ভূমধ্যসাগর, ইজিয়ান সাগর ও কৃষ্ণসাগরে ঘেরা তুরস্ক আনাতোলিয়ান সভ্যতার স্বাক্ষরবাহী। তার উপরে আছে আসিরীয়, গ্রিক, আর্মেনিয়ান, রোমান ও বাইজ়েন্টাইন সংস্কৃতির ছাপও। একাদশ শতকে সেলজুক সুলতানদের ও চতুর্দশ শতকে অটোমানদের দখলে আসে তুরস্ক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোমানদের কুশাসনের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন তুরস্কবাসী, নেতৃত্ব দেন কামাল ‘আতাতুর্ক’ পাশা।
কামাল পাশার প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শাসন বহু বার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ২০১৬-র ১৫ জুলাই রক্ষণশীলদের উস্কানিতে গোপন সামরিক অভিযান দমন করেছিল সরকার। তার মাত্র চার বছরের মাথায় আইন করে আয়া সোফিয়া মিউজ়িয়ামকে মসজিদে রূপান্তরিত করা হল। জনমত কি বদলে গেল এর মধ্যেই? না কি আতাতুর্ক প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষায় ক্লান্ত তুরস্কবাসী দুর্বল হয়ে পড়েছে?
প্রকৃতি এখানে এশিয়া আর ইউরোপকে পৃথক করে রেখেছে বসফরাস প্রণালী দিয়ে। দু’পাশে ধরা ইতিহাস। পশ্চিমে একের পর এক বিখ্যাত মসজিদ, স্টেডিয়াম, মিউজ়িয়াম, প্রাসাদ হোটেল, প্রাচীন দুর্গ। পুবে এশিয়ার ধার ঘেঁষেও রাজপ্রাসাদ, দুর্গ, মসজিদ, আধুনিক স্থাপত্যের সম্ভার।
কামাল পাশার ধর্মনিরপেক্ষ, গণতন্ত্রবাদী তুরস্ক মানবতাকে স্থান দিয়েছিল সবার উপরে। যে পঁচিশ ভাগ ইউরোপ তুরস্কে আছে, তার বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিকতা কামাল পাশাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ধর্মীয় অন্ধকার থেকে মুক্তিও এই বৈজ্ঞানিক চিত্তবৃত্তির জোরেই। ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কে লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে কয়েকটি পদক্ষেপ করা হয়। মহিলাদের বাধ্যতামূলক মুখাবরণ থেকে নিষ্কৃতি, মুক্তমনে সন্তান পালনের যথোচিত শিক্ষা, নারীর সঙ্গে একত্রে কাজ করতে পুরুষদের মানসিকতা পরিবর্তনের ডাক, আইনসভায় মহিলাদের যোগদান ও ভোট দেওয়ার ক্ষমতা ইত্যাদি। বৃত্তিমূলক ও বেতনহীন শিক্ষা চালু হয়। হাজার হাজার বছর ধরে প্রবাহিত সংস্কৃতিকে জনসম্মুখে আনতে তৈরি হয় মিউজ়িয়াম।
এই উদারনৈতিকতারই উজ্জ্বল নিদর্শন আয়া সোফিয়া। ৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে গোঁড়া গ্রিক খ্রিস্টান চার্চের তৈরি, জ্ঞানের দেবতা লোগোসের প্রতি উৎসর্গীকৃত এই স্থাপত্য। পঞ্চদশ শতকে অটোমানরা জিশু, মেরি-সহ বহু সন্তের মোজ়াইক পেন্টিং ও মূর্তির বিপুল ক্ষতি করে একে মসজিদে পরিণত করে। তৈরি হয় মিনার, মাজার-সহ মসজিদের নানা স্থাপত্যও। রক্ষিত অবশিষ্টাংশের প্রতি শ্রদ্ধায় আয়া সোফিয়া হয়ে উঠেছিল ধর্মনিরপেক্ষ এক প্রদর্শশালা। দুই ধর্ম সম্প্রদায়েরই নিদর্শন সুরক্ষিত ছিল এখানে। সেই মিউজ়িয়ামই রেজেপ তাইপ এর্দোয়ানের হাতে মসজিদ হল। এটা ঠিক যে ২০০২ সালে বিপুল ভোটে জয়ী বর্তমান শাসক আতাতুর্কের আপাত প্রশংসা করলেও তারই ছত্রচ্ছায়ায় বেড়েছে উগ্র ধর্মবিশ্বাসীদের প্রভাব। তুরস্কে এখনও পর্যন্ত যা কিছু ঘটে চলেছে তা থেকে অনুমান করা চলে যে জনমানসে বিভেদ এখনও দানা বাঁধেনি, সরকার থেকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার সব চেষ্টাই হচ্ছে মানুষের আবেগ মেপে। পনেরো বছর ধরে এর্দোয়ানের দল চুপ থাকার পর এখন তাদের আসল উদ্দেশ্য প্রকাশ করছে। মহিলাদের মাথায় স্কার্ফের ব্যবহার ফিরে এসেছে, ধর্মীয় শিক্ষায় প্রচুর অর্থ ঢালা হচ্ছে। জার্মানির ক্রিশ্চান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অনুকরণে বলা হচ্ছে তুর্কিরা মুসলিম ডেমোক্র্যাট।
তৃতীয় শতকের কনস্ট্যান্টিনোপলে নির্মিত হয় বিশাল স্টেডিয়াম হিপোড্রোম। সম্রাট কনস্ট্যান্টাইন প্রাচীন মিশর ও গ্রিস থেকে কিছু স্মৃতিস্তম্ভ এনে স্থাপন করেছিলেন। অটোমান রাজত্বে এ সব ধ্বংস করে হিপোড্রোম নাম পাল্টে সুলতান আহমেদ স্কোয়ার রাখা হয়। স্তম্ভগুলো পরে পুনঃস্থাপন করা হয়। কনস্ট্যান্টিনোপল জয়ের পর অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ পঞ্চদশ শতকে তৈরি করেন বিখ্যাত টোপকাপি প্যালেস। বিশাল এই প্রাসাদে প্রশাসক ও সেনাপ্রধানদের শিক্ষাকেন্দ্র ছিল, হারেমে ছিল চারশো ঘর। ১৮৫৬ সালে প্রাসাদ পরিত্যক্ত হয়, ১৯২৪-এ আতাতুর্ক এটিকেও মিউজ়িয়াম করে দেন।
প্রাচীন কালে উপাস্য দেবতার জন্যে তৈরি হত দেবালয়, বড় বড় স্তম্ভযুক্ত প্রাসাদোপম বাড়ি। নির্মাতাদের সংস্কার ও বিশ্বাস ছিল সেই সময়ের লোকাচারমুখী। আজ আমরা সে সব দেখে মুগ্ধ হতে পারি, কিন্তু প্রাচীন বিশ্বাসকে আজকের দিনে চালাবার চেষ্টা করলে সংঘাত অবশ্যম্ভাবী। ধর্মের সাম্প্রদায়িক রূপটিও সে কালের, আজকের রাষ্ট্রীয় শাসনের মাধ্যমে তাকে জোর করে চালানোর চেষ্টা হলে দেশ ও সমাজের অগ্রগতি ব্যাহত হতে বাধ্য। ইতিহাস দেখিয়েছে, সাম্প্রদায়িক ভাব মানুষকে হিংস্র করে তোলে। মানবতাকে টিকিয়ে রাখতে যে কোনও দেশেই সংখ্যাগুরুর দায়িত্ব অনেক।
আঙ্কারার দক্ষিণে আছে সুফি কবি জালালউদ্দিন রুমির সমাধিমন্দির। মানবতাকে সবার উপরে স্থান দিয়েছিলেন এই মরমি কবি। একই আদর্শে কামাল পাশা চেয়েছিলেন এক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। মানবতার হনন কি আজকের তুরস্কবাসী মেনে নেবেন? সেই দিকে তাকিয়ে বিশ্ব। ভারতও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy