n নিরপেক্ষতা? কৃষি আইন পর্যালোচনা করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের গঠিত কমিটির সদস্য অশোক গুলাটি, অনিল ঘনবট ও পি কে জোশী। ছবি: পিটিআই।
২০২০-এর ১৯ মার্চ। সংসদের রাজ্যসভার কক্ষ। শপথ নিতে এগোচ্ছেন সদ্য-মনোনীত সাংসদ। বিরোধীদের বেঞ্চ থেকে আওয়াজ উঠল, ‘শেম অন ইউ’। কেউ ‘ডিল’ বলে চেঁচিয়ে দুয়ো দিলেন।
কে এই নতুন সদস্য? সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। অবসর নেওয়ার মাত্র চার মাস পরেই রাজ্যসভার সাংসদ হিসেবে মনোনীত হন তিনি।
এ দেশের আইন কমিশন তার চতুর্দশ রিপোর্টে একটি সাবধানবাণী শুনিয়েছিল। তা হল, সাধারণ মানুষকে যদি বিচারপতিদের প্রতি গভীর সম্মান দিতে হয়, তা হলে বিচারপতিদেরও উচিত সেই মতো আচরণ করা। তাঁদের এমন কথা বলা বা কাজ করা উচিত নয়, যাতে সাধারণ মানুষের মনে হয়, বিচারপতিরা প্রত্যাশামাফিক সম্মানের যোগ্য নন।
মোদ্দা কথা হল, সুপ্রিম কোর্টের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে যাতে প্রশ্ন না ওঠে, তা দেখা বিচারপতিদেরই দায়িত্ব।
ইদানীং সরকারের বিরোধীরা সেই প্রশ্ন তোলার অবকাশ পেয়ে যাচ্ছেন। গত কয়েক দিনে বিরোধী নেতারা শীর্ষ আদালত সম্পর্কে যে সব মন্তব্য করেছেন, তার দু’একটি নমুনা তুলে ধরা যাক। “সুপ্রিম কোর্টের বাস্তব চিত্রটা গোটা দেশ দেখছে।” “কেন কৃষকরা সুপ্রিম কোর্টের কাছে বিচার চাইতে যাচ্ছেন না, তা নিয়ে আদালতেরও আত্মসমীক্ষা করা উচিত।” সুপ্রিম কোর্টের রায়কে ‘অপরিকল্পিত’ বলেও আখ্যা দিচ্ছেন বিরোধীরা। বলেছেন, “সরকার শীর্ষ আদালতকে ভুল পথে চালিত করছে।”
কী এমন হল? নয়া নাগরিকত্ব আইন, কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা রদ, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যের ‘লাভ জেহাদ’ বিরোধী আইন— সুপ্রিম কোর্ট এত দিন এ সবে নাক গলাতে চায়নি। এই সব আইনের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন হয়েছে। স্থগিতাদেশের উপর্যুপরি দাবি উঠেছে। সুপ্রিম কোর্ট তাতে স্থগিতাদেশ দেয়নি। কোনও আইন এখনও খারিজও করেনি। আইনসঙ্গত ভাবেই সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান ছিল, ‘প্রাথমিক বিচার’-এ কোনও আইনকে অসাংবিধানিক বলে মনে না হলে আদালত তাতে স্থগিতাদেশ জারি করতে পারে না। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন প্রণয়ন, ৩৭০ ধারা রদ, লাভ জেহাদের অভিযোগ তুলে বিজেপি হিন্দুত্বের কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে চলেছে বলে যতই অভিযোগ উঠুক, আদালত নিজের অবস্থানে অনড় থেকেছে।
তিন কৃষি আইনে সুপ্রিম কোর্ট স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়েছে। দু’মাসের জন্য স্থগিতাদেশ জারি করে প্রধান বিচারপতি শরদ অরবিন্দ বোবডে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করে দিয়েছেন। সিএএ-এনআরসি’র বিরুদ্ধেও দিল্লির শাহিন বাগে অবস্থান-বিক্ষোভ চলছিল। যেমন এখন তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে প্রায় দু’মাস ধরে দিল্লির সীমানায় বিক্ষোভ চলছে। সে সময় আদালত সরকার ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে মধ্যস্থতা করিয়ে, দুই পক্ষকে একটা মীমাংসায় পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেনি। তিন কৃষি আইন নিয়ে স্থগিতাদেশ জারি করে আদালত সে চেষ্টাই করল।
আইনজীবীরা বলতে পারেন, শীর্ষ আদালত নিজের গণ্ডির বাইরে পা ফেলছে। রাজনৈতিক প্রশ্ন অন্য। রাজনৈতিক শিবিরে সংশয় তৈরি হয়েছে, সরকারকে সুবিধা পাইয়ে দিতে এ কাজ করল আদালত? সংশয়ের কারণ, সরকারও কমিটি গঠন করে কৃষক নেতাদের সঙ্গে আপস করতে চাইছিল। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা কৃষকদের বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নিজে এত বার কৃষি আইনের পক্ষে সওয়াল করেছেন যে, আইন প্রত্যাহার করা মুশকিল। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারই সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে কৃষক আন্দোলনের সমস্যা থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাইল কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, তাঁদের সিদ্ধান্ত অনেকে ভুল বুঝেছেন। প্রশ্ন উঠতে পারে— সেই ভুল বোঝার অবকাশই বা আদালত রাখবে কেন!
সরকারের সমালোচনা করা বিরোধীদের কাজ। সেই সমালোচনার তির এখন বিচারবিভাগের দিকেই ঘুরে যাচ্ছে। বিরোধীরা খোলাখুলিই বলতে শুরু করেছেন যে, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন সরকার বিচারবিভাগকে কব্জা করে ফেলতে চাইছে। যেমনটা করতেন ইন্দিরা গাঁধী।
দেশের শীর্ষ আদালতে মোদী সরকার ছড়ি ঘোরাচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন প্রথম ওঠে ২০১৮-য়। কেন্দ্রের জন্য যাবতীয় স্পর্শকাতর মামলা বিশেষ এক জন বিচারপতির বেঞ্চেই শুনানির জন্য পাঠানো হচ্ছে বলে চার প্রবীণ বিচারপতি প্রকাশ্যে অভিযোগ তোলেন। রঞ্জন গগৈ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। প্রধান বিচারপতি হওয়ার পরে গগৈ-এর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ ওঠে। তিনি নিজেই সেই অভিযোগের বিচারে বসেছিলেন।
শুধু ব্যক্তি নয়। প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সংশয় প্রকাশের সুযোগও বিরোধীরা পেয়ে গিয়েছেন। উদাহরণ, বিচারপতি অখিল কুরেশির বদলি। গুজরাত হাই কোর্টের বিচারপতি হিসেবে কুরেশি সোহরাবুদ্দিন ভুয়ো সংঘর্ষ মামলায় অমিত শাহকে পুলিশি হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেটা ২০১০-এর ঘটনা। প্রায় দশ বছর পরে সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম তাঁকে মধ্যপ্রদেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করায় নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের সরকার আপত্তি তোলে। কলেজিয়াম তা মেনে নিয়ে তাঁকে ত্রিপুরায় পাঠায়। উত্তর-পূর্ব দিল্লির হিংসা নিয়ে বিজেপি নেতা তথা দিল্লি পুলিশকে তোপ দাগার পরেই মধ্যরাতে দিল্লি হাই কোর্ট থেকে বিচারপতি এস মুরলীধরের বদলিও প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দিয়েছে।
কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান বা সিদ্ধান্ত ঠিক না ভুল, তার বিচার হতেই পারে। তবে সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সব ক্ষেত্রে নিজের নীতিগত অবস্থানে অনড় থাকলে, তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা কঠিন। সুপ্রিম কোর্টে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে একাধিক মামলা হয়েছে। আইনে স্থগিতাদেশের দাবি ওঠে। গত বছরের জানুয়ারিতে প্রধান বিচারপতি শরদ অরবিন্দ বোবডে বলেছিলেন, আদালতের কাজ হল আইনের বৈধতা যাচাই করা। তা না করে আদালত আইন খারিজ বা স্থগিত করতে পারে না। একই যুক্তিতে কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা রদ, তথাকথিত ‘লাভ জেহাদ’ বিরোধী আইন বা তার আগে দলিত নির্যাতন প্রতিরোধ আইনে সংশোধনেও সুপ্রিম কোর্ট স্থগিতাদেশ জারি করেনি। সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান খুবই স্পষ্ট ছিল। আইন প্রণয়ন করা প্রশাসন ও সংসদের কাজ। সুপ্রিম কোর্ট শুধু যাচাই করতে পারে, সেই আইন সংবিধানসম্মত কি না। এমনকি, সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্প বা রাজপথের আশপাশের এলাকার পুনর্নির্মাণ, নতুন সংসদ ভবন তৈরির বিরুদ্ধে মামলাতেও শীর্ষ আদালতের বিচারপতিরা বলেছেন, তাঁরা প্রশাসনের কাজে খুব বেশি নাক গলাতে পারেন না।
সুপ্রিম কোর্টের এহেন অবস্থানে সরকারের স্বস্তি মিলেছে ঠিকই। তা বলে বিরোধীরা কোনও প্রশ্ন তোলার সুযোগ পাননি। কারণ, আদালত প্রতিটি ক্ষেত্রেই একই অবস্থান নিয়েছে। তিন কৃষি আইনের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি ঠিক বিপরীত অবস্থান নেওয়াতেই প্রশ্ন উঠেছে।
প্রশ্ন শীর্ষ আদালতের অগ্রাধিকার নিয়েও। গত এক বছরে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে মামলার শুনানি হয়নি। ৩৭০ ধারা রদের পর কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতাদের আটক করে রাখার বিরুদ্ধে আর্জিরও যথাসময়ে শুনানি হয়নি বলে অভিযোগ। এমনকি তার আগে, ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নোট বাতিলের নির্দেশের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মামলারও এখনও ফয়সালা হয়নি। সুপ্রিম কোর্টে সাংবাদিক অর্ণব গোস্বামীকে জেলে পোরার বিরুদ্ধে মামলার দ্রুত শুনানি হয়েছে। অর্ণব মুক্তি পেয়েছেন। বিচারপতিরা বাক্স্বাধীনতার অধিকারকে তুলে ধরেছেন। উল্টো দিকে হাথরসে যাওয়ার পথে আটক হওয়া কেরলের সাংবাদিকের মুক্তির আর্জিতে আদালত একই অবস্থান নেয়নি।
আদালতের রায়ের সমালোচনা করলেই বিচারপতিদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় না। কিন্তু বিচারপতিদের নিরপেক্ষতা নিয়ে সত্যিই প্রশ্ন উঠলে তা শুধু ব্যক্তিবিশেষের সমস্যা নয়, প্রতিষ্ঠানেরও চিন্তার কারণ। বারংবার একই প্রশ্ন উঠলে বিচারবিভাগের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে। দেশের নাগরিক বিশ্বাস করেন, শীর্ষ আদালত সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষা করে। বিরোধীরা সরকারের নিন্দা করতে গিয়ে যাতে সেই আস্থায় চিড় ধরাতে না পারেন, তা সুনিশ্চিত করা বিচারপতিদেরই দায়িত্ব। আইন কমিশন অন্তত সে কথাই বলেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy