গত প্রায় চার মাস ধরে করোনা ভাইরাসের আক্রমণ আর তজ্জনিত লকডাউনে সারা পৃথিবীর সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এতখানি ব্যাপ্তির আতঙ্ক এত দিন ধরে সভ্য সমাজকে শাসন করছে— এ যেন আমাদের সব যুদ্ধকল্পনার বাইরে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে যদি মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক জলবিভাজিকা বলে ধরা হয়, এই কোভিড-১৯’ও তাই। কোভিড-পরবর্তী বিশ্ব আর কখনও, এমনকি মানসিক ভাবেও, আগেকার অবস্থায় ফিরে যাবে বলে মনে হয় না। করোনার টিকা কবে আবিষ্কার হবে, কবে তা প্রচলিত হবে মানবসমাজের সর্ব স্তরে, তত দিনে ‘করোনাতর’ কোনও ভাইরাস মানুষের শরীর ও জীবনে ছড়িয়ে পড়বে কি না— এ সব প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর বোধ হয় কারও কাছেই নেই। উত্তর না থাকলেও, কিছু সম্ভাবনার কথা কিন্তু বিজ্ঞানীরা অনেকেই বলছেন।
বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদ মহলের বড় অংশ মনে করছেন, বর্তমান সঙ্কট মানুষের ‘অগ্রগমন প্রচেষ্টা’-র অবশ্যম্ভাবী ফল। বহু আলোচনায় বলা হয়েছে, পৃথিবীর অন্যদের মতো মানুষও প্রকৃতির অনেকগুলি প্রাণ-ব্যবস্থারই একটি। বাঁচতে হলে, মানুষকে প্রকৃতির নিয়মের মধ্যে ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের উপর নির্ভর করেই বাঁচতে হবে। অথচ সভ্য মানুষ নিত্যনিয়ত বিপজ্জনক ভাবে সেই ভারসাম্যের সীমা লঙ্ঘন করছে। অন্য প্রাণীদের অধিকাংশের স্বাভাবিক বসত যে জঙ্গল, চূড়ান্ত অবিমৃশ্যকারিতায় মানুষ তাকে ধ্বংস করেছে। কেবল গত দশ বছরের মধ্যে সারা পৃথিবীতে যে পরিমাণ ঘন অরণ্য ধ্বংস করা হয়েছে, তার পরিমাণ আগের ৫০০ বছরে নষ্ট করা বনের মোট পরিমাণের চেয়েও অনেক বেশি! সেই অরণ্যভূমিতে বসবাসকারী প্রাণিকুল, বিশেষত ‘প্রাইমেট’ বা বাঁদর-গোষ্ঠীভুক্তদের শরীরে বহু কাল ধরে থাকা জীবাণু ও ভাইরাসরা আশ্রয় হারিয়ে অন্য নিরাপদ অবলম্বন খুঁজছে, আর মানুষের শরীরেই বাসা বাঁধছে! কোভিড-১৯’ই প্রথম নয়। এইচআইভি, ইবোলা, সার্স ইত্যাদিরাও এই পথেই মানুষের শরীরকে বসতি করেছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ অরণ্যের ধ্বংস আর কিছু মানুষের মাত্রাহীন, নিরর্থক লোভ। গত ১০০ বছরে প্রাইমেটদের সংখ্যা নেমে এসেছে এক-দশমাংশে। এই অকল্পনীয় ভারসাম্যহীনতা কি কখনও খেয়াল করেছি আমরা? অথচ, আমাদেরই আশেপাশে এই রকম ঘটনা ঘটেই চলেছে আর এই প্রচণ্ড অস্বাভাবিক পরিস্থিতির অজানিত শিকার হয়েই আমরা বেঁচে আছি!
কথাগুলো এই মুহূর্তে আবার বলার প্রসঙ্গ এল কেন? কারণ, বীরভূম জেলার পাথর-অঞ্চল মহম্মদবাজার ব্লকের পাঁচামি আর ডেউচাতে ভূপৃষ্ঠের অনেক নীচে যে কয়লার ভান্ডার আছে, খোলামুখ খনি প্রকল্পে তাকে উপরে তুলে আনার উদ্যোগ শুরু হয়েছে। দেড় বছর ধরে এই প্রকল্পটি নিয়ে নানা সম্ভাবনার জনরব বাতাসে উড়ছিল। কিন্তু সদ্য ৯ জুলাই, অঞ্চলের একটি স্কুলে রাজ্যের মুখ্যসচিব রাজীব সিংহ এলাকার লোকজনের সঙ্গে, জনজাতির মানুষের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলে এসেছেন। অর্থাৎ, প্রকল্পের কাজ আর সম্ভাবনার স্তরে নেই, বাস্তবে শুরু হতে চলেছে। সরকারের তরফ থেকেও অস্পষ্টতা রাখা হয়নি। জানানো হয়েছে, রাজ্যের বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের এই খনি প্রকল্পের জন্য প্রথম অবস্থায় প্রায় ১,১০০ একর জমির দখল নেওয়া হবে। এই জমির মধ্যে তালবাঁধ, নিশ্চিন্তপুরের মতো কিছু জায়গা এখনও গভীর জঙ্গল। খোলামুখ খনি প্রকল্প শুরু করার জন্য প্রথমে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের জঙ্গল কেটে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে হয়। তার পর কেটে ফেলে দেওয়া হয় ভূপৃষ্ঠের ‘টপ সয়েল’। সেই কেটে তুলে ফেলা মাটি-পাথর-কাঁকর জমে যে পর্বত গড়ে তোলে, তাই হল ‘খোলা খাদ খনি’-র প্রতীক। বহু দূর থেকেও দেখা যায় তাকে। তার উপর নরকরোটি ও হাড় আঁকা থাকে না ঠিকই। তবে, থাকলে সত্যের অপলাপ হত না।
এখনও পর্যন্ত জানা গিয়েছে যে এই অঞ্চলে ৩০টির মতো জনজাতি-অধ্যুষিত গ্রামের আড়াই-তিন হাজার বাসিন্দাকে উচ্ছেদ হতে হবে। মুখ্যসচিব আশ্বাস দিলেন, উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের প্রত্যেককেই পুনর্বাসন দেওয়া হবে। এই বৈঠক সরকারি কোনও জনশুনানির অংশ কি না, জানা নেই। কিন্তু জনজাতির একটি বড় অংশ যে অর্থ বা পুনর্বাসনের আশ্বাসে নিজেদের এলাকা ছাড়তে আগ্রহী নন— সে কথা মুখ্যসচিবের কাছে তাঁরা গোপন করেননি।
সাঁওতালি ভাষায় ‘বির’ শব্দের অর্থ নাকি জঙ্গল। ‘বীরভূম’ শব্দটির মানে তাই জঙ্গলের দেশ। পশ্চিমবঙ্গের সমতলে সুন্দরবনের অল্প বনাঞ্চল বাদ দিলে শেষ প্রাচীন অরণ্যভূমিটি টিকে আছে কেবল বীরভূম ও তৎসংলগ্ন কিছু এলাকায়। মাটির গভীরে প্রোথিত কয়লা ভান্ডার উত্তোলনের কারণে সেই বন, তার মাটি, জলধারা, জনজাতির সমাজ ধ্বংসের কী পরিণাম হতে পারে, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। কারণ, সারা দেশে এই ধরনের উন্নয়ন প্রচেষ্টার ফল আমাদের চোখের সামনেই রয়েছে। এবং তা খুব কল্যাণমূলক নয়। কারণ যা-ই হোক, এত বড় সংখ্যায় জনজাতির মানুষ এবং অন্য গ্রামীণদের উচ্ছেদ করা সঙ্গত কি না, সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
আরও বড় একটি সমস্যা আছে। তার সঙ্গে গোটা মানবজাতিই জড়িত। মানবসমাজের প্রাকৃতিক সুরক্ষার অধিকারটিও কিন্তু উপেক্ষিত হতে চলেছে। শোনা যায়, বীরভূমে মাটির নীচে সঞ্চিত কয়লার পরিমাণ বিশাল। প্রায় হাজার একর মাটি খুঁড়ে সেই কয়লা নিষ্কাশনের প্রকাণ্ড প্রকল্প গৃহীত হতে চলেছে। এই কয়লা দহনের অর্থ, বায়ুমণ্ডলে আরও কার্বন ডাই-অক্সাইড মিশবে। ফল আরও উষ্ণায়ন। মানবজাতিকে আরও বিপন্নতার দিকে, আরও অসুস্থতার দিকে, আরও বেশি প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। সমস্ত বিশ্ব আজ জীবাশ্ম জ্বালানির বিরোধিতা করে নিজেদের অস্তিত্ব নিরাপদ রাখতে চাইছে। কেন তখন আমরা ঘরের দরজায় এই গণচিতার আয়োজন করব?
যখনই এ ধরনের বিনষ্টিমূলক বৃহৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, যুক্তি হিসেবে প্রথমেই কর্মসংস্থানের কথা বলা হয়। বীরভূমে সে কথা বলা যাবে না। আলোচ্য অঞ্চলটিতে গত ৩০-৪০ বছর পাথর খাদান রয়েছে। খনির কাজের সঙ্গে ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনের লাভ-ক্ষতি কতটা জড়িয়ে, স্থানীয়দের তা ভালই জানা আছে। তা ছাড়া, এত বৃহৎ প্রকল্প মূলত কল্পনাতীত খরচে কিনে আনা বিদেশি যন্ত্রপাতির সাহায্যে চালানো হয়। মানুষের শারীরিক পরিশ্রমের ভূমিকা সেখানে যৎসামান্য। আর একটি যুক্তি দেওয়া হয়। তা হল আর্থিক সুবিধা। আমরা কি এতখানি বিবেকহীন? মাটির উপরে স্থিত এত প্রাচীন জঙ্গল, পুরনো গ্রাম, হাজার হাজার মানু্ষ, সর্বোপরি একটি বিশাল বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংস করার বিনিময়ে অর্থাগম চাইব? আর যদি চাই-ও, কোন কাজে সেই অর্থ ব্যবহৃত হবে— সেই প্রশ্ন কিন্তু রয়েই যায়।
বীরভূমের জঙ্গল চেঁচে ফেলা, জলহীন করে দেওয়া, ন্যূনতম হাজার একর জমিকে খোলামুখ গভীর খাদানে পরিণত করার প্রভাব কেবল বীরভূমেই আটকে থাকবে না। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের আবহাওয়া এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের কল্পনাতীত ক্ষতি করবে। মাটির নীচের সম্পদ তুলে এনে ভূপৃষ্ঠকে বিপন্ন করার মূল্যে যে অর্থাগম হবে, ভবিষ্যতে করোনা-র চেয়ে আরও অনেক ভয়ানক কোনও রোগ সংক্রমণের প্রতিকার কিংবা কোনও ‘তিন বছরের লকডাউন’-এর আর্থিক ধাক্কা সামলানোর কাজেই কি তা ব্যয় করতে হবে?
একচক্ষু হরিণের মতো আমরা শুধু উন্নয়নের উজ্জ্বল দিকগুলি দেখে এসেছি। প্রকৃতি ক্রমশ কঠিন থেকে আরও কঠিন সঙ্কেত দিচ্ছে, সেটি বুঝেই নিজেদের পদক্ষেপ হিসেব করতে হবে। এই হিসেবে মনোযোগ দেওয়া বোধ হয় অসঙ্গত হবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy