ছোটবেলায় লক্ষ্মীর পাঁচালিতে পড়েছিলাম ‘রসনার তৃপ্তি জন্য অভক্ষ্য ভক্ষণ, তারি লাগি কাল ব্যাধি অকাল মরণ’। এর মানে দাঁড়াল অন্তত তিনটে। এক, সুস্বাস্থ্য মানে যেন কেবল রোগভোগ আর প্রাণঘাতী অসুখ থেকে নিস্তার পাওয়া। অথচ বন্ধু পরিজনের সঙ্গে দেখা হলেই আমরা কুশল প্রশ্ন শুনে থাকি: ‘ভাল আছো তো?’ এই প্রশ্নের মধ্যে সর্বাঙ্গীণ ভাল থাকার, শারীরিক ও মানসিক ভাবে আনন্দে থাকার, এবং ঘরে-বাইরে কাজকর্মে লেগে থাকার যে স্বাস্থ্য-ভাবনার আভাস পাই, সেটা অনেক বেশি সামগ্রিক। ভাল-থাকার ধারণার এই বৃহত্তর অর্থটাকে মানুষের কাছে ও প্রশাসনিক স্তরে আরও পরিস্ফুট করা প্রয়োজন নয় কি? দেশের চারিদিকে এত অপুষ্টি, এত কৃশকায়তা, এত খর্বকায়তা, যার নিরিখে আমাদের দেশ এশিয়া এবং আফ্রিকার অনেক দেশের থেকে অনেক যোজন পিছিয়ে, এ যেন আমাদের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে।
নরওয়ের এক মন্ত্রী বলেছিলেন, শিক্ষা জনস্বাস্থ্য পরিবেশ পরিবহণ অর্থ ইত্যাদি দফতরই তাঁদের কাছে ‘স্বাস্থ্য দফতর’, আর এদের সব নীতি ও প্রকল্পই ‘স্বাস্থ্য নীতি’, কারণ মানুষের জীবন ও অস্তিত্বের উপর এগুলির নিজস্ব ও সম্মিলিত প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এই ব্যাপকতর স্বাস্থ্য-চেতনাকে সবার স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখি না কেন?
পাঁচালির দ্বিতীয় বার্তা: স্বাস্থ্যের বিপন্নতা যেন মূলত আমাদের ব্যক্তিগত আচরণের কুফল। ব্যক্তিগত দায়ের পাশাপাশি স্বাস্থ্যের সামাজিক চরিত্রের দিকটিও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্য-গবেষকেরা দেখিয়েছেন, ব্যক্তির স্বাস্থ্য-খেলাপ-করা, আপাত-অসংযমী ব্যবহারের পিছনে আছে জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণের অভাব, যার অনেকটাই তাঁর সামাজিক অবস্থান-সঞ্জাত। গ্রাসাচ্ছাদনের খোঁজে নিরন্তর ঘূর্ণমান মানুষের সুস্থ জীবন খোঁজার স্বাধীনতা কতটা আছে? আদরের নাতিকে একটা ছোট্ট উপহার কিনে দিয়ে এক গভীর সুস্থতা বোধ করার কতটুকু সুযোগ আছে এক জন নিঃসম্বল বৃদ্ধার? এমন বহু মানুষের ভগ্নস্বাস্থ্য আসলে সামাজিক অবস্থানেরই প্রতিফলন।
এই সামাজিক ব্যাধির নিরাময় কি শুধু ব্যক্তির হাতে? পাঁচালির তৃতীয় বার্তার অভিমুখ যেন সে দিকেই। ভেবে দেখুন, আমাদের স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রায় সিংহভাগই ব্যক্তিগত খরচায় কেনা। এখানেও কি এক ধরনের পণ্যমোহ কাজ করে না? স্বাস্থ্য পরিষেবার ‘বাজার’-এও আমরা কি বহু ক্ষেত্রেই বাজারি পরিষেবার ইচ্ছুক ক্রেতা? এই বদ্ধমূল ধারণার বশে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি যে, তা একেবারেই ফেলনা?
কলকাতার এক সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য টিকিট কাটবার লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের বাড়িতে দীর্ঘ কাল যাবৎ রান্নাবান্নার কাজ করে যে মেয়েটি জীবনের প্রায় সবচেয়ে মূল্যবান সময়টা দিয়ে দিয়েছে আমাদের জন্য, তার জটিল একটা অসুখের চিকিৎসার জন্য এখানে আসা। লাইনে বহু লোক, কে অন্যায় ভাবে আগে গেল বা লাইন ভেঙে ঢুকে পড়ল তা নিয়ে চলমান একটা বিবাদ এগিয়ে চলেছে লাইনের সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু তারই মধ্যে একটা সহযোগিতা, সহমর্মিতার ভাবও ছিল। দলে দলে এই যে এত লোক অবাধে ঢুকে পড়ছিল হাসপাতাল চত্বরে, এই প্রতিষ্ঠান যে সবার জন্য, কাউকে যে গেটে আটকে দেওয়ার নয়, সেই সর্বজনীনতার ছবিটা বলে দিচ্ছিল— এটাই বোধ হয় একাধারে যে কোনও সরকারি প্রতিষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য এবং দুর্বহ ভার।
আজ বিশ্ব জুড়ে, দেশ জুড়ে একটা ধারণা খুব ঘুরপাক খাচ্ছে যে, সরকারি পরিষেবা মানেই নিশ্চিত ভাবে অতি মন্দ। এই ধারণার সত্যাসত্য বিচারের দায় জলাঞ্জলি দিয়েই এটি প্রচার করা হচ্ছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই সরকারি হাসপাতালের অভিজ্ঞতায় মনে হল, জাতি ধর্ম অর্থ প্রভাব-প্রতিপত্তি নির্বিশেষে সবার জন্য স্বাস্থ্যের সুরক্ষার আয়োজনের মধ্যে যে কৃতিত্ব আছে, যে গরিমা আছে তা উপেক্ষা করবার মতো নয়। অনুভব করলাম, সবার জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবার কাজটি সহজ নয়, হাজার হাজার মানুষের সম্মিলিত প্রয়োজনের প্রাত্যহিক গুরুভার ডাক্তার, নার্স ও অন্য কর্মীদের অনেক সময় নাজেহাল করে দেয়, পরিষেবাকেও বেহাল করে দেয়।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির তুল্যমূল্য বিচারে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসার আয়োজন সম্বন্ধে আমাদের প্রত্যাশা এবং প্রত্যয় দুটোই বেড়ে গেল, যখন কয়েক মাস ধরে নানা ইউনিটে নানা পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে, রিপোর্ট নেওয়ার নানা লাইনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে লক্ষ করলাম, এত বড় জনতার স্রোতকে ঠিক ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটা বহুমুখী পরিচালনার যন্ত্র ঘুরছে দিনরাত, আর সেই যন্ত্র যাতে চালু থাকে তার জন্য হাসপাতালের বহু লোকের তত্ত্বাবধানে বহু রোগীর নানা ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা আর চিকিৎসা চলেছে একের পর এক, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে পর্যন্ত, প্রায় বিনামূল্যে।
বলতে পারেন, সরকারি হাসপাতালে অনেকেরই উল্টো অভিজ্ঞতা হয়েছে, অনেক রোগীকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কথাটা অস্বীকার করবার উপায় নেই। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালেও, অনেক অর্থব্যয়ের পরেও, অনেক সময় যে দুর্ভাগ্যজনক ছবি দেখা যায় সে কথাটা মনে রাখছি তো? এ কথা মানতে হবে যে সরকারি পরিষেবা আরও অনেক প্রসারিত হওয়া দরকার, অনেক কর্মী, অনেক ডাক্তার, অনেক নার্স, অনেক উপকরণের প্রয়োজন। জেলা ও ব্লক স্তরে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যাপক উন্নতির প্রয়োজন যাতে সর্দিজ্বরের রোগীকে শহরের হাসপাতালে আসতে না হয়। এই সব ঘাটতির নিদান কিন্তু সরকারি পরিষেবার আরও উন্নতি চাওয়া এবং পাওয়া, এর মুণ্ডপাত করে এবং এর অধঃপাত ঘটিয়ে আরও বাজারিকরণের পথে হাঁটা নয়।
এ কথা মানি যে নিজস্ব অভিজ্ঞতার নিরিখে অতি-সরলীকরণ কাজের কথা নয়। চাই যথেষ্ট তথ্য। তবু এটা ভাবা জরুরি যে আমরা যারা সচরাচর সরকারি হাসপাতালের ছায়া মাড়াই না অথচ সে বিষয়ে অবলীলায় নিশ্চিত এবং প্রায়শই নিন্দামুখর সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাই, সেই ‘আমাদের মতো লোক’দের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ঘাটতির পরিণাম কিন্তু ব্যাপক এবং মারাত্মক। তার কারণ, সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা সম্বন্ধে সেই অনভিজ্ঞতা-প্রসূত অমূলক মূল্যায়ন আমাদের প্রভাব ও গলার জোরে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব পায়।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ফিরি। ছাত্রপরিবৃত হয়ে রোগীকে পরীক্ষা করছেন বড় ডাক্তার, এক তরুণ ছাত্রীকে তিনি নির্দেশ দিলেন আমাদের ‘সাধারণ মেয়ে’টিকে ধরে নিয়ে বসাতে। এই লব্ধপ্রতিষ্ঠ চিকিৎসক সে দিন চিকিৎসাবিদ্যার সঙ্গে সঙ্গে তরুণ প্রজন্মকে সামাজিক দূরত্ব অতিক্রম করবার পাঠও দিচ্ছিলেন। সবার জন্য যে প্রতিষ্ঠান, সেখানেই সামাজিক ব্যবধান ঘোচানোর এই সম্ভাবনা তৈরি হয়, সব সময় তার রূপায়ণের নিশ্চিন্ততা না থাকলেও।
সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অবজ্ঞা, অবহেলা, উপেক্ষা ও দুর্নীতির যে আখ্যান শুনি তা নিয়ে নিশ্চয়ই চর্চার অবকাশ আছে। তবে অসংখ্য পরিষেবাপ্রার্থীর অবিরাম আনাগোনার মধ্যে কিছু কিছু ডাক্তার, নার্স ও কর্মীর যে সহৃদয়তা লক্ষ করলাম, সেই মনুষ্যত্ব এই ধরনের কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়লে নিজে দেখাতে পারতাম কি না জানি না।
উপলব্ধি করলাম, সবার স্বাস্থ্যের দায় আমাদের সকলের। সমাজের, সরকারের এবং সাধারণ্যের।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy