প্রতিষ্ঠানের গবেষণা কক্ষের পাশে এক বেঞ্চে বসে থাকতে হয়েছিল সারাদিন। চিনতেই পারেননি কেউ! চেনার প্রয়োজনও বোধ করেননি কেউ। দিনের শেষে সাহস করে তিনিই ভিতরে ঢুকেছিলেন। সবাই অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘‘আপনি কি সেই? কী করে চিনি বলুন তো!” তার পরে উনি শুনে ফেলেছিলেন সেই বিস্ফোরক মন্তব্য। রিসার্চ স্কলাররা আসলে ওঁকে ‘কাজের মেয়ে’ ভেবেছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা জীবনে বিরাট সাফল্যের শিখর ছুঁয়েও তিনি বলছিলেন, “আসলে আমরা কালো তো! সে ভাবে কেউ ওয়েলকাম করে না! অবজ্ঞা করার ব্যাপারটা থেকেই যায়!”
ময়নার বিয়ে হচ্ছে না। বয়স প্রায় তেত্রিশ হয়ে গেল। কলেজ শেষ করেএখন তিনি বাড়িতেই। ঘরে বসে কাঁদেন। প্রথমে কিছুদিন গ্রামের জনা কয়েক ছেলেমেয়েকে পড়াতেন। এখন বিড়ি বাঁধেন। পাত্রপক্ষ আসে। খেয়েদেয়ে ফিরে যায়। যাওয়ার আগে শুনিয়ে যায় হাজার কথা। কখনও বলে, ‘‘সাবান মাখান।’’ কখনও বলে, ‘‘ডাক্তার দেখান।’’ কখনও বলে, ‘‘বাজারে তো ফর্সা হওয়ার অনেক ক্রিম আছে। মেয়েকে বলুন এ বারে!’’ গত পুজোয় এসে পাত্রপক্ষ বলেছে, ‘‘এত কালো মেয়ে আমরা ঘরে নেব না বাপু!” ময়না তাই আড়াল খোঁজেন। পরিবারের সকলের সামনে তিনি যেন অপরাধী। এই পীড়ন আর কত দিন?
কালো মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না—এমন ঘটনায় ভরা গাঁ-গঞ্জ। কিন্তু শ্যামলীরা চেনা পথ ধরেই হেঁটেছেন। বন্ধ ঘরে চোখের জলে আয়না ধুয়ে ফেলেছেন। জবাব খুঁজেছেন ‘ফেয়ারনেস ক্রিমে’। নিজেকে একটু ফর্সা করে উপযুক্ত করে তুলতে হবে! তাঁরা এটাই প্রশ্রয় দিয়ে এসেছেন বরাবর। ‘আমার রং আমার পরিচয় নয়। রঙের দায় জিনের’— এমনটা বলে সটান মাথা উঁচু করে ওঁরা পথের ধুলো ওড়াতে শেখেননি। কালো রঙের প্রতি বিতৃষ্ণা প্রকাশের থেকেও ভণ্ডামিটা সমাজের পক্ষে আরও বিপজ্জনক।
মেয়েদের কৃষ্ণবর্ণের কারণে অপমানিত হওয়া ও বঞ্চনার শিকার হওয়া অন্যায়। কিন্তু এর প্রতিকার কী? শিক্ষিকা থেকে গৃহবধূ— কালো রঙের জন্য আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনার বহু নজির রয়েছে। শুধু মেলালিন নামক রঞ্জক দেহে বেশি থাকায় এক মেয়ে বঞ্চিত হবে স্বাভাবিক জীবন থেকে? ভাবলে অজ্ঞতা ও অসভ্যতাই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। কিন্তু ত্বকের কালো রং কোনও ‘ডিজ়র্ডার’ নয়। কোনও রোগও নয়। বিজ্ঞানের শিক্ষক-সহ ত্বক বিশেষজ্ঞ সকলেরই এক কথা। তবে এই নীরব সত্যের আস্ফালন নেই! বরং উল্টে সঙ্কোচটাই প্রাধান্য পায়। তবে কি আপনারা বিজ্ঞান ক্লাসে বংশগতি পড়াতে গিয়ে জিন ও কালো রঙের কথা বলেন না? নাকি ছেলেমেয়েরা সেটা বুঝতে পারে না? এই প্রশ্নের উত্তরে এক বিজ্ঞান শিক্ষক বলছেন, ‘‘বলি তো! একটি মেয়ে কালো রং নিয়ে জন্মালে তাকে টার্গেট করে অপমান করা ভীষণ অবৈজ্ঞানিক একটি কাজ। সব শিক্ষকের সমান ভাবে বলা প্রয়োজন। এটি শুধু আর জীববিদ্যার সিলেবাসের বিষয় নয়। একটি গভীরতম সামাজিক ক্ষত।’’
ফোটোফ্রেমে তিন জন মেয়ে। একটা ছবি উঠল। এ বারে আর একটা টেক। কিন্তু অঘটন ঘটল। একটি মেয়েকে বেরিয়ে যেতে বলা হল ফ্রেম থেকে। কারণ সে ‘কালো ও মোটা’। এই ঘটনার ঠিক এক যুগ পেরিয়ে বাজারে এল এক নতুন বই। নাম ‘আই হ্যাভ নেভার বিন (আন) হ্যাপিয়ার’। সেই বিতাড়িত কালো ও মোটা মেয়েটি সাহিন ভাট। তাঁর লেখা বইয়ের একাধিক মর্মান্তিক বিবরণ থেকে জানা গেল, মেয়েরা কেমন করে মনে মরে যায়। নিজের অর্পিত কালো রং কী ভাবে অর্জিত সব ক্ষমতার সমাধি দেয়। চারপাশের মানুষ এর নানা ব্যাখ্যা দেন। কিন্তু নিজেদের অপরাধ স্বীকার করেন না। কেননা কালো মেয়েকে নিয়ে কটাক্ষ করাটাই যেন স্বভাবিক। সিনেমা ব্যক্তিত্ব রেখা-কাজল থেকে পাড়ার সাফিনার অভিজ্ঞতা এক। ক্যামেরার গুণে বা সার্জারির কায়দায় অভিনেত্রীরা এগিয়েছেন। সাফিনারা এখনও অন্ধকারে স্তব্ধ। সহজে বিয়ের পাত্র মেলে না। মেলে না রিসেপসনিস্টের কাজও। ইন্টারভিউয়ে মুখের উপরে বলে দেওয়া হয়, ‘‘আপনার মুখ, চোখ ফ্যাকাসে। চুল রুক্ষ। তার উপরে আবার কালো! লোক তো আপনাকে দেখে অসুস্থ হয়ে পড়বে।’’ শপিং মল ও বিউটি পার্লারে কালো রঙের মেয়েকে সাধারণত কাজে রাখা হয় না। নিলেও অপেক্ষাকৃত কম পয়সায় রাজি করানো হয়।
কালো মেয়ে জন্মালে মা-বাবা লজ্জা পেতে থাকেন। মেয়ের কালো মুখ দেখে পরিবারে মড়াকান্না শুরু হয়ে যায়। কন্যাসন্তান বেঁচে থাকার চেয়ে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ কালো মেয়ের পাত্র খোঁজা। জন্ম দিয়ে মা কাঁদতে থাকেন, ‘‘আমার পেটের মেয়ে এমন কালো?’’ বাবারও মাথায় হাত! অনেকেই সহানুভূতি দেখাতে বলেন, ‘‘দাদা এত ভাল লোক! লাক খারাপ। তাই মেয়েটা এমন কালো হয়ে গেল।’’ আত্মীয়েরা সান্ত্বনা দেয়, ‘‘বড় হলে এত কালো থাকবে না!”
কালো মেয়ে কেঁদে উঠলেই ফুঁসে ওঠেন দিদা-ঠাকুমারা, ‘‘চুপ কর! কিসের দেমাক! তুই কি সুন্দরী? কপাল খারাপ না হলে কি এমন কালো মেয়ে জন্ম দেয় কেউ?” ইশারা কালো মেয়ের মায়ের দিকে। বংশগতি ও জিনের সব বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নস্যাৎ করে কালো মেয়ের মা হয়ে যান প্রধান ভিলেন। জবাবদিহি তাঁকেই করতে হবে। কিন্তু কার কাছে? অবশেষে মায়ের ভালবাসা হারাতে শুরু করে কালো মেয়ে। বিরাট এক প্রশ্ন তার সামনে এসে দাঁড়ায়— সে আসলে কে? কালো মেয়ে নাকি মানুষ?
শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy