Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪
Ujjwala Yojana

জঙ্গলমহলে ‘উজ্জ্বলা যোজনা’র সাফল্য কতটা?

কাঠ, কয়লা, গুলের ধোঁয়া থেকে মহিলাদের রেহাই দিতে সরকার তাঁদের গ্যাস সিলিন্ডারের বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। কিন্তু তা ব্যবহার হচ্ছে কি? সবচেয়ে বড় সমস্যা অর্থ। এর পরে অমূলক ভয়, চিরাচরিত অভ্যাস বজায় রাখার বিষয় তো রয়েছেই।তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী, পাঁচ জনের সংসারে দৈনিক তিরিশ টাকার ‘কুচা’ লাগে। অর্থাৎ, মাসে ন’শো টাকা।

উজ্জ্বলা যোজনায় পাওয়া গ্যাস নিয়ে যাচ্ছে এক দম্পতি । ফাইল চিত্র

উজ্জ্বলা যোজনায় পাওয়া গ্যাস নিয়ে যাচ্ছে এক দম্পতি । ফাইল চিত্র

প্রদ্যোত পালুই
শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২০ ০১:১০
Share: Save:

বাড়ির সামনের রাস্তায় মিউনিসিপ্যালিটির কলের চারপাশে ঝুমা, মৃদুলা, ঊষা, চুমকিরা কালো হয়ে পুড়ে যাওয়া হাঁড়ি, কড়াই নিয়ে বসেছে। বাড়িতে জল নেই। তাই রাস্তার কলই ভরসা। জিজ্ঞেস করলাম, ‘হাঁড়ি, কড়াইয়ের এমন হাল কেন? উজ্জ্বলা যোজনায় ফ্রিতে গ্যাস পাওনি?’ মুচকি হেসে উত্তর দেয় মৃদুলা, ‘‘পেয়েছি। তবে আমাদের এক ঘর, এক দুয়ার। সেখানে কোনখানে গ্যাস আর ওভেন বসাব। ভয় পাই, যদি কিছু হয়ে যায়। তাই ওসব বেঁধে রাখা আছে।’’ তাঁর কথায় মাথা নাড়ল বাকিরাও। এক জন আর একটু এগিয়ে জানাল, ‘‘এক সিলিন্ডার গ্যাসের যা দাম! অত টাকা এক সঙ্গে পাই কোথায়। আমাদের খেটে খাওয়ার সংসার। তিরিশ টাকার ‘কুচা’ (জ্বালানিযোগ্য আঁটি বেঁধে বিক্রি হওয়া ছোট ছোট কাঠের টুকরো) কিনলে এক দিনের রান্না হয়ে যায়।’’

তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী, পাঁচ জনের সংসারে দৈনিক তিরিশ টাকার ‘কুচা’ লাগে। অর্থাৎ, মাসে ন’শো টাকা। কাঠ ভেজা হলে ঠিকঠাক জ্বলে না। ধোঁয়ায় চারদিক ভরে যায়। রান্না করতে লাগে দ্বিগুণ সময়। পোড়া ছাই রান্নার সামগ্রীতে পড়ার সম্ভাবনা ষোলোআনা। অন্য দিকে, সাড়ে পাঁচশো টাকার এক সিলিন্ডার (সাড়ে ১৪ কেজি) গ্যাস আর সঙ্গে একটা প্রেসার কুকার ব্যবহারে ন’শো টাকার কাঠের চেয়ে চলবে বেশি দিন। প্রথম বারে সাড়ে ছ’শো টাকা দিয়ে সিলিন্ডার কিনতে হলেও কম-বেশি একশো টাকা ভর্তুকি পেলে পরের বার থেকে সাড়ে পাঁচশোর বেশি লাগার কথা নয়। ধোঁয়া, বেশি সময় লাগা, কালি-ঝুলি মাখানো হাঁড়ি, কড়াই থেকেও রেহাই পাওয়া যায়। এত সুবিধার কথা বলে বোঝানো গেলেও প্রকৃতই কতটা বুঝল জানি না। কারণ, এখনও তারা ওই কালো হাঁড়ি-কড়াই নিয়েই দৈনিক কলতলায় বসে।

শুধু ঝুমা বা মৃদুলা নয়, আরও আছে। মুড়ি ভেজে বিক্রি করে সাবিত্রী কর্মকার। আঁচের উনুনে গুল আর ঘুঁটে দিয়ে উনুন জ্বালায়। চারদিক ধোঁয়ায় এমন অন্ধকার হয়ে যায় যে আশপাশের বাড়িতেও জানালা বন্ধ করতে হয়। ‘উজ্জ্বলা যোজনার রান্নার গ্যাস পেয়েছ?’, ধোঁয়ায় চোখের জল মুছতে মুছতে উত্তর আসে, ‘‘পেয়েছি। তবে তা সব সময়ে ব্যবহার করি না। সাধারণ রান্না-বান্না আঁচের উনুনে হয়। মুড়ি ভাজাও হয় একই ভাবে।’’

শহর ছাড়িয়ে জঙ্গলমহলের গ্রামে ঢুকলে ছবিটা একটু অন্য রকম। নজরে আসবে, সারি দিয়ে মেয়েরা কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে জঙ্গলের সরু পায়ে চলা পথে হেঁটে চলেছে। একটা জায়গায় মাথার বোঝা নামিয়ে জনা ছয়েক মহিলা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ‘উজ্জ্বলা’র কথা জিজ্ঞেস করায় উত্তর এল, তাঁরাও রান্নার গ্যাস পেয়েছেন। কিন্তু তা ব্যবহার করেন না। কারণ জানতে চাওয়ায় মুচকি হেসে এ ওঁর মুখের দিকে তাকালেন। অনেক পীড়াপীড়িতে যা বেরিয়ে এল তার মূল কথা, বিনা খরচে যখন কাঠ পাওয়া যাচ্ছে, তখন গ্যাসের পেছনে অর্থ খরচ করে লাভ কী! এমনকি, এই কাঠ বাড়ির জ্বালানির চাহিদা মিটিয়ে বাজারে বিক্রি করে বাড়তি রোজগারও হয়। ফলে রান্নার গ্যাস এঁদের কাছে কার্যত বিলাসিতাই।

মৃদুলা, সাবিত্রীদের কারও বাড়ির গাছ বা গুল কারখানা নেই। সবই কিনতে হয়। সে জন্য অর্থ খরচও হয়। এমনকি, সেই খরচ অনেক পরিবারে গ্যাসের চেয়ে বেশি। তা সত্ত্বেও প্রচলিত প্রথা ছাড়তে পারেননি কেউ। এমনকি, অদূর ভবিষ্যতে ছাড়ার কোনও পরিকল্পনাও নেই। অথচ এমন একটি প্রকল্পের মাধ্যমে মা ও শিশুকে ধোঁয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে, পরিবারের আর্থিক সাশ্রয়ে, সময় বাঁচাতে দেশের আট কোটি দরিদ্র পরিবারকে ভর্তুকি দিয়ে ওভেন এবং এক সিলিন্ডার গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। পেয়েও গিয়েছেন অনেকেই। কিন্তু তার ব্যবহার কোথায়? পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের হিসেব অনুযায়ী, ৮২ শতাংশ গ্রাহক সিলিন্ডার পুনরায় ‘রিফিল’ করেছেন। প্রশ্ন হল, তাঁরা কি নিয়মিত ব্যবহার করছেন। না, বেশির ভাগ পরিবারই করেন না। হয়তো এক বার কী দু’বার ‘রিফিল’ করেছেন।

তা হলে রান্নার গ্যাসে ভর্তুকির অর্থ কারা ভোগ করছেন? অবশ্যই মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবার এবং নিম্নবিত্তের একটা ক্ষুদ্র অংশ। অর্থাৎ, ভর্তুকি যাঁদের জন্য জরুরি তাঁরা সকলে পাচ্ছেন না। কেউ বলতে পারেন, তাঁদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সেই সুযোগ তাঁরা সদ্ব্যবহার করতে পারেন না। কথাটা ঠিক। কিন্তু কেন তাঁরা ব্যবহার করতে পারেন না, সেই কারণ খোঁজা দরকার। অনেকের আলাদা রান্নাঘর নেই। উঠোনে রান্না করেন। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় ইত্যাদির মধ্যে সিলিন্ডার বাইরে বার করে রান্নার ঝামেলা কেউ নিতে চান না। দিনটা চলে যাওয়া নিয়ে কথা। মাসের জ্বালানি এক সঙ্গে সংগ্রহ করার কথাও ভাবেন না। আর জঙ্গলবাসী বিনা খরচে জ্বালানি পাচ্ছেন। তাই গ্যাস নামক বিলাসিতার মনেও আসে না। সর্বোপরি, অনেকের মতে, ওটা আত্মীয়-স্বজন এলে বাড়ির সম্মানরক্ষার বাড়তি ব্যবস্থা। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার নৈব নৈব চ। অর্থাৎ দরিদ্র পরিবারের মহিলাদের স্বাস্থ্যের বিষয়টি বিনামূল্যে ‘উজ্জ্বলা যোজনা’য় গ্যাসের ব্যবস্থা করে দেওয়ার পরেও চূড়ান্ত অবহেলিত।

তা হলে উপায়? উপায় একটাই। ‘উজ্জ্বলা যোজনা’র গ্যাস ব্যবহার নিশ্চিত করা। তা হলে স্বাস্থ্যের সঙ্গে সঙ্গে গাছের উপরে কোপ কম পড়বে, যা পরিবেশেরও সহায়ক হবে। আর এই বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকেই। শুধু গ্যাস বা ওভেন দিয়েই দায়িত্ব শেষ হয় না, তা ব্যবহারে উপভোক্তাদের আগ্রহী করে তুললে তবেই প্রকল্পের উদ্দেশ্য সফল হবে।

লেখক সরকারি আধিকারিক

অন্য বিষয়গুলি:

Ujjwala Yojana Jungle Mahal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE