Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
rape

ফাঁসি দিলে কি ধর্ষণ কমবে

সুপ্রিম কোর্টও মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়ার সময় এই ‘ডেটারেন্স’ বা প্রতিরোধী তত্ত্বকে সমর্থন করেছে। যদিও অধিকাংশ সময়ই তারা এই ব্যাপারে বিশেষজ্ঞের অভিমত এবং সমাজের চাহিদা বা জনমতের উপর নির্ভর করেছে।

রঞ্জিত শূর
শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০২
Share: Save:

নির্ভয়ার চার ধর্ষককে একসঙ্গে ফাঁসি দেবে ভারত সরকার। কঠিন-কঠোর সাজা দিয়ে ভবিষ্যতের ধর্ষকদের মনে ভয় ঢোকানোই এই ফাঁসির লক্ষ্য। আর কোনও দুষ্কৃতী ভবিষ্যতে যেন ধর্ষণ করার চিন্তাও মনে না জায়গা দেয়। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড কি সত্যিই ধর্ষণ বা নারী নির্যাতন কমাবে?

কঠোর সাজা অপরাধ কমায়, এই প্রতিরোধী (ডেটারেন্স) তত্ত্ব কতটা বিশ্বাসযোগ্য? ভারতের আইন কমিশনের ৩৫তম রিপোর্টে ১৯৬৭ সালে বলা হয়েছিল, হ্যাঁ মৃত্যুদণ্ড অপরাধ কমায় এই ধারণার মধ্যে সত্যতা আছে। যদিও একই সঙ্গে রিপোর্টে এটাও বলা হয়েছিল, এ ব্যাপারে নানা দেশের তথ্য পরিসংখ্যান পরস্পরবিরোধী। তাতে এটা প্রমাণ হয় না মৃত্যুদণ্ড অপরাধ কমায়। আবার কমায় না, এটাও প্রমাণ হয় না। কিন্তু সমাজের চিন্তক ও বিশিষ্টেরা এটাই মনে করেন যে মৃত্যুদণ্ড অপরাধ কমায়। তাঁদের এই চিন্তা কমিশনের কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টও মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়ার সময় এই ‘ডেটারেন্স’ বা প্রতিরোধী তত্ত্বকে সমর্থন করেছে। যদিও অধিকাংশ সময়ই তারা এই ব্যাপারে বিশেষজ্ঞের অভিমত এবং সমাজের চাহিদা বা জনমতের উপর নির্ভর করেছে।

২০১৫ সালে সর্বশেষ আইন কমিশন রিপোর্ট (রিপোর্ট নং ২৬২) কিন্তু মৃত্যুদণ্ড নিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলেছে। বিচারপতি এ পি শাহের নেতৃত্বাধীন আইন কমিশন স্পষ্ট বলেছে, পরিসংখ্যানবিদ, বিশেষজ্ঞ, তাত্ত্বিকদের বহু বছরের গবেষণা ও বিতর্কের পরে আজ এ বিষয়ে একটা মতৈক্যে পৌঁছনো গিয়েছে যে যাবজ্জীবন বন্দিত্বের চেয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশে সমাজে বাড়তি কোনও সুফল হয় না। গত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস ঘেঁটে, দেশের পর দেশের গবেষণা বিশ্লেষণ করে তাঁরা দেখিয়েছেন মৃত্যুদণ্ড ধর্ষণের বিরুদ্ধে কোনও বাড়তি প্রতিরোধ গড়ে তোলে না। রাষ্ট্রপুঞ্জ মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে প্রস্তাব নেওয়ার সময়ও বার বার বলেছে মৃত্যুদণ্ড বা ফাঁসির সাজা অপরাধ কমায়, এটা স্রেফ গল্পকথা বা মিথ। শেষ পর্যন্ত আইন কমিশন সন্ত্রাসবাদী অপরাধ ছাড়া আর সমস্ত ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড বিলোপের সুপারিশ করেছে। আইন কমিশনের অমূল্য এই রিপোর্টের সুপারিশ অবশ্য ভারত সরকার গ্রহণ করেনি। ঘোষিত ভাবে বর্জনও করেনি। কার্যক্ষেত্রে উল্টোটাই করছে। ২০০৪ সালে ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের ফাঁসির পর আট বছর এ দেশে ফাঁসি বন্ধ ছিল। কিন্তু তার পরে পর পর ফাঁসি দেওয়া হয়েছে আজমল কাসব (২০১২), আফজল গুরু (২০১৩) এবং ইয়াকুব মেমনকে (২০১৫)।

২০১২ সালে নির্ভয়ার ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার পর দেশব্যাপী প্রবল প্রতিক্রিয়ার মুখে ভারত সরকার এ ব্যাপারে নয়া আইন প্রণয়নের জন্য বিচারপতি জে এস বর্মার নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিশন বানিয়েছিল। ধর্ষণের অপরাধে কী সাজা সুপারিশ করেছে বর্মা কমিশন? ধর্ষণের অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের দাবিকে সরাসরি নস্যাৎ করেছে। কমিশনের মতে ধর্ষণের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিলে সেটা হবে একটা পশ্চাৎমুখী পদক্ষেপ। বর্মা কমিশনও বলেছে, অপরাধ প্রতিরোধের তত্ত্ব কেবল একটা উপকথা বা ‘মিথ’। মানবাধিকার সংগঠনগুলির দেওয়া তথ্য মেনে নিয়ে বর্মা কমিশন বলেছে, এ দেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া খুব কমে গেলেও হত্যা বা খুনের সংখ্যা কমেছে। অর্থাৎ খুনের মতো অপরাধ কমাতে ফাঁসির সংখ্যা বাড়াতে হয়নি। বর্মা কমিশন প্রবল চাপের মুখেও মৃত্যুদণ্ড সুপারিশ করেনি। বরং অপরাধ প্রমাণ হলে ধর্ষককে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কারাবন্দি রাখার সুপারিশ করেছে। বর্মা কমিশন স্পষ্ট করেছে, মৃত্যুদণ্ড দিলে খুন বা ধর্ষণের মতো অপরাধ কমে, না দিলে অপরাধ বাড়ে— এমন কোনও প্রমাণ তাঁরা পাননি।

বিচারপতি এ পি শাহের নেতৃত্বাধীন আইন কমিশন, এবং বিচারপতি জে এস বর্মার নেতৃত্বাধীন বর্মা কমিশন মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পিছনে জনমতের প্রভাবকে যুক্তি হিসেবে দেখানোর জন্য সুপ্রিম কোর্ট ও রাজনীতিকদের তীব্র সমালোচনা করেছে। বলেছে, তা হলে তো সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, পণপ্রথা বা অস্পৃশ্যতার মতো অপরাধ কোনও দিনই সমাজ থেকে লুপ্ত করার জন্য আইন করা যেত না। রাজনীতিকদের দায়িত্ব সঠিক মনোভাব বা জনমত তৈরি করা। প্রভাবিত হয়ে তাতে শামিল হওয়া নয়। আক্ষেপ, জনমত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যার, সেই সংবাদমাধ্যমও ধর্ষকদের ফাঁসির দাবিকে জোরদার ভাবে পেশ করে থাকে। সম্প্রতি হায়দরাবাদে এক তরুণীর ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে গ্রেফতার চার ব্যক্তিকে পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলার মতো জঘন্য ঘটনাকেও ‘উচিত শাস্তি’ বলে দেখাল অনেক চ্যানেল।

ন্যায়বিচারের জন্য সমাজের কান্নাকে মৃত্যুদণ্ডের অজুহাত করা, বা সে কান্নাকে থামানোর জন্য মৃত্যুদণ্ডকে ব্যবহার করা— কোনওটাই এ দেশের সেরা আইন বিশেষজ্ঞেরা সমর্থন করেননি।
ফাঁসির খবর দেখা ও পড়ার সময়ে সে কথাটা মনে রাখা চাই।

অন্য বিষয়গুলি:

Rape Death Penalty Capital Punishment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy