ছবি: সংগৃহীত
ওরা আমায় প্রাণে মারেনি। কিন্তু আদৌ কি আমি বেঁচে আছি?” প্রশ্ন করেছিলেন রাজস্থাননিবাসী মধ্য-চল্লিশের কেশী চন্দনা। ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসের এক দুপুরে বাড়ি ফেরার সময় হঠাৎই জনা ত্রিশ গ্রামবাসী ও আত্মীয় কেশী দেবীর পথ আটকায়। সবাই মিলে চিৎকার করে তাঁকে ‘ডাইনি’ বলে ডাকতে থাকে। এর পর শুরু হয় অকথ্য শারীরিক অত্যাচার; তাঁকে নগ্ন করে, জুতোর মালা পরিয়ে ও মাথায় ভারী পাথর চাপিয়ে, গাধার পিঠে বসিয়ে সারা গ্রামে ঘোরানো হয়। অতঃপর সর্বসমক্ষে জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে মারার পূর্বমুহূর্তে পুলিশ এসে কেশী দেবীকে উদ্ধার করে।
ঠিক কী দোষ ছিল তাঁর? তা জানা যায়নি ওই ত্রিশ জনের মধ্যে এক জনের কাছ থেকেও। কিন্তু ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো থেকে এটা জানা যায় যে, ২০০০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে এ দেশে আড়াই হাজারেরও বেশি মানুষকে ডাইনি সন্দেহে, ভূতে ভর করার অপবাদে বা কুহকবিদ্যায় পারদর্শী সন্দেহে হত্যা করা হয়েছে; যার সিংহভাগই মহিলা। এই আড়াই হাজার সংখ্যাটা নেহাতই হিমশৈলের চূড়া। তথ্য বলছে, এই হত্যাকাণ্ডের বেশির ভাগটাই খাতায়-কলমে নথিবদ্ধ হয় না। ‘ডাইনি শিকার’ প্রতিরোধে এ দেশে জাতীয় স্তরে কোনও পৃথক ও সুনির্দিষ্ট আইন নেই। অন্য দিকে এই ধরনের ঘটনাগুলি মূলত দলগত ভাবে ঘটার ফলে, উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ মেলা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
তথ্যপ্রমাণ বলছে, কাউকে ডাইনি চিহ্নিত করে নির্যাতনের ঘটনা ঘটতে পারে সম্পূর্ণ আকস্মিক ভাবে, আবার দীর্ঘ দিনের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনামাফিক। এক দিকে যেমন দরিদ্র, অশিক্ষিত ও পিছিয়ে পড়া সংস্কারপন্থী সমাজেই এমন ঘটনা বেশি ঘটে, তেমনই মহামারি বা আর্থসামাজিক অস্থিতাবস্থার সঙ্গেও বিষয়টি অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত। অর্থনীতিবিদ এস্থার দুফলো দেখিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গেই আর্থিক দুরবস্থার সময় ‘ডাইনি’ সন্দেহে বয়স্ক মহিলাদের ওপর অত্যাচার ও প্রাণহানির ঘটনা বৃদ্ধি পায়।
পাশাপাশি দেখা গিয়েছে, এই ডাইনি শিকারের বিষয়টি একটি সামাজিক ব্যাধির মতো। অর্থাৎ, যে সব অঞ্চলে এই ব্যাধিটি এক বার ছড়িয়ে পড়েছে, মূলত সে সব অঞ্চলেই যুগের পর যুগ এই ধরনের ঘটনাপ্রবাহ চলতে থাকে। বিহার, রাজস্থান, ঝাড়খণ্ড, অসম, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, গুজরাত, মহারাষ্ট্র ও পশ্চিমবঙ্গ এর মধ্যে অন্যতম।
ইউরোপে ডাইনি-নিধনের উৎপত্তি খ্রিস্টপূর্ব ৪৫১-এ। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩১-এ রোমে মহামারি দেখা দিলে একসঙ্গে ১৭০ জন মহিলাকে ‘ডাইনি’ সন্দেহে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তার প্রায় দুই সহস্রাব্দ পরে, ১৪৫০ থেকে ১৭৫০ সালের মধ্যে রোম, ফ্রান্স, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলিতে এবং মধ্য, পশ্চিম ও দক্ষিণ ইউরোপ মিলিয়ে মোট পঁয়ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষকে অনুরূপ কারণে হত্যা করা হয়। সে দিক থেকে দেখতে গেলে, ভারতে বরং ডাইনি শিকারের প্রথম নথিবদ্ধ প্রমাণ পাই অপেক্ষাকৃত সমসাময়িক কালে— ১৭৯২ সালে, এক আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মধ্যে। তবে নিষ্ঠুরতা ও অত্যাচারের মাত্রায় তা পশ্চিমি দেশগুলিকেও পিছনে ফেলে দেয়। এবং, পশ্চিমি দেশগুলি যেখানে ক্রমশ এই সামাজিক অভিশাপকে অতিক্রম করতে সফল হচ্ছে, সেখানে ভারতে একের পর এক ডাইনি শিকারের ঘটনা ঘটেই চলেছে। গত জানুয়ারিতেই ঝাড়খণ্ডে এক পঁয়ষট্টি বছর বয়সি প্রৌঢ়াকে ডাইনি সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়েছে।
যুক্তিতে না পেরে, বা আক্রোশের বশে সমাজ মহিলাদের ‘ডাইনি’ সাব্যস্ত করে। সুশান্ত সিংহের মৃত্যুর পর, নেটিজ়েনরা তাঁর বান্ধবী রিয়া চক্রবর্তীকে সে মৃত্যুর জন্য দায়ী করে; তাঁকে ‘কুহকময়ী’ বা ‘কালাজাদুতে সিদ্ধহস্তা’ বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় ওঠে। কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় সব বাঙালি মহিলাকেই। বিশ্লেষণ করা হয়, কী ভাবে যুগের পর যুগ ধরে বাংলার সমাজব্যবস্থা বাঙালি মেয়েদের ডাইনিবিদ্যা চর্চায় পারদর্শী হয়ে ওঠার সহায়ক হয়েছে! নিষ্ফল আক্রোশ কী বিচিত্রপথগামী!
এ দেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষের নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহারের সামর্থ্য নেই। অর্থাৎ, এই ভার্চুয়াল সালিশিসভার সদস্যরা মোটের ওপর সমাজের অপেক্ষাকৃত বিত্তবান ও ‘শিক্ষিত’ সম্প্রদায়। আরও লক্ষণীয়, মহিলারাও কিন্তু রিয়াকে ডাইনি সাব্যস্ত করতে পিছপা নন। সমাজতাত্ত্বিকরা বলবেন, মহিলারা বিশ্বাস করেন যে তাঁর অস্তিত্ব, চরিত্র ও মর্যাদা ব্যক্তিসত্তানির্ভর নয়। এই স্বতন্ত্র ব্যক্তি-পরিচয়হীনতাই নারীকে আজীবন অন্যের ব্যর্থতার কারণ ও অপরাধের ভাগিদার করে তুলেছে। সফল ও স্বনির্ভর মহিলাদের বিশেষ ভাবে লক্ষ্যবস্তু করে তাঁদের ‘ডাইনি’ বলে দাগিয়ে দিয়েছে।
পঞ্চদশ শতকের বিপ্লবী ও সুযোদ্ধা, মাত্র উনিশ বছর বয়সি জোন অব আর্ক, আর একুশ শতকের ভারতের স্বতন্ত্র জমির মালিক ষাটোর্ধ্ব বিধবা গুলাবি কুমাওয়াত মিলে যান এখানেই। সমাজ ও সিস্টেম যূথবদ্ধ ভাবে তাঁদের কলঙ্কিত করে, ডাইনি সন্দেহে হত্যা করে। যে যুদ্ধ যুক্তিতে, আইনে, এমনকি গায়ের জোরেও জেতা যায় না, অতিপ্রাকৃতিক দোষারোপই সে যুদ্ধ জয়ের সহজতম পথ।
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy