অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, এস্থার দুফলো ও মাইকেল ক্রেমার-এর নোবেল জয়কে গণতন্ত্রের জয় বলিলে প্রশ্ন উঠিতে পারে। বিশেষত, প্রথাগত অর্থে দেখিলে তাঁহাদের গবেষণাপদ্ধতি রাজনীতি-নিরপেক্ষ। যে সমস্যার জন্য যে সমাধান সর্বাপেক্ষা কার্যকর, তাঁহারা সেই সমাধানের পক্ষে সওয়াল করেন। সেই সওয়ালে স্বভাবতই একনায়কতন্ত্রের কথা নাই। কিন্তু শুধু সেই যুক্তিতেই কি তাঁহাদের গবেষণাদর্শকে গণতন্ত্রের পক্ষে সওয়াল বলিয়া গণ্য করা চলে? এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করিতে হইলে প্রথমে গণতন্ত্রের মূলগত অর্থটি স্মরণ করিয়া লওয়া বিধেয়। গণতন্ত্র নিছক নির্দিষ্ট সময় অন্তর নির্বাচন নহে, এমনকি কেবল শাসক ও বিরোধীর আনুষ্ঠানিক সংলাপও নহে, গণতন্ত্র— জন স্টুয়ার্ট মিলের ধ্রুপদী সংজ্ঞা অনুসারে— ‘আলোচনাভিত্তিক শাসন’। এবং যথার্থ আলোচনার প্রথম শর্ত: শুশ্রূষা। শুনিবার ইচ্ছা। বিশেষত, ক্ষমতার সমীকরণে যাঁহাদের কণ্ঠস্বর অশ্রুত থাকিয়া যায়, তাঁহাদের কথা বিশেষ মনোযোগের সহিত শোনাই গণতন্ত্রের প্রধানতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়দের গবেষণাপদ্ধতির কেন্দ্রে রহিয়াছে এই শুশ্রূষা। মূলধারার অর্থশাস্ত্রের আলোচনায় ‘মানুষ’ চরিত্রগত ভাবে বিমূর্ত। অর্থাৎ, মানুষ সন্বন্ধে ধারণা আছে, কিন্তু রক্তমাংসের নরনারীর অস্তিত্ব সেই তত্ত্বের পরিসরে নাই। সেই পরিসরটি তাত্ত্বিকের, তাঁহার বিশ্বাসের, তাঁহার বিবেচনার। যাঁহারা দারিদ্র লইয়া ভাবেন, প্রকৃতই সেই অভিশাপ ঘুচাইতে চাহেন, তেমন তাত্ত্বিকরাও নিজস্ব সমাধানসূত্র রচনা করিয়াছেন ‘মানুষ’ সম্বন্ধে নিজস্ব ধারণার ভিত্তিতে। দরিদ্র মানুষ কী এবং কেমন, অর্থশাস্ত্রের তত্ত্ব তাহা জানিয়াছে নিজস্ব কল্পনার উপর ভিত্তি করিয়া। মানুষের নিকট সেই খোঁজ সে বড় একটা করে নাই।
অভিজিৎবাবুদের আপত্তি এখানেই। তাঁহারা বারে বারে জানাইয়াছেন, গরিব মানুষ এক ছাঁচে গড়া নহেন। তাঁহাদের আশা-আশঙ্কা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, উচ্চাকাঙ্ক্ষা-ভীতি এক এক জনের ক্ষেত্রে এক এক রকম। ফলে, তাঁহাদের সমস্যার সমাধান যদি করিতে হয়, গোড়ায় তাঁহাদের কাছে যাইতে হইবে। তাঁহারা সমস্যাটি লইয়া কী ভাবিতেছেন, কোন পথে সমাধান খুঁজিতেছেন, বা আদৌ খুঁজিতেছেন কি না, জানিতে হইবে। যাঁহাদের সমস্যা, তাহার মোকাবিলায় তাঁহাদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়। র্যান্ডমাইজ়ড কন্ট্রোল ট্রায়াল (আরসিটি) পদ্ধতিটি মূলধারার অর্থশাস্ত্র হইতে এইখানেই স্বতন্ত্র পথ ধরে। সেখানে সাধারণ মানুষের ‘এজেন্সি’ স্বীকৃত। ইহাই গণতন্ত্রের মূল কথা: যাঁহাদের সমস্যা, তাঁহাদের কণ্ঠস্বর শোনা জরুরি। সমাধানের খোঁজ তাহার পরে হইবে। এই দৃষ্টিতে দেখিলে আবি আহমেদ এবং অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়দের নোবেল জয়ের মধ্যে একটি তাৎপর্যপূর্ণ মিল খুঁজিয়া পাওয়া সম্ভব— গণতন্ত্রের এই দুঃসময়ে নোবেল কমিটি কি তবে গণতান্ত্রিকতার পক্ষে জোরদার সওয়াল করিল?
যত ক্ষণ অবধি উন্নয়নের নীতি গণতান্ত্রিক না হইতেছে, তাহা আধিপত্যবাদ দ্বারা চালিত। সেই আধিপত্য ক্ষমতাসীন রাজনীতির। ইহা নহে যে মূলধারার উন্নয়ন অর্থনীতি চরিত্রগত ভাবেই অগণতান্ত্রিক। কিন্তু যে পদ্ধতিতে তাহা ব্যবহৃত হইয়া থাকে— বিশেষত যে ভাবে বিভিন্ন রাষ্ট্রের উন্নয়ননীতি নির্ধারিত হইয়া থাকে, তাহার মধ্যে চাপাইয়া দেওয়ার প্রবণতাটি প্রকট। নির্বাচনী গণতন্ত্র তাহাকে বাধা দেয় না। অর্থাৎ, প্রকৃত গণতন্ত্রের অনুশীলনের জন্য নির্বাচনই যথেষ্ট নহে। আশা করা চলে, অভিজিৎবাবুদের নোবেল জয়ে এই গণতন্ত্রের দাবিটি বলশালী হইবে। এবং মানুষের কথা শুনিবার অভ্যাসটি শুধু উন্নয়ন নীতির জন্যই জরুরি নহে। রাজনীতিতেও এই অভ্যাসটি সুপ্রচলিত হওয়া বিধেয়। যাঁহাদের লইয়া দেশ গড়িয়া উঠে, তাঁহাদের কথা শুনিবার ধৈর্য এবং ইচ্ছা রাজনীতিকদের থাকা চাই বইকি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy