১৯১৮। স্প্যানিশ ফ্লু-এর মধ্যেই আমেরিকার মিড-টার্ম নির্বাচন। ভোটকর্মী আর ভোটার সবার জন্যই মাস্ক বাধ্যতামূলক। সান ফ্রানসিস্কো ক্রনিকল একে ‘আমেরিকার ইতিহাসের প্রথম মুখোশে আবৃত নির্বাচন’-এর তকমা দিল। শতাব্দী পেরিয়ে আবারও এখন মুখোশে-ঢাকা ভোটপর্ব। এ দেশে অতিমারির সঙ্গে নির্বাচনের প্রথম মেলবন্ধন হতে চলেছে বিহার বিধানসভা ভোট। করোনার আবহে ইতিমধ্যে অনেক দেশেই ভোট হয়েছে, পিছিয়েছেও। আমেরিকার নভেম্বরের নির্বাচন পিছোতে উৎসাহী ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, কিন্তু সংবিধান অনুসারে সেটা তাঁর ক্ষমতার বাইরে।
মৃত্যু, অসুস্থতা, সংক্রমণের ভয় প্রদত্ত ভোটের হার কমিয়ে দিতে পারে। প্রিয়জনকে হারিয়ে কিংবা ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে বহু মানুষের কাছেই ভোট দেওয়া প্রাধান্য পায় না। ১৯১৮-য় ভোট পড়েছিল মাত্র ৪০ শতাংশ, আগের বারের চেয়ে ১০ শতাংশ কম। পুরোটাই স্প্যানিশ ফ্লু-এর প্রভাব নয়, ২০ লক্ষ মার্কিন তখন যুদ্ধে ব্যস্ত।
করোনা-কালে ছবিটা অবশ্য মিশ্র। ক্রোয়েশিয়ার সাম্প্রতিক নির্বাচনে ভোটের হার ২০১৬-র চেয়ে কম, পোল্যান্ডে ২০১৫-র থেকে অনেকটা বেশি। ভোট শতাংশে বড় তারতম্য পাল্টে দিতে পারে ফল। আমেরিকায় ভোট শতাংশ বাড়ার সাধারণ অর্থ, বেশি সংখ্যায় ভোট দিয়েছেন অল্পবয়সি, অশ্বেতাঙ্গ ও অল্প রোজগেরে-রা। এঁরা মোটের ওপর ডেমোক্র্যাটদের সমর্থক। তবে, কম ভোট পড়া মানেই রিপাবলিকানদের পক্ষে ভাল নয়। কিছু সমীক্ষা অনুসারে, মার্কিন ভোটারদের ২৭ শতাংশ ৬৫-ঊর্ধ্ব, যাঁদের বেশির ভাগ রিপাবলিকান ভোটার। কোভিডে মৃত্যুর প্রায় ৮০ শতাংশই এই বয়সে। অতএব, এই বয়সি রিপাবলিকানদের ভোট কমবে।
আমেরিকায় ‘মেল-ইন’ পদ্ধতিতে, অর্থাৎ আগে থেকে পাঠানো ব্যালটে ভোট দিয়ে ডাকযোগে বা নির্দিষ্ট ড্রপ বক্সের মাধ্যমে পাঠানোর রেওয়াজ আছে। ২০১৬-তে প্রায় ২৩.৬ শতাংশ ভোট এ ভাবে পড়েছিল। অতিমারির আবহে সেই অনুপাতটা বাড়তে পারে। প্রমাদ গনছেন ট্রাম্প, ‘মেল-ইন’কে কারচুপির মাধ্যম বলতে ছাড়েননি। ও দিকে, দক্ষিণ কোরিয়ায় ‘আর্লি ভোটিং’ পদ্ধতির সুষ্ঠু প্রয়োগের ফলে ভোট দিয়েছেন ৬৬ শতাংশ নাগরিক, ২০১৬-তে যেখানে ভোট পড়েছিল ৫৮ শতাংশ। চার বছরে ‘আর্লি ভোটিং’ ১২ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৬ শতাংশ। ইন্টারনেটে প্রদত্ত ভোটের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় থাকলেও গত বছর এস্টোনিয়ায় ৪৪ শতাংশ ভোট পড়েছিল এ ভাবে। কোভিড-১৯ এমন বিকল্প পদ্ধতি নিয়ে ভাবনাচিন্তার পরিসর খুলে দেবে।
আমেরিকার ভোটের পাঁচ দিন পরেই মায়ানমারে ভোট। গণতন্ত্রে অনভ্যস্ত দেশে করোনা গুলিয়ে দিতে পারে প্রচার-পদ্ধতিও। আসলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির শিকড় যত গভীরে থাকে, বিপর্যয়কালীন ভোটের ঝড় সামলানো হয় ততই অনায়াসে।
অন্যান্য দেশের মতো ভার্চুয়াল সভার সংস্কৃতি শুরু হয়েছে ভারতেও। ১৯১৮-র সেই ভোটে জমায়েত নিয়ন্ত্রিত বা নিষিদ্ধ ছিল। তাই মিটিং-মিছিলের পরিবর্তে সংবাদপত্র বা ডাকযোগে পাঠানো প্রচার-পুস্তিকাই হয়ে ওঠে প্রধান মাধ্যম। আজ প্রধান হবে বৈদ্যুতিন প্রচার-মাধ্যম এবং আন্তর্জাল। ভোটের প্রচার পর্ব জমজমাট ভার্চুয়াল সভা আর সোশ্যাল মিডিয়ায়। অবশ্য এই প্রচারগুলি সমাজের সব স্তরে কতটা পৌঁছবে এবং প্রভাব ছড়াবে, সে এক জটিল জিজ্ঞাসা। বহুদলীয় গণতন্ত্রে ছোট দলগুলি অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়বে। আবার, গুজব ছড়ানোতেও সোশ্যাল মিডিয়া চ্যাম্পিয়ন হয়ে উঠেছে গত এক দশকে। ভোটের প্রচারে তা কতটা ম্যাজিক দেখাবে, তাকে কতটাই বা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, তা-ও অজানা।
শতাব্দীর ভয়ঙ্করতম বিপর্যয়ে পৃথিবী জুড়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থার কঙ্কাল বেরিয়ে পড়েছে; তলিয়ে যাচ্ছে জিডিপি, কাজ হারাচ্ছেন কোটি কোটি মানুষ, শিক্ষাব্যবস্থার নাভিশ্বাস— তবুও অতিমারির প্রেক্ষিতে যে সব ভোট হয়েছে, তাতে ক্ষমতাসীনকে পাল্টে ফেলার সাঙ্ঘাতিক তাড়না দেখা যায়নি। ভাইরাসের মোকাবিলা নিয়েই চলছে রাজনৈতিক প্রচার। এখানেই সমস্যায় পড়েছেন ট্রাম্প। প্রথমে তিনি করোনাকে ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। অনেকেই মনে করছেন, কোভিড সামলাতে ট্রাম্প ভয়াবহ ব্যর্থ। তাই, প্রাক্-করোনা পর্বে যে ট্রাম্প নিশ্চিন্ত ছিলেন, হিসেব-মতে তিনিই এখন পিছিয়ে। জো বাইডেনের ইউক্রেন-যোগ নিয়ে তত্ত্ব, মেক্সিকো সীমানায় পাঁচিল— কিছুই কি কাজে আসবে? অতিমারিই নিয়ন্ত্রণ করবে মার্কিন নির্বাচনকে। এতটাই যে, নির্বাচনের ঠিক আগে প্রশাসনের পক্ষে টিকার ঘোষণায় মরিয়া হয়ে ওঠাও সম্ভব বলে মনে করছেন অনেকে, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ না হলেও।
অরুন্ধতী রায় কোভিডকে বলেছেন ‘পোর্টাল’— এক থেকে অন্য পৃথিবীতে যাত্রাপথ। কোভিড বদলে দিচ্ছে জীবনযাপন। কতটা বদলাবে ভোট-সংস্কৃতি? ভার্চুয়াল সভা, ‘মেল-ইন’, ‘আর্লি ভোটিং’, এ সব কি দীর্ঘকালীন বদল, না কি তাৎক্ষণিক বাধ্যবাধ্যকতা?
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy