গোলপার্কের মোড়ে একটা আড্ডা বসত ছেলেদের। তাতে কলেজ-পড়ুয়ারা যেমন আসত, তেমন আসত কাজ করে-খাওয়া ছেলেরাও। শেষের দলে ছিলেন হারাদা। অন্যদের চাইতে বয়সে একটু বড়। এক দিন নেশার ঘোরে নানা তাত্ত্বিক কথাবার্তা বলে চলেছেন, হঠাৎ খেয়াল হল, কলেজের ছেলেরা তাঁর কথা শুনে হাসছে। খুব চটে গিয়ে হারাদা বলেছিলেন, ‘ব্যাটারা একদম হাসবি না। আমিও কাবাকাফু পড়েছি।’
গল্পটা বলেছিলেন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। আর কিছু না বলেও যা বলতে চেয়েছিলেন তা হল, বিদ্যে জাহির করার এই ঝোঁক কেবল হারাদার নয়। তাবড় তাবড় পণ্ডিতরাও মনে করেন, কাবাকাফু-তালিকা যার যত লম্বা, তার শিক্ষা তত বেশি।
তার ঠিক উল্টো দিকে যে প্রতিষ্ঠানের অবস্থান, লোকের মুখে মুখে তার নাম ‘জে-প্যাল’। ম্যাসাচুসেটসের কেমব্রিজ শহরে, চার্লস নদীর গা ঘেঁষে তার প্রধান দফতর। এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক ডজন বিল্ডিংয়ের একটায়, একটি তলায় তার দফতর। বিশ্বের সেরা ছাত্র আর শিক্ষকরা সেখানে বই পড়া থেকে জীবন বদলানোর মাঝের কাজগুলো করেন ধাপে ধাপে। যেমন, ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়-আসে, কিছু শেখে না, কী করা যায়? কাজ— মুম্বই ও বডোদরার স্কুলে প্রশিক্ষিত ‘বালসখী’ কর্মীরা দুর্বল পড়ুয়াদের আলাদা করে পড়াল। ফল— তারা অনেক ভাল শিখতে পারছে। সিদ্ধান্ত— বালসখী প্রশিক্ষণ চালু হোক।
আবার, সরকারি সস্তা দরে স্বাস্থ্যবিমা করালে চিকিৎসার খরচ কমে, তবু গরিব বিমা করেন না। কী করা যায়? কাজ— নিকারাগুয়াতে অসংগঠিত ক্ষেত্রের কিছু মজুরকে সরকারি বিমায় আনা হল। ফল— বিমার আওতাভুক্ত ক্লিনিকে বেশি মজুর যাচ্ছেন, কিন্তু খরচে সাশ্রয় তেমন হচ্ছে না। সিদ্ধান্ত— বিমায় গরিবের সুবিধে স্পষ্ট নয়।
২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পভার্টি অ্যাকশন ল্যাব’, বছর দুয়েক বাদে এমআইটি-র এক প্রাক্তন ছাত্র অনুদান দিলেন। তাঁর পিতার স্মরণে নাম হল, ‘আব্দুল লতিফ জামিল পভার্টি অ্যাকশন ল্যাব’, সংক্ষেপে জে-প্যাল। মার্কিন দেশের বাইরে পাঁচটি শহরে তার দফতর রয়েছে, তবে সবার রাশ ই-১৯ নম্বর বিল্ডিংয়ে। সেখানে হঠাৎ গিয়ে পড়লে যাঁদের দেখা যায়, তাঁদের দু’পায়ে সব সময়ে একই রঙের মোজা থাকে না। কেউ চায়ের কাপটি হাতে করিডোরে দাঁড়িয়ে গল্প করেই যাচ্ছেন। তাড়া কিসের? যাঁদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে ঘাম ছোটে, সেই প্রফেসররা বিকেলে টেবিল টেনিস বোর্ডে বল পেটান। তখন কাজের কথা তোলে কার সাধ্যি?
তারই মধ্যে বিশ্বের তিরাশিটি দেশে ৯৭৮টি নীতি মূল্যায়ন, কিছু সম্পূর্ণ, কিছু চলছে। ‘এক অর্থে নোবেল পেয়েছে জে-প্যাল’, বললেন অর্থনীতিবিদ রাঘবেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ‘কারণ যে কাজের জন্য অভিজিৎ বিনায়ক, এস্থার আর মাইকেল ক্রেমার, এই তিন জন পুরস্কার পেয়েছেন, তা এই প্রতিষ্ঠানে করা তাঁদের কাজ।’
সেই কাজ হল হাতে-কলমে নীতির কার্যকারিতা পরীক্ষা করে, তার ভিত্তিতে উন্নয়নের নীতি নির্ধারণ। সাক্ষ্য-ভিত্তিক নীতি। তার জন্য যে কী অবিশ্বাস্য রকম খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হয়, সে জে-প্যালের বৈঠকে না বসলে জানা যায় না। প্রতি সপ্তাহে হয় চা খেতে খেতে মিটিং, ‘ডেভেলপমেন্ট টি’। যাঁদের গবেষণা খানিক এগিয়েছে, তাঁরা তা নিয়ে কথা বলেন। বাকিরা নানা মন্তব্য, পরামর্শ, সতর্কবাণী দেন। সেখানে কিছু দিন থাকার সুবাদে এক চা-বৈঠকে দেখি, বিষয় গরুচুরি। আফ্রিকার কোন দুই দেশের মধ্যে নাকি ভারী অশান্তি, এ দেশের লোক সীমান্ত পেরিয়ে ও দেশের গরু লুট করে। তারা বদলা নেয়। গবেষণার বিষয়: এ কি স্রেফ অপরাধ, না কি খরায় রোজগার মার খেলে গরু চুরি বাড়ে?
প্রস্তাব হল, উপগ্রহ চিত্রে সবুজ ছোপের কম-বেশির সঙ্গে গরু চুরির অভিযোগ মিলিয়ে দেখা চাই। লঘিমা-দ্রাঘিমার কচকচি শুনতে শুনতে মনটা সরে গিয়েছে, হঠাৎ সংবিৎ ফিরল সুন্নত-এর কথা কানে আসতে। কী সর্বনাশ, গরু চুরির সঙ্গে, সুন্নতের কী? ক্রমে বোঝা গেল, ছেলেদের সুন্নত উপলক্ষে ভোজ দেওয়ার চল আছে ওই সব অঞ্চলে। খরা হলে ভোজ দেওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই দেখা চাই, ভোজবাড়ি কমলে গরুলুট বাড়তে পারে, এমন আগাম বলা যায় কি না।
মানে, যাঁদের নিয়ে নীতি, তাঁদের জীবনটা একেবারে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া চাই। একটুও ফাঁক থাকলে সমীক্ষার ফলে ভ্রান্তি, অস্পষ্টতা থেকে যাবে। প্রশ্ন-নকশার খুঁটিনাটি নিয়ে কত চিন্তা, কত বিতর্ক, তা গবেষণার গড়পড়তা ধারণার মধ্যে কুলোয় না। অর্থনীতির বই যতই পড়ো, যতই অঙ্ক কষো, অর্থনীতি দিয়ে জীবন বদলাতে হলে জীবনকে জানা চাই। কেবল জ্ঞান নয়, চাই কাণ্ডজ্ঞান। তারই চর্চা হয় জে-প্যালে। নোবেল ঘোষণা হোক আর যা-ই হোক, ঠিক দিনে সবার কাছে যাবে ইমেল। ‘অমুক দিন ডেভেলপমেন্ট টি। চা-বিস্কুট আমি আনব, তোমরা আইডিয়া নিয়ে এসো।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy