সাড়ে চার বছরে চার-চারটে দেশজোড়া ভোট— যার তিনটে সাধারণ নির্বাচন আর অন্যটা ব্রেক্সিট গণভোট। ব্রিটেনের সবেতেই যেন শুধুমাত্র ব্রেক্সিট নামের এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আবছায়া।
গত শতকের পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকেও ইউরোপিয়ান ইকনমিক কমিউনিটিতে (ইইসি) ব্রিটেনের যোগ দেওয়া নিয়ে বিস্তর চাপান-উতোর চলেছে। শেষে ১৯৭৩ সালে ইইসি-তে যোগ দেয় ব্রিটেন। ১৯৭৫-এ হয় দেশজোড়া এক গণভোট। সে বার অবশ্য দুই-তৃতীয়াংশ জনতা মত দেয় ইইসি-তে থেকে যাওয়ার পক্ষে। এটাকেই আমি প্রথম ব্রেক্সিট ভোট বলতে চাই। ২০১৬ সালে হল দ্বিতীয় ব্রেক্সিট ভোট। নামমাত্র ব্যবধানে ব্রেক্সিটের জয়ের মধ্য দিয়ে জনতার সিদ্ধান্তহীনতা যেখানে স্পষ্ট।
২০১৯-এর অকাল-নির্বাচনের প্রেক্ষিত অনেকটা ভিনসেন্ট প্লুচা-র ২০১৮-র উপন্যাস ‘ব্রেক্সিট এক্সএক্সএল’-এর মতো। ২০২২-এর সাধারণ নির্বাচনের প্রেক্ষিতে লেখা উপন্যাসটিতে ২০১৮ সালেই ব্রিটেন ইইউ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। অনেক আলোচনার শেষে প্রধানমন্ত্রী ট্রেসি মেলার বেছে নিয়েছেন সবচেয়ে আকর্ষক ‘ডিল’— এক্সএক্সএল (থার্টি)। ফলে ২০২২-এ ব্রিটেনের অর্থনীতি, আর্থিক পরিস্থিতি, চাকরির বাজার বিপর্যয়ের মুখে। স্কটল্যান্ডের উপর ওয়েস্টমিনস্টারের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই আলগা। বিরোধী লেবার পার্টির জনপ্রিয়তাও বেড়েছে। এই গল্পের ট্রেসি মেলার নিঃসন্দেহে টেরিজা মে। প্লুচা ভাবতে পারেননি, অচিরেই ব্রেক্সিট গিলে খাবে মে-র রাজনৈতিক জীবন। এমনকি পরিবর্তে ক্ষমতায় আসা বরিস জনসনও হারিয়ে ফেলবেন গরিষ্ঠতা। এবং কেউই বোধ করি ভাবেননি, ইউরোপ ছেড়ে বেরোনোটাই খুব কঠিন হবে ব্রিটেনের পক্ষে।
বিয়ের আগেই কিন্তু ডিভোর্সের চিন্তা করেছে ব্রিটিশরা। ১৯৭৩-এ ব্রিটেন ইইসি-তে যোগ দেয়। তারও আগে লেখা ড্যাফনে ডু মোরিয়ের ১৯৭২-এর উপন্যাস ‘রুল ব্রিটানিয়া’তে দেখি, ইউরোপিয়ান কমন মার্কেটে যোগ দেওয়ার পরে পরেই এক গণভোটে ‘কমন মার্কেট’ ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ব্রিটেন। ব্রেক্সিট তাই কোথাও যেন সম্পৃক্ত হয়েই ছিল ব্রিটিশ চরিত্রে, তার মানসিকতায়, চিন্তায়, হয়তো বা স্বপ্নেও। কেবল, সেই ডিভোর্সটা যে খুব সহজে হবে না, এই ধারণাটা ছিল না প্রায় কারও।
ব্রেক্সিট নিয়ে ব্রিটেনে যে সামাজিক-রাজনৈতিক বিমূঢ়তা, তা থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন প্রবল রাজনৈতিক তাড়না, উদ্দাম গতি। যেমন হয়তো বরিস জনসনের মতো কাউকে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে জিতিয়ে আনা, যাঁর রাজনৈতিক জীবনটাই এখন বাজি রাখা ব্রেক্সিটের পক্ষে। গরিষ্ঠতা পেলে যিনি ইউরোপের বাঁধন ছিঁড়ে বেরোবেনই। ভাল ‘ডিল’ পাওয়া যাক, আর না-ই যাক। অন্য উপায়, ব্রেক্সিটের উল্টো দিকে ছুট লাগানো। সে জন্যে বিপুল গরিষ্ঠতা দিয়ে জেতাতে হবে লেবার পার্টি, লিবারাল ডেমোক্র্যাট আর স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টিকে। যাতে হয় ব্রেক্সিট নিয়ে আর একখানা গণভোট। ২০১৬’র পর থেকে জনমত ক্রমেই ঢলে পড়েছে ব্রেক্সিটের বিপক্ষে। এই মুহূর্তে আবার গণভোট হলে তা ইউরোপে থেকে যাওয়ার পক্ষেই যাবে বলে ইঙ্গিত দিচ্ছে বিভিন্ন সংস্থার করা সমীক্ষা।
বহুদলীয় গণতন্ত্র, জটিল এবং মিশ্র জনবিন্যাস, ট্যাকটিক্যাল ভোট, এ সবই নানা ভাবে কঠিন করে তোলে নির্বাচনী ফলাফলের অনুমান। আবার কনজ়ারভেটিভ সমর্থকরা সাধারণত এই সব সমীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে খানিকটা অনিচ্ছুক। ফলে ওপিনিয়ন পোলগুলি অনেক সময় ভুল করে ঝুঁকে পড়ে তাদের বিরুদ্ধে। তাই এ বারের সমীক্ষাগুলিতে জনসন এগিয়ে থাকলেও তাকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে দ্বিধায় অনেকেই। ভোট এগিয়ে আসার সঙ্গে কনজ়ারভেটিভ আর লেবার পার্টির ভোটের পার্থক্য কমছে। সঙ্গে ২০১৭-র অভিজ্ঞতা। মিলেমিশে তাই অনিশ্চিতই থাকছে চূড়ান্ত ফল।
এ বারের ভোটেও যদি দ্বিধার প্রকাশ ঘটে একই ভাবে, ব্রেক্সিটকে ঘিরে ব্রিটেনের সমাজ-জীবনের অস্থিরতা চলতেই থাকবে। ইতিমধ্যেই দু’জন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক জীবনকে গিলেছে ব্রেক্সিট নামের এই কৃষ্ণগহ্বর। কে বলতে পারে, অচিরেই বরিস জনসনের নামও ঢুকতে পারে সেই তালিকায়।
অজস্র ব্রেক্সিট-কার্টুন আর মিমের মধ্যে একটা আমার বেশ পছন্দের। দুই অশীতিপর বৃদ্ধার এক জন অন্য জনকে বলছেন, ব্রেক্সিট তো আবার পিছানো হয়েছে। আবার কি গণভোট হবে মনে হয়? উত্তরে অন্য জন বলেন, তিনি চান আবার গণভোট হোক। আগের বার, অর্থাৎ ২০১৬-য়, খুব ছোট থাকার জন্যে ভোটাধিকার ছিল না তাঁর!
ব্রিটেনের এই সাধারণ নির্বাচনটা এই আপাত-বিমূঢ়তা থেকে দেশ এবং জনতা মুক্ত হতে পারবে কি না, তারই রেফারেন্ডাম। একটা সুযোগ। গোলকধাঁধা থেকে মুক্তির তাগিদ জনতারই। উপায়টাও জনতারই হাতে।
(ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা। মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy