অর্থনৈতিক অবরোধ যদি অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতে থাকে, তবে রাশিয়ার অর্থনীতির পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভব। গ্রাফিক: সনৎ সিন্হা
যুদ্ধ কখনও বিনাপয়সায় হয় না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তৃতীয় মাসে পড়ল। দেশের পর দেশকে সেই যুদ্ধের মূল্য চোকাতে হচ্ছে। প্রতিবেশি দেশের আঞ্চলিক সংহতি বিঘ্নিত করার জন্য রাশিয়াকে শাস্তি দিতে তৎপর দেশগুলি উচ্চ আদর্শের পরিচয় দিয়েছে সন্দেহ নেই। এবং অভাবিত ভাবে পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলি আগ্রাসক তথা ‘বিক্রেতা’ রাশিয়ার প্রতি অর্থনৈতিক অবরোধ প্রয়োগ করেছে। কিন্তু এ কথাও মনে রাখা দরকার যে, প্রত্যেক বিক্রেতারই কোনও না কোনও ক্রেতা থাকে। এবং এই অবরোধের ফল অনিবার্য ভাবে এসে পড়ে সেই সব ক্রেতার উপরে। সেই ফল ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। অনুমান করা শক্ত নয় যে, ভ্লাদিমির পুতিনকে দমন করার আগেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক এবং সম্ভবত রাজনৈতিক ঝঞ্ঝাও আছড়ে পড়বে। আর ভারতও তা থেকে গা বাঁচাতে পারবে না।
জ্বালানির ক্রমবর্ধমান মূল্য এবং তার অনুবর্তী হয়ে সারের মূল্যবৃদ্ধি গত সপ্তাহে শ্রীলঙ্কাকে আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধে বাধা দিয়েছে। একই রকম ভাবে পাকিস্তানও এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। সেখানে বৈদেশিক বিনিময়ের এক ঘোর সঙ্কটকালে সরকারের পতনও ঘটেছে। ভারতে প্রয়োজনীয় মোট জ্বালানির ২৮ শতাংশ আসে খনিজ তেল থেকে এবং ৭ শতাংশ গ্যাস থেকে। ২০৩০-এর মধ্যে গ্যাসের চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে। সে দিক থেকে দেখলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গ্যাস সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিগুলিতে যে ৭৫ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব ঘটেছে বলে শোনা যাচ্ছে, তার প্রতিফলন রান্নার গ্যাসের উপর পড়েছে এবং তার দাম দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সবের ‘স্পট প্রাইস’ (কোনও পণ্যের সাম্প্রতিক মূল্য, যার মধ্যে তাৎক্ষণিক ক্রয়, বিক্রয় এবং সরবরাহকে ধরা হয়) তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অটো এবং ট্যাক্সি চালকেরা, রান্নার গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং সার ব্যবহারকারীরা এই বৃদ্ধির বিষয়টি ভাল মতোই টের পেয়েছেন। সরকার এ সব কিছুতে ভর্তুকি না দিলে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে উঠবে।
এই ধাক্কায় সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইউরোপীয় দেশগুলি। যদি জার্মানির কথাই ধরেন, মনে রাখতে হবে, তার জ্বালানি তথা ব্যবহার্য শক্তির প্রধান সরবরাহকারী হল মস্কো। রাশিয়ান তেল ও গ্যাস সরবরাহে আকস্মিক ছেদ অনিবার্য ভাবে অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে ডেকে আনবে এবং তার সূত্র ধরে (নির্ভর করছে কতখানি দক্ষতার সঙ্গে বিষয়টির সমাধান করা যায়) অনিবার্য ভাবেই সে দেশে রাশিয়ার মতোই মন্দাবস্থা দেখা দেবে।
ইংল্যান্ডে গ্যাসের দাম ৫০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। বরিস জনসনের সরকার হয়তো তার উপরে ধেয়ে আসা কেলেঙ্কারির অভিযোগ কাটিয়ে উঠতে সমর্থ হবে, কিন্তু গ্যাসের দাম আর ক্রমবর্ধমান কর থেকে উদ্ভূত সমস্যার মোকাবিলা করতে পারবে কি?
যদিও ইউরোপের মতো এতখানি সমক্ষে আসেনি, তবু আমেরিকার ছবিটিও খুব সুবিধের নয়। গত এক মাসে সেখানে পেট্রলের দাম প্রায় ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, গ্যালন পিছু চার ডলারেরও বেশি বেড়ে গিয়েছে। আমেরিকান অর্থনীতিও সমস্যা ভাল রকম টের পাচ্ছে। ‘নেটফ্লিক্স’ তার রাশিয়ান গ্রাহকদের জন্য দরজা বন্ধ করায় শেয়ারের দামে দ্রুত পতনকে লক্ষ করছে। অন্য যে সব পশ্চিমী সংস্থা রাশিয়ার প্রতি বিরুদ্ধ আচরণ করছে, তারাও বৃহত্তর বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। শেয়ার বাজারে পতন অনিবার্য হয়ে দাঁড়াবে।
এর পরেও মনে রাখতে হবে, যুদ্ধের নিজস্ব খরচও রয়েছে। অর্থনৈতিক অবরোধ যদি অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতে থাকে, তবে রাশিয়ার অর্থনীতির পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভব। যদি অবরোধ দীর্ঘমেয়াদি না-ও হয়, তা হলেও কি রুশ অর্থনীতি পুর্বাবস্থায় ফিরতে পারবে? এবং আরও প্রশ্ন, ইউক্রেনের কী হবে? বিশ্ব ব্যাঙ্ক যে হিসেব দিচ্ছে, তাতে খুব কম করে ধরলেও যুদ্ধের খরচ ইতিমধ্যেই একটি দেশের কাছে ৬০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকেছে, যে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) যুদ্ধের আগে ছিল ১৮০ বিলিয়ন ডলার। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি যে হিসেব দিচ্ছেন তাতে দেখা যাচ্ছে যে, যুদ্ধের কারণে সে দেশে প্রতি মাসে কম-বেশি ৭ বিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে। কিভ এই বিপুল অর্থ শোধ দিতে পারবে ধরে নিলেও কে তা প্রদানের দায়িত্ব নেবে? একাধারে অর্থনৈতিক স্থবিরতা, বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং পণ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষিত মাথায় রেখে পশ্চিম তথা আমেরিকা কি তার তহবিল ইউক্রেনের জন্য উন্মুক্ত করবে? সেই সব দেশের করদাতারা কি এমন কাজকে সমর্থন করবেন? আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের ২০২২-এর জন্য ঘোষিত আশাব্যঞ্জক উত্তরণের ভবিষদ্বাণীরই বা কী দশা হবে? এই সমস্ত কিছু মিলে বাস্তব পরিস্থিতিকে অতিক্রম করে আশার জয় হবে— এমন কিছু ধরে নেওয়া যায় কি?
এর সঙ্গেই যুক্ত হতে পারে রাজনৈতিক বিপর্যয়। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মেরিন লে পেন (যিনি তাঁর নির্বাচনী প্রচারের অন্যতম আয়ুধ হিসেবে রেখেছেন মুদ্রাস্ফীতি বিরোধিতাকে) আগামী রবিবার হয়তো ইম্যানুয়েল মাকরঁকে পরাজিত করতে পারবেন না। কিন্তু দু’জনের প্রাপ্য ভোটের ব্যবধান অবশ্যই কমবে। প্যারিসে পাঁচ বছর পরে ইউরো-অর্থনীতি বিষয়ে সন্দিহান এক সরকারের আগমনের পদধ্বনি হয়তো ইউরোপ শুনতে পাবে। আমেরিকায় নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় কংগ্রেস নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের বিপর্যয় দৃশ্যমান হয়ে উঠতে পারে। দু’বছর পরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনকেও অসম্ভব বলে মনে হবে না। আজকের এই সব সমস্যা আগামী দিনে ওয়েস্টার্ন অ্যালায়েন্সের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদী (বা আরও স্পষ্ট করে বললে, অন্য রাষ্ট্র সম্পর্কে বিদ্বেষ পোষণকারী) বিশ্বায়ন-বিরোধী শক্তির উত্থানকে স্পষ্ট করে তুলবে। এক রাজনৈতিক ভূমিকম্পের সম্ভাবনা কিন্তু থেকেই যাবে।
পরিশেষে যে কথাটি বাকি থাকে তা হল— পরিবেশগত পরিবর্তনের ব্যাপারে বিশ্বের পদক্ষেপ সংক্রান্ত বিষয়ে যুদ্ধের প্রভাব। দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি-বিকল্প হিসেবে বেশির ভাগ রাষ্ট্র কয়লাকেই ধরে নিচ্ছে। এমনকি, আমেরিকায় জো বাইডেন নীতি বদলে খনিজ তেল ও গ্যাসের নতুন ক্ষেত্র অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছেন। এই সব কিছুকে মাথায় রেখেই প্রশ্ন জাগে, যদি রাশিয়াকে পশ্চিম ইউরোপে একটি ‘বাফার জোন’ প্রদান করা যেত, তা হলে কি এই পরিমাণ লোকক্ষয়, অর্থক্ষতি এবং অগণিত মানুষের উদ্বাস্তু হওয়ার সমস্যাকে এড়ানো সম্ভব হত না? যদি তা হত, তবে বাইডেনের বৈদেশিক নীতির ব্যর্থতার মতো আর এক বিপর্যয়কে হয়তো দেখতে হত না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy