—প্রতীকী চিত্র।
শিক্ষাক্ষেত্রে প্রথম পর্বের লকডাউন যদি হয় থমকে যাওয়া, দ্বিতীয় পর্বে তা হয়ে দাঁড়ায় মানিয়ে নেওয়ার যুদ্ধ। শিক্ষা জগতের নতুন ভরকেন্দ্রে উপনীত হওয়ার পথে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকা, উভয় পক্ষই যে ভাবে অনলাইনে লেখাপড়া, গানবাজনা, বকাঝকা, নজরদারি ইত্যাদি বিষয়ে সড়গড় হয়ে উঠলেন, তেমনটা কি আগে কখনও ভেবেছি? করোনা-কালের আগে সেমিনারে এ সব আলোচনায় শুনতাম যে, ভবিষ্যতে এমন হয়তো হতে চলেছে। এত তাড়াতাড়ি হাতেকলমে এমন হয়ে যাবে, তা আগে কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি।
আজ বাইশ বছর ধরে পড়ানোর পেশায় ও নেশায় আছি। মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সেল শিখেছি পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে, ইমেল পাঠাতে শিখেছি চল্লিশের পরে। এহেন আমি পঞ্চাশে পৌঁছে দু’তিন মাসের ভিতরে ইউটিউবার হয়েছি, নিজের ভিডিয়ো এডিট করতে শিখেছি, অনলাইন ফর্ম, কুইজ়, ফাইল কনভার্ট করাও শিখে গেলাম। ভিডিয়ো মিট, ফেসবুক লাইভ জলভাত। লকডাউন ছাড়া এ সম্ভব ছিল না। নিজের বিষয়ের লোকেরা তো বটেই, দেখছি অন্য বিষয়ের সহকর্মীরাও সাধ্যমতো শিখছেন এবং যিনি যেটা শিখছেন, তিনি অন্যকে তা শেখাচ্ছেন। ছেলেমেয়েরাও যে বসে নেই, তার প্রমাণ বিভাগের ফেসবুক পেজ রোজই ভরে উঠছে তাদের অঙ্কনে, কবিতায়, প্রবন্ধে, ফোনে তোলা ছবিতে। অনেকেই নিজের ইউটিউব চ্যানেল খুলেছে— কেউ রান্না শেখানোর, কেউ পড়ানোর, কেউ হস্তশিল্পের। এটা পরিষ্কার যে, শিক্ষা জগতের চাকা গড়াচ্ছে। তবু ক’টি কথা মনে হচ্ছে।
প্রথমত, স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে আমাকে যেমন অন্য কলেজে কোনও বিষয়ের মৌখিক পরীক্ষা নিতে বা কোনও আমন্ত্রিত বক্তৃতা দিতে যেতে হয়, তেমন আমাদের কলেজেও অন্যান্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা আসেন। ভিডিয়ো মিট অ্যাপে অনলাইন ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়াতে করোনা-পরবর্তী সময়েও এই ব্যবস্থা চলবে। অর্থাৎ, পুরোপুরি অফলাইন ব্যবস্থা আর কোনও দিনই ফিরবে না। এক মিশ্র ব্যবস্থা চলবে।
অনলাইন ক্লাসে সুবিধা দু’টি। ভিন্রাজ্যের এবং ভিন্দেশের প্রথিতযশা শিক্ষকরা সহজলভ্য হবেন। রাহা খরচ, থাকা-খাওয়ার খরচ শূন্যে নেমে আসা এবং রেকর্ডিংয়ের সুবিধা থাকার জন্য সরকার পোষিত সাধারণ কলেজগুলি দামি বেসরকারি কলেজগুলির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে (কলেজের নিজস্ব শিক্ষকদের কাজ কিন্তু কমবে না— আমন্ত্রিত বক্তা যেটুকু পড়িয়ে যান, ঘরের শিক্ষকেরা সেটাকে ঘষেমেজে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা পর্যন্ত এগিয়ে দেন)। এতে বেসরকারি শিক্ষা ব্যবসার উপরে খরচ কমানোর চাপ বাড়বে। সাধারণ মানুষের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। কিন্তু এই আশা তখনই পূর্ণ হবে, যদি সরকারের সদিচ্ছা থাকে। এই ক্রান্তিকালে যদি সরকার শিক্ষাক্ষেত্র থেকে হাত তুলে নিয়ে বেসরকারিকরণের পথ প্রশস্ত করে, তবে সাধারণ মানুষের এই উপকারটুকু হবে না।
দ্বিতীয়ত, একটা ব্যাপার এই সময়ে লক্ষ করলাম। যে ছাত্রছাত্রীরা প্রায়শই নানান অজুহাতে ক্লাস কামাই করত, অনলাইন ক্লাসেও তারাই অনিয়মিত। আর শিক্ষক সম্প্রদায়ের ভিতর অল্প কয়েক জন উদাসীন থাকেন, লকডাউনে সেই তাঁরাই চমৎকার বিশ্রাম নিচ্ছেন। শিক্ষাজগতের আমূল পরিবর্তনে এই দুই প্রজাতির তেমন কোনও ভূমিকা নেই। আমাদের ছাত্রাবস্থাতেও কিছু অসাধারণ শিক্ষককে পেয়েছি, জ্ঞানে-অজ্ঞানে যাঁদের অনুসরণ ও অনুকরণ করে চলেছি। এঁদের পাশাপাশি কিছু গড়পড়তা শিক্ষকও ছিলেন। কিন্তু তাঁদের বক্তৃতার মান যেমনই হোক, তাঁরা যা বলে দিতেন, যে বই দেখিয়ে দিতেন, তাকে যাচাই করার জন্য বিকল্প উৎস আমাদের হাতে ছিল না। কিন্তু এখন দেশবিদেশের শিক্ষকরা মুঠোফোনের জানালা দিয়ে ছাত্রদের সামনে হাজির। শুধু রেকর্ডেড বক্তৃতা নয়, বৈদ্যুতিনমাধ্যমে তাঁদের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর, কথাবার্তাও সম্ভব। তাই ক্লাসে আজ নিম্ন বা মাঝারি মানের বক্তৃতার দিন শেষ।
এই মূহূর্তে সার্বিক ভাবে শিক্ষকতার পেশাটি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। চ্যালেঞ্জ মূলত দু’রকম। এক, মিশ্র পদ্ধতিতে মানিয়ে নেওয়া— কলেজে প্র্যাক্টিকাল, বাড়ি থেকে অনলাইনে থিয়োরি, চব্বিশ ঘণ্টায় যে কোনও সময়ে মিটিং— এই সময়ের দাবির সঙ্গে শারীরিক এবং মানসিক ভাবে মানিয়ে নেওয়া; আর দুই, বিশ্বমানের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে নিজেকে তৈরি করা। তাই উদাসীন শিক্ষকদের সামনে এখন ঘোর বিপদ।
তৃতীয়ত, শুধু ব্যক্তি-শিক্ষকরা নন, অগণিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। কুড়ি বছর আগেও যে উচ্চবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা জেনারেল ডিগ্রি কলেজে পড়তে আসত, আজ তারা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে, এমনকি শিক্ষা ঋণ নিয়ে দেশের নামী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা এমনকি বিদেশে বৃত্তিমুখী কোর্সে ভর্তি হচ্ছে। সাধারণ কলেজের আসন ভর্তি করছে মূলত প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়ারা। এই কারণে এখন সাধারণ কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে ছাত্রসংখ্যা তলানিতে, কিন্তু কলা বিভাগগুলি উপচে পড়ছে। ল্যাবরেটরি ফি এবং আনুষঙ্গিক খরচের কারণে বিজ্ঞান পড়া তুলনায় মহার্ঘ। ছাত্রছাত্রীরা বেশি মাত্রায় বিজ্ঞান পড়ছে না, তার কারণ জেনারেল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের সাহসের অভাব ও আর্থিক অনটন। ফলত, কলেজে এসে ল্যাবরেটরিতে প্র্যাক্টিকাল করতে হবে, এমন ছাত্রসংখ্যা এই সব কলেজে শতাংশের হিসেবে কম। বঙ্গীয় শিক্ষাব্যবস্থা টিউশনি-নির্ভর, ফলে অনেক ছাত্রছাত্রীর হাজিরা অনিয়মিত। তা ছাড়া ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রভৃতি যে সব বিষয়ে ছাত্রসংখ্যা অনেক বেশি, সেখানে সকলে হাজিরা দিলে সব জায়গায় হয়তো ঘরে স্থান সঙ্কুলান হবে না।
এই পরিপ্রেক্ষিতে লকডাউন একটি অন্য মাত্রা যোগ করল। কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে এখন সুযোগ এসেছে সকলকে নিয়ে অনলাইন থিয়োরি ক্লাস করার। আবার ছাত্রছাত্রীদের সমনে সুযোগ এসেছে অনলাইন ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হওয়ার। কারণ, সরকারি নীতি অনুযায়ী আইআইটি বা সমতুল নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনলাইন কোর্স পড়াতে শুরু করেছে। ধরে নেওয়া যেতে পারে, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ভারতীয় মেধা ও অর্থসম্পদ লাভের এমন সুযোগ হাতছাড়া করবে না। লকডাউন ছাত্রছাত্রীদের ডিজিটাল ক্লাসে যোগদানের সঙ্কোচ কাটিয়ে দিয়েছে।
ভূগোল বিভাগ, প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy