Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪

কিছু করা যায়, অনুপ্রেরণাহীন?

কেউ প্রেরণা না জোগালে কি ভাল কাজ করা যায় না কখনও? পুরপিতা, পুরমাতা, ছোট মাঝারি থেকে হেভিওয়েট যত মন্ত্রী আছেন এ রাজ্যে— তাঁরা কি উপরমহল থেকে অনুপ্রেরণা না পেলে নিজেরা কোনও সু-কাজ করতে পারেন না, নিজেদের উদ্যোগে?

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২০ ০০:৩৬
Share: Save:

হাসনাবাদের বিডিও অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের কথা শুনে (আবাপ, ২ ডিসেম্বর) সকালে স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্রে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবির সামনে দাঁড়ালাম। বাড়ির দেওয়ালে কোনও ছবি টাঙানো ছিল না। খবরের কাগজ ডাঁই করে রাখা থাকে যেখানে, সেখান থেকেই কাগজ টেনে নিলাম একটা, তাসের বান্ডিল থেকে কোনও একটা তাস টেনে নেওয়ার মতো। দুটো পাতা উল্টোতেই একটা বিশাল ছবি পেয়ে গেলাম। বিডিও সাহেবের কথামতো নিজেকে অদ্ভুত শক্তিতে রিচার্জ করার জন্য ইচ্ছে করছিল খুব। চোখ বুজলাম। যা দেখতে পেলাম, তা হল রাজপথ ধরে হনহন করে হেঁটে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ওঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে, যাবতীয় কাট আউট, ব্যানার, ফ্লেক্স, হোর্ডিং সমেত। মাথার উপরে মশার ঝাঁকের মতো পাঁচটা শব্দ ভন ভন করছে। ‘মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায়’। একটা শব্দ ঠোক্কর খাচ্ছে অন্য শব্দের সঙ্গে। তাও পড়ছে না কেউ। যেন শব্দের সার্কাস।

সরকারি প্রচারে গত পাঁচ-সাত বছরে সবচেয়ে বেশি যে শব্দটা ব্যবহার হয়েছে তা হল ‘অনুপ্রেরণা’। এই প্রেরণা-ব্যাঙ্কের স্বর্ণসিন্দুকের চাবি শুধু এক জনেরই কাছে। ভাবতে অবাক লাগে কোনও রক্ত মাংসের এক জন মানুষের এত অনুপ্রেরণা দেওয়ার সময় কোথায়। পুষ্পমেলা, খাদ্যমেলা, সঙ্গীতমেলা, পরিবেশ মেলা, মাটি উৎসব, আন্তঃপাড়া সারা রাত্রি ব্যাপী ফুটবল প্রতিযোগিতা, দিবারাত্রি ক্যারম টুর্নামেন্ট, শহরের যাবতীয় বাসস্ট্যান্ড, নতুন গড়ে ওঠা সুলভ শৌচালয়— অনুপ্রেরণা কোথায় নেই। এ তো অনেকটা জাদুকর পি সি সরকারের ‘ওয়াটার অব ইন্ডিয়া’ ম্যাজিকের মতো। পাত্রে জলের বদলে আছে অনুপ্রেরণা। যতই ঢেলে নেওয়া হোক না কেন, পাত্র আবার পূর্ণ হবে নিমেষে, এক অসীম জাদুবলে।

পাড়ার অলিতে গলিতে, গলির শুরুতে শেষে মাননীয়ার বিশাল বড় কাট আউট। দিদি, তুমি এগিয়ে চলো, আমরা তোমার সঙ্গে আছি। প্রণামরত রাজ্যের শীর্ষমন্ত্রী। তার তলায় ‘সৌজন্যে’ লিখে স্থানীয় কাউন্সিলারের নাম। প্রতি দশ ফুট অন্তর অনুপ্রেরণা-মাখা সরকারি প্রকল্পের বিজ্ঞাপন। প্লাস্টিক বন্ধ করতেও মন্ত্রীর অনুপ্রেরণা, ডেঙ্গি থেকে বাঁচতে মশারি টাঙানোর অনুরোধেও মন্ত্রীর অনুপ্রেরণা। অনুপ্রেরণা এনআরসি না হওয়ার বরাভয়ে, অনুপ্রেরণা রক্তদান শিবিরে। কোনও ক্লাবে হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ধনেও অনুপ্রেরণা। সঙ্গে প্রাপ্ত চেকের ব্লো-আপ ব্যানার। ‘চৌরাস্তার মোড়ে পার্কে দোকানে, শহরে গঞ্জে গ্রামে এখানে ওখানে’— অনুপ্রেরণা লুটোপুটি খাচ্ছে বঙ্গ চরাচরে। সারা রাজ্যে মোট কত লক্ষ শীর্ষমন্ত্রীর ছবি টাঙানো হয়েছে তার তালিকা করতে গেলে মাইক্রোসফট এক্সেলের রো আর কলাম হার মানবে। আর এই বিশাল তালিকায় কয়েক হাজার যোগ হচ্ছে প্রতি দিন। টেলিকম, গাড়ি গোল্লায় গেলেও ফ্লেক্স শিল্পের জয়ধ্বজা ঠেকায় এমন সাধ্য কার?

কেউ প্রেরণা না জোগালে কি ভাল কাজ করা যায় না কখনও? পুরপিতা, পুরমাতা, ছোট মাঝারি থেকে হেভিওয়েট যত মন্ত্রী আছেন এ রাজ্যে— তাঁরা কি উপরমহল থেকে অনুপ্রেরণা না পেলে নিজেরা কোনও সু-কাজ করতে পারেন না, নিজেদের উদ্যোগে? প্লাস্টিক ব্যবহার করা যে খারাপ, বাড়ির টবে জল যেন না জমে— এগুলো মানুষকে বোঝানোর জন্যও কি দরকার হয় কারও অনুপ্রেরণা? পাড়ায় পাড়ায় পুষ্পমেলায় চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়াও কি হাসবে অনুপ্রেরণা পেলে? অনুপ্রেরণায় ডিপ ফ্রাই করা হলে কি খাদ্যমেলায় চিকেন কবিরাজি আর ফিশ পকোড়া আরও মুচমুচে হয়? যদি না হয়, তা হলে এই অপপ্রয়োগ কেন?

কর্মণ্যেবাধিকারস্তে, শুধু কাজ করে যাও, মা ফলেষু কদাচন— এর যুগ আজ আর নেই। ভাল কাজ করার সঙ্গে তার প্রচারটাও যে সমান ভাবে জরুরি, তা আমাদের কর্পোরেট জীবনযাপন ঘাড়ে ধরে শিখিয়েছে। শেখাচ্ছে ভোট ব্যাঙ্কের রাজনীতিও। ইভিএম মেশিনের বোতাম টেপা তো আসলে জনপ্রতিনিধিদেরই অ্যাপ্রাইজ়াল রিপোর্ট। রেটিং কার্ড। ভাল কাজ করলে লোকজনদের তা জানাতে দোষ কী? যাঁদের বোতাম টিপে ক্ষমতায় আনি, তাঁরা নিজেরা নিজেদের উদ্যোগে যদি কোনও শুভ কাজ করেন, তা যেমন জানতে ভাল লাগে, দেখতেও ভাল লাগে ঠিক ততটাই। আত্মপ্রচারের শুরুতে বাধ্যতামূলক গৌরচন্দ্রিকার মতো সর্বময় কর্ত্রীর অনুপ্রেরণায় কথাগুলো কি না-লিখলেই নয়? তাতে কি কল্যাণমূলক কাজের সম্মানহানি হয়? হয়তো অলিখিত নির্দেশ আছে কিছু পর্দার ও-পারে। ভয়ও থাকতে পারে। জানি না।

আমরা কি আমাদের ভাল কাজগুলো দিয়ে, অন্তত ভাল কাজ করার ইচ্ছে দিয়ে কি নিজেদের রিচার্জ করতে পারি না রোজ? আত্মবিশ্বাস বলে যে স্বপ্ন-ভোমরা আছে আমাদের সবার মনে, নিজেরা, নিজেদের উদ্যোগে কিছু করে দেখাতে পারলে তো সেটাও পাখা মেলে। দিনে যে শ’খানেক ইমেল লিখতে হয় আমার ক্ষুদ্র পরিসরে, তার প্রতিটা যদি ‘মাননীয় সিইও সাহেবের অনুপ্রেরণায়’ লিখে শুরু করি, তা দেখতে ভাল লাগবে কি?

অন্য বিষয়গুলি:

Mamata Banerjee inspiration
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy