শেকসপিয়ারের ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’ গল্পে বিচার চলার সময় পোর্শিয়া এক তরুণ উকিলের ছদ্মবেশে এসে শাইলককে বলেছিল, ‘‘শর্ত অনুযায়ী শাইলক আন্তোনিওর শরীর থেকে এক পাউন্ড মাংস কেটে নিতেই পারে, কিন্তু রক্তপাত যেন না হয়।’’ কারণ, রক্তের কথা দলিলে উল্লেখ নেই।
সে কথা শুনে শাইলকের মনের অবস্থার তুলনা ইদানীংকালে বাজার ফেরত কৃষ্ণনাগরিকদের সঙ্গে অনায়াসেই করা চলে। রক্ত না ঝরিয়ে কী করে মাংস বাজার থেকে বাড়ি পৌঁছবে, সেটাই এখন সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তাঁদের কাছে। কৃষ্ণনগরে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ, থার্মোকলের থালা, বাটি, এক বার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের পাত্রের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে কিছু দিন হল। সম্প্রতি শান্তিপুরেও আইন করে মিহি প্লাস্টিকের ক্যারিপাকেট ব্যবহারে জরিমানা চালু করা হয়েছে।
শান্তিপুরে মোটা প্লাস্টিকের ক্যারিপ্যাকেট চললেও কৃষ্ণনগরে সব ধরনের প্লাস্টিকের ক্যারিপ্যাকেট বন্ধ হওয়ায় বাজার থেকে মাছ-মাংস আনতে গেলে ভরসা নাইলনের ব্যাগ বা বিক্রেতার দেওয়া কাপড়ের থলে। অনেক দোকানিই শালপাতা বা কলাপাতায় মাছ, মাংস মুড়িয়ে ক্রেতার ব্যাগে ভরে দিচ্ছেন। কিন্তু তাতেও ব্যাগ বা কাপড়ের ক্যারিব্যাগ চুইয়ে বেরিয়ে আসা কাটা মাছ, মাংসের রক্ত আটকানো যাচ্ছে না। ফলাফল, বাজার করে বাড়ি ঢোকার সময় দরজা থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। জামা, প্যান্টেও রক্তের ছাপ।
বাড়ি ঢুকেই গিন্নির চোখরাঙানি। কী করবেন কর্তা? বিকল্প কী? এক এক জন এক এক উপায়ে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছেন। কেউ বাড়ি থেকে বড় পাত্র নিয়ে যাচ্ছেন মাছ, মাংস, মিষ্টি আনার জন্য। কেউ কেউ বাজারের ব্যাগের ভিতর বাড়িতে থাকা কোনও মোটা প্লাস্টিকের ব্যাগ বসিয়ে বাজারে যাচ্ছেন। কিন্তু সব সময়ে তো এ ভাবে পাত্র নিয়ে গিয়ে বাজার করা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে, অফিস বা বিভিন্ন কাজ থেকে বাড়ি ফেরার সময়ে স্টেশন বা বাসস্ট্যান্ড থেকে যাঁরা বাজার সেরে বাড়ি ঢোকেন, তাঁদের পক্ষে তো বাড়ি থেকে পাত্র নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় সব সময়ে। সে সব কারণেই স্টেশন চত্বরে কিছুতেই বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না প্লাস্টিকের ক্যারি প্যাকেটের ব্যবহার। লুকিয়ে-চুরিয়ে বা প্রকাশ্যেই সেখানে প্লাস্টিকের ক্যারি প্যাকেটে উৎসাহ দেখাচ্ছেন ক্রেতা, বিক্রেতা সবাই।
বড় বড় ব্যবসায়ীরা ইতিমধ্যেই মোটা কাপড়ের বা কাগজের ব্যাগ ব্যাবহার করা শুরু করেছেন প্লাস্টিকের ক্যারিপ্যাকেটের বদলে। এতে প্যাকেটের খরচ আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। এই বাড়তি খরচের চাপ ব্যবসায়ীদের খুব একটা গায়ে না লাগলেও স্বীকার করতেই হয় ফুলওয়ালা, পেয়ারাওয়ালার মতো ছোট ব্যবসায়ীরা কিছুটা সমস্যায় পড়েছেন। প্লাস্টিকের ক্যারিপ্যাকেট উঠে যাওয়ার পর টিস্যু পেপারের মতো নরম কাপড় সদৃশ এক ধরনের ব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন দোকানে। যার দাম ক্যারি প্যাকেটের চেয়ে অনেকটাই বেশি। ১ কেজি জিনিস আনার মতো একটা প্লাস্টিক ক্যারি প্যাকেটের দাম যেখানে ২৫ পয়সা, এই ধরনের কাপড়ের ব্যাগের দাম হবে সেখানে ৮০ পয়সার মতো। এ ছাড়া, এই ব্যাগগুলো প্লাস্টিক ব্যাগের মতো তরল জিনিস ধরে রাখতে সক্ষম নয়। জল, বৃষ্টির হাত থেকেও ভিতরের জিনিসপত্র বাঁচানো সম্ভব নয় এই ধরনের ব্যাগের ক্ষেত্রে।
শহরের এক রেস্তরাঁর মালিক অরিন্দম গরাইয়ের কথায়, ‘‘খাবার নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকার অনুমোদিত ভাল কাগজের তৈরি বাক্সের দাম দাঁড়ায় ১০ থেকে ১২ টাকা। সেটাই ব্যবহার করি আমরা। কিন্তু সমস্যা হল জল, বৃষ্টি বাঁচিয়ে সেই বাক্স ক্রেতার বাড়ি পৌঁছে দেওয়া। সত্যিই এমন কিছু ক্ষেত্রে মনে হয় প্লাস্টিকের কোনও বিকল্পই নেই।’’
বাস্তবে কিন্তু বিকল্প যে একদম নেই, তা কিন্তু নয়। সেই বিকল্প পথের হদিস দিতে গিয়ে সিঙ্গুর সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক অমৃতকৃষ্ণ মিত্র প্রথমেই পলিথিনের ক্যারি প্যাকেটের বদলে এখন যে নরম সাদা কাপড়ের মতো দেখতে ক্যারিব্যাগ বিক্রেতারা দিচ্ছেন, সে প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘এসব ব্যাগও কিন্তু সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব, এ কথা বলা যাবে না। কারণ, এগুলো অনেক ক্ষেত্রেই পলিস্টাইরিন দিয়ে তৈরি। পলিস্টাইরিন পরিবেশে মিশতে এতই বেশি বছর সময় লাগে যে, তাকে বায়োডিগ্রেডেবেল বলা যায় না। পলিস্টাইরিনকে রি-সাইকেলও করা যায় না। সে ক্ষেত্রে এই দুই উপাদানের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ পলিয়েস্টার দিয়ে তৈরি ক্যারিব্যাগ।’’ তিনি আরও জানান, পলিয়েস্টারের ব্যাগে তরল পদার্থও সহজেই বহন করা যায়। বেশির ভাগ পলিয়েস্টার বায়োডিগ্রেডেবেল না হলেও রাসায়নিক পদ্ধতিতে এদের পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করা যায়। কিছু কিছু পলিমার যেমন পলি ল্যাকটিক অ্যাসিড (PLA), পলি গ্লাইকোলিক অ্যাসিড (PGA), পলি হাইড্রক্সি বিউটাইরেট (PHB), পলি প্রপিলিন সাকসিনেট (PPSu) ইত্যাদি দিয়ে গঠিত পলিয়েস্টারগুলি বায়োডিগ্রেডেবেল হওয়ায় এই উপাদান দিয়ে ক্যারিব্যাগ তৈরি হলে তা সহজেই পরিবেশে মিশে যাবে। আর যে পলিয়েস্টার বায়োডিগ্রেডেবেল নয় সেগুলি দিয়ে প্লাস্টিকের পরিবর্তে প্রয়োজন মতো পাইপ, দড়ি বা অন্য জিনিস, যা বহু দিন রাখা দরকার তা বানানো যেতেই পারে। সবটাই নির্ভর করছে কে কী উপাদানে কী তৈরি করছেন বা করবেন তার উপর। তাই পরিবেশরক্ষায় উপাদানগুলির উপর সরকারি নজরদারি প্রয়োজন।
তাঁর মতে, শ্বেতসার থেকে প্রাপ্ত বায়োডিগ্রেডেবেল পরিবেশবান্ধব পলি ল্যাকটাইড নামক পলিমার দিয়ে তৈরি গ্রিন প্লাস্টিক থেকে যে ক্যারিব্যাগ তৈরি হচ্ছে, সেটা এদের মধ্যে সব চেয়ে ভাল। এর আচরণ পলিথিনের ক্যারি প্যাকেটের মতোই হওয়ায় এই ব্যাগে কঠিন, তরল সব কিছুই বহন করা যায়। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলিতে পলি ল্যাকটাইডের ব্যাগ বিপুল ভাবে ব্যবহার হলেও আমাদের দেশে এখনও এই উপাদানের তৈরি ক্যারি প্যাকেটের চল বা উৎপাদন কোনওটাই সে ভাবে হয়নি। তাই সবার আগে এই বিকল্প পথগুলির বহুল প্রচলন করা প্রয়োজন। আর তার দাম যাতে সাধারণের নাগালের মধ্যে আসে, সেটা দেখা প্রয়োজন। তবেই প্লাস্টিকের প্রয়োজন কমবে।
বর্তমানে মানবসমাজের জীবনযাত্রায় এমন ভাবে মিশে আছে প্লাস্টিক, যে তাকে ছেড়ে বাঁচা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু এর পরিণাম পরিবেশের পক্ষে কতটা ভয়ঙ্কর হতে চলেছে, সে প্রসঙ্গে চেন্নাইয়ের রামচন্দ্র ইনস্টিটিউট অফ হায়ার এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের এনভায়রনমেন্ট হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং-এর গবেষক দীপ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘হাজার বছরেও প্লাস্টিক মাটিতে মেশে না। মাটির উপর প্লাস্টিকের স্তর জমে জমির উর্বরতা, জলধারণ ক্ষমতা সব শেষ করে দিচ্ছে। অনেকে প্লাস্টিক নষ্ট করতে রাস্তার ধারে জড়ো করে পুড়িয়ে দেন। সেটা ভীষণ ক্ষতিকারক। এ ভাবে প্লাস্টিক পোড়ালে তার থেকে স্টাইরিন, ডাই অক্সিনের মতো ক্যানসারের কারণ ঘটানোর মতো উপাদান তৈরি হয়।’’
প্লাস্টিক নিয়ে নানা গবেষণা চলছে সব সময়ে। তার ফসল হিসাবে কিছু কিছু পথ পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান তিনি। যেমন, অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে বিশেষ পদ্ধতিতে কিছু প্লাস্টিককে পুড়িয়ে পরিবেশবান্ধব তরল জ্বালানি তৈরি হচ্ছে, প্লাস্টিক দিয়ে রাস্তা তৈরি হচ্ছে। কিন্ত এর পরিমাণ পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্লাস্টিকের তুলনায় চোখে না পড়ার মতোই। প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে কাগজ, পাট বা সুতির কাপড়ের ব্যাগের পক্ষেই তিনি। দীপের পরামর্শ, ‘‘কাগজের ব্যাগ বানানোর জন্য শর্ট রোটেশন পদ্ধতিতে বাবলা, ঝাউ, কদমের মতো গাছের চাষ করলে তা পরিবেশেরও কাজে লাগে, প্রাকৃতিক বনাঞ্চলও ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।’’
আসলে বিকল্প পথগুলোর বেশির ভাগই এখনও সর্বস্তরে সহজলভ্য ও সস্তা না হওয়ায় প্লাস্টিকের ব্যবহারের অভ্যাসে লাগাম পরানো কঠিন হচ্ছে এই মুহূর্তে। বিকল্প পথগুলোর দ্রুত প্রচার আর প্রসার ঘটলে তবেই জনজীবন থেকে আস্তে আস্তে প্লাস্টিকের অভ্যেস কমবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
যা কিছু খারাপ তাকে তো বর্জন করতেই হবে। যত দিন বিকল্প পথগুলো সাধারণের জন্য প্রশস্ত না হয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে তত দিন একটু কষ্ট করে বাড়ি থেকে পাত্র নিয়ে মিষ্টির দোকানে, বাজারে যাওয়ার চেষ্টা তো করাই যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy