দু’পাশের খাড়া ঢালের মাঝের উঁচু জমিতে বুক চিতিয়ে শুয়ে থাকা দু-পাটি লাইন জুড়ে যন্ত্রদানবের মতো ধেয়ে আসছে কৃষ্ণকায় রেলইঞ্জিন। মাথায় তার কালো ধোঁয়ার শিরস্ত্রাণ। পায়ে সহস্র অশ্বশক্তির গতি।
ইঞ্জিনের হুইসেলের শব্দে দু’পাশের ঝুপড়ি থেকে পিঁপড়ের মতো পিলপিল করে বেরিয়ে পড়েছে লোক। হাতে তাদের সরু লম্বা লাঠি। লাঠির মাথায় গোঁজা দু’-পাঁচ টাকার নোট। ইঞ্জিন কাছে আসতেই লাঠি উঁচিয়ে ধরছে প্রত্যেকে। ভেতর থেকে একটা লোক চিলের মতো ছোঁ মেরে তা নিয়ে লাঠি ফেলে দিচ্ছে নীচে। সেই সঙ্গে কয়েক বেলচা কয়লা। যেন কয়লার বেসাতি এসেছে তার পসরা নিয়ে।
এ দৃশ্য এখন আর আমাদের জীবনের জলছবিতে ধরা পড়ে না। তবে একটা সময় ছিল যখন এ চিত্র অহরহ দেখা যেত। কয়লার ইঞ্জিন কবে উঠে গিয়েছে। কিন্তু তার স্মৃতিটুকু আজও রয়ে গেছে। শত চেষ্টাতেও মন থেকে সে দাগ আজও ওঠেনি।
গত শতকের শেষ দশকের পথচলা তখনও শুরু হয়নি। আশির দশকের একেবারে গোড়ার কথা। শহরতলিতে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের এত বাড়বাড়ন্ত তখন কোথায়! সবই বাংলা মিডিয়াম। পাড়ায় হাতেগোনা দু’এক জন ইংরেজি স্কুলের ছাত্র যে একেবারে থাকত না তা নয়। তবে সংখ্যাটা নেহাতই কম। আর সেই কারণেই পাড়ার লোকে সবাই তাদের চিনত। বড়দের কথা জানি না, তবে সমবয়সীরা তাদের সম্ভ্রমের চোখে দেখত। সে সময়ে বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলো এখনকার মতো এত রং-চঙা ছিল না।
তবে বিল্ডিংয়ের অভাব এখনকার মতো তখনও ছিল। এক-একটা স্কুলবাড়িতে দু’টো শিফটে পঠন-পাঠন চলত। সকালে প্রাইমারি, দুপুরে হাইস্কুল। ভোর হতে না হতেই খুদে-গুড়েদের তখন একটাই গন্তব্য—স্কুল। বাবা-মায়ের হাত ধরে ভবিষ্যতের প্রজন্ম পৌঁছে যেত যে যার স্কুলে। কেউ পায়ে হেঁটে কেউ বা আবার খাঁচা গাড়িতে। টিনের খাঁচা দিয়ে ঘেরা পায়ে টানা গাড়ি। যার মাঝ বরাবর দু-পাশে ও পিছনে তারের বেড়া দিয়ে মোড়া। ওটাই জানলা। গাড়ির ভেতরে ডানে ও বাঁয়ে দু’সারি বেঞ্চ। যেখানে মনের মতো জায়গা পাওয়ার জন্য কচিকাঁচাদের হুটোপুটি লেগেই থাকতো। এই বসা নিয়েই চলতো কত নালিশ, পাল্টা-নালিশ। বিচারকের আসনে তখন ভ্যানচালক কাকু। তিনিই রাজা। তিনিই সম্রাট। তিনিই শেষ কথা। আবার শুধু নালিশের কারণেই ভ্যানকাকুর কাছে কত ছেলেমেয়ে যে পিঠে বালিশ পেয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। গন্তব্য এসে গেলে গাড়ি থামিয়ে চালক গাড়ির পেছনে এসে দরজায় ছিটকিনি খুলে দিলেই হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়ত ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। কে আগে নামবে তা নিয়ে হত আবার এক প্রস্থ ঠেলা-গুঁতো। যারা দরজার মুখে বসত তারা সব সময় একটা পা দরজার দিকে এগিয়ে রাখত। ছিটকিনি খুলতেই দরজায় মাথা গলিয়ে লাফ নিয়ে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে।
তবে স্কুল যাওয়ার থেকে আসার আনন্দটাই যেন বেশি ছিল। গাড়ির ভিতরে তখন কত রকমের খেলা! ‘চোর-ডাকাত-বাবু-পুলিশ’ থেকে শুরু করে ‘আবর-ডাবর-ঘি-কচুড়ি’, ‘ফুলফল-নাম-দেশ’, ‘বুক ক্রিকেট’, ‘রস-কস-শিঙারা-বুলবুলি-মস্তক’—কোনও কিছুই বাদ যেত না। একটু বড় হলে ‘অন্তক্ষরী’। বন্ধুদের মিমিক্রি করা থেকে হঠাৎ করে অন্যের মাথায় ‘চাটা’ লাগানো ও তা নিয়ে হাসি-মস্করা করাই ছিল সে সময়ের মণি-মুক্ত। আনন্দের খোরাক। আজ আর সে সব দিন কোথায়? এখন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের দাপাদাপি আর পুল-কারের একচেটিয়া প্রাধান্য খাঁচা-গাড়িকে বে-ঘর করে ছেড়েছে। সবই এখন স্মৃতি। পিছনে ফেলে আসা ঘটনা।
ক্লাস-ঘরে সারিবদ্ধ বেঞ্চ। তার উপরে সাদা বাক্সের সারি—বেঞ্চ প্রতি চার থেকে পাঁচটি। মাঝে মধ্যে গুটিকয়েক ব্যাগ। তাও আবার চটের, খাকি রঙের। পিঠ ব্যাগ। তার পাশেই শোভা পেত অ্যালমিনিয়ামের বাক্স। ঠিক বড় টিনের বাক্সের মতো। তবে তার মিনিয়েচার ফর্ম। কারও বাক্সে আবার ছোট্ট তালা লাগানো। তালা ঝুলছে বাক্সে। চাবি পকেটে। কোনও কোনও বাক্সের উপর আবার নাম খোদাই করা। বাক্সের ঢাকনা খুললেই দেখা মিলতো দেব-দেবীর ছবি। কারও বাক্সে ম্যানড্রেক, অরণ্যদেব তো কারও বাক্সে কপিলদেব, গাভসকর।
তার মধ্যে বই। বইয়ের এক পাশে পেন-পেন্সিল-রাবার। ছোট্ট হাতল লাগানো বাক্স হাতে যখন সবাই বাড়ি ফিরত, দারুণ দেখাতো। আমার পিঠে তখন খাকি চটের ব্যাগ। অবাক হয়ে চেয়ে থাকতাম বাক্সের দিকে। মনে মনে ও রকম একখানা বাক্স কত যে বাসনা করেছি, তা বলে বোঝানো যাবে না। এক দিন বাড়িতে বলেওছিলাম। কিন্তু বাক্সের চেয়ে ব্যাগের সুবিধা নাকি বেশি। বাক্স ওজনে ভারী, বইতে কষ্ট। তাই কিনে দিতে কেউ রাজি হয়নি সেদিন। না কিনলে শিশুমনের কষ্ট যে আরও বেশী ভারী, তখন তা কেউ বুঝতেও চায় নি। (চলবে)
শিক্ষক, মহাদেবানন্দ কলেজ
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy