গত পঞ্চাশ বছরে আমাদের দেশে সেচে ব্যবহৃত একটা বৃহৎ ও প্রসারিত পরিকাঠামোকে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে অকেজো করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশের গ্রামে গ্রামে কূপ বা হাতে খোঁড়া কুয়োর ক্ষেত্রে শক্ত পাথরে কিংবা অগভীর মাটি-মোরাম ও নরম পাথর খুঁড়ে ভূজলের স্তরকে ফুটো করে কয়েক ফুট নীচে যাওয়ার পর গর্তটিকে গোলাকার করে বাঁধার একটা সরল নির্মাণের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ছিল। ভূজলের স্রোত থেকে জল জড়ো করে সে জলকে বালতি বা অন্যতর উপায়ে তোলা হত। অথচ এখন আর তার ব্যবহার নেই।
কুয়ো থেকে জল তুলে খালি করে নিলেও সেটি আবার ভরে যায়। কূপভিত্তিক ভূজলের উপযোগ এ দেশে হাজার বছর ধরে চলে আসছিল। এ দিকে ভূজল ভাণ্ডার থেকে তোলা জলের বেহিসেবি খরচ আরম্ভ হল পাম্পকে ভূজল তোলার কাজে লাগানোর সময় থেকেই। পাম্প করে অল্প সময়ে অনেকখানি জল তোলা যায়, এ থেকেই ভূজলকে তুলে সেচনির্ভর ফসলের পরিকল্পনা। গভীর নলকূপ আসার আগে হাতে খোঁড়া কুয়ো থেকেই ভূজলকে ব্যবহার করে সেচের কাজ একটা সীমার ভেতরে সুষ্ঠু ভাবে চলছিল। ভারতের নাতিশুষ্ক অঞ্চলগুলিতে হাতে খোঁড়া কুয়োর সাহায্যে হাজার হাজার হেক্টর জমিকে সিঞ্চন করায় বর্ষা ও শীত মরসুমের চাষবাস অবাধে চলছিল প্রায় শখানেক বছর ধরে।
তা হলে আজ কেন আর এর উপর আমাদের আস্থা নেই? সত্যি বলতে কী, নির্ভরশীলতা তো নদী-নালা, পুষ্করিণী, লেক, বাঁধ, অতি গভীর খোলা কূপ বা বাউড়ি, এ সবের কোনও কিছুর উপরেই আজ আর নেই। সেই সব অনাস্থার মূলেও রয়েছে ভূজল। কারণ এই সমস্ত জলাধারই প্রকৃতিতে একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি মিশে থাকে। ভূজলের আধার সামগ্রিক ভাবে একটি হলেও জমির ওপর, উপযোগিতার নিরিখে, তা বিভক্ত হয়ে থাকে। ভূজলকে পাম্প করা মাত্রই আশেপাশের সব জলাধারের জল এসে তার আগের জায়গাটা ভরে দেয়। সেই সময়ে দাতা যে জলাশয়, কুয়ো বা ভেজা মাটি, তাও খালি হতে থাকে। এই ভাবেই একে একে সব জলাধারই শুকিয়ে আসে, বিশেষত প্রলম্বিত গ্রীষ্মে।
এখানে মৌলিক সমস্যা দু’টি। দু’টিই জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। জনসংখ্যা বৃদ্ধি মানেই আনুপাতিক ভাবে বেশি পানীয় জলের চাহিদা। খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে, পানীয় জলের সঙ্কট আসলে অল্প কিছু এলাকার ওপরই পড়ে, এবং স্থানীয় স্তরেও এর সমাধান থাকে। পানীয় জল ও সেচ এই দু’টি চাহিদার রকমফের আছে। পানীয় জল বছরের সব দিনই লাগলেও সেই চাহিদার সূক্ষ্ম হেরফের থাকে। গ্রীষ্মকালে চাহিদা বেশি হয়, জলাধারগুলি শুকোতে আরম্ভ করে। তাই গ্রীষ্মে পানীয় জলের জোগান দেওয়া পুর সংস্থাগুলির কাছে একটি বিশেষ চ্যালেঞ্জ। পানীয় জলের দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হল মেগাসিটির বিস্তার। দিল্লি, হায়দরাবাদ, মুম্বই, বেঙ্গালুরু গত ত্রিশ বছরে যে হারে বেড়েছে, তাতে পুর সংস্থাকে অল্প সময়ের মধ্যে নতুন জলাধার খুঁজতে হয়েছে বা চেনাজানা আধার থেকেই আরও বেশি জল তুলতে হয়েছে। বা জল আমদানি করার কথাও ভাবতে হয়েছে।
অর্থাৎ আমরা প্রকৃতিদত্ত জলের থেকে ক্রমাগত বেশি জল খরচ করে যাচ্ছি। বর্ষায় প্রাকৃতিক এবং মানবনির্মিত জলাধারগুলিতে যা জল জমে, তাতে ওই সময়কার জলের জোগান দেওয়া সম্ভব হয় না। অনেক অবস্থাতেই সারা বছরের খালি হওয়া ও ভরে যাওয়ার চক্রটি সম্পূর্ণ হয় না, তার আগেই নতুন বছরের জল খরচ আরম্ভ হয়ে যায়।
তবে কি ভূজল নিয়ে এত কিছু করাটা ভুল হয়েছিল? না। আমরা দেখেছি ভূজল প্রযুক্তির কারণে দেশের যে সব অবহেলিত গ্রাম ও টুকরো বসতিতে হাতে-খোঁড়া কুয়োগুলি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল, সেখানে ফের পানীয় জল আনা গিয়েছিল। কুয়োর জলে অল্প হারের সেচনের জায়গায় সেচকাজ ব্যাপকতর ও জীবনযাত্রা সহজতর হয়ে উঠেছিল। যদি ভূজলের প্রকৃতি বুঝে পাম্পের গতিকেও সীমার মধ্যে চালানো হত, তবে কোনও সঙ্কট হত না। কিন্তু ভূজলের পরিবর্ধিত প্রযুক্তি নিয়ে কোনও সুষম ব্যবস্থা তৈরির আগেই আপামর উপভোক্তার হাতে এসে পড়ল সেই ব্যবস্থা। শুরু হল যথেচ্ছাচার।
১৯৮৭ সালে দেশে জলনীতির প্রথম খসড়া আনা হল কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে (সংবিধান অনুযায়ী কিন্তু জল রাজ্যের বিষয়)। পানীয় জলকে অন্যান্য প্রয়োজনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হল। কিন্তু সঙ্গে কিছু ভুল নীতিকেও প্রশ্রয় দেওয়া হল।
ড্রিল করা গভীর নলকূপ খনন জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর অল্প সময়ের ভেতরেই হাতে খোঁড়া কুয়োগুলি অকেজো হতে শুরু করল। শক্তিশালী পাম্প দিয়ে দ্রুত জল তোলার কারণে হাতে খোঁড়া কূপগুলির জলের স্তর নেমে যেতে থাকল। ক্রমে সেগুলি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ল। দেশের এক-এক এলাকায়, কুয়োর জল সেচের কাজে ব্যাপক ভাবেই ব্যবহৃত হত, এখনও কিছুটা হয়। পূর্ব ভারতের ছোটনাগপুর, ঝাড়খণ্ড-সহ বাংলার রাঢ় অঞ্চল ও ওড়িশার কয়েকটি জেলার মতো যে এলাকা হাতে খোঁড়া কুয়োর ওপর নির্ভরশীল, সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বৃষ্টিপাত কম। প্রকৃতিতে জল ধরে রাখার যে মৌলিক দু’টি আধার, ভূমির মাটিতে ধরা জল (যাকে বলে সয়েল ময়েশ্চার) ও ভূ-অন্তর্বর্তী জল বা ভূজল (যাকে বলে গ্রাউন্ড ওয়াটার), দু’টিই এই অঞ্চলে কম। ফলে এ সব জায়গায় কুয়ো ও মুক্ত জলাধারই গ্রীষ্মকালে ভরসাযোগ্য। এদের জলধারণক্ষমতা খোলা জলাশয়গুলির মোট জলধারণক্ষমতার থেকে অনেক বেশি, যে কারণে গ্রীষ্মকালে এই দু’টি আধারের আশ্রয়ে মুক্ত জলাধারে জলক্ষরণ গ্রীষ্মকালেও অব্যাহত থাকে। বর্ষায় যেখানে মুক্ত জলাধারগুলির জল ভূজল ও ভূ-আর্দ্রতাকে পুষ্ট করে সেখানে গ্রীষ্মকালে প্রকৃতির এই প্রকরণটিরই উল্টো পথ ধরে মাটিতে ধরা জল হাতে খোঁড়া কূপ ও জলাশয়গুলিতে জল সঞ্চার করতে থাকে। তাই বলা যায়, শুষ্ক অঞ্চলে, যেমন রাজস্থান, গুজরাত, মধ্য মহারাষ্ট্র, মধ্য কর্নাটকে ভূজলে সেচন পুরোপুরি বন্ধ করে দিলে এ সব এলাকাতেও গ্রীষ্মকালে পানীয় জলের অভাব থাকবে না। এই ভাবে খরা রোধ করা যাবে নাতিশুষ্ক অঞ্চলগুলিতেও। রবিশস্যের চাষে যেমন ধান বা আখের জন্য ভূজল ভাণ্ডার থেকে জল তোলা মোটেও ঠিক নয়। অথচ এই কুঅভ্যাসটি অনেক দিন চলে আসছে। এই সব কারণেই বৃষ্টিপাত কম হলে বা বর্ষা দেরিতে এলে উৎকণ্ঠা এতখানি বাড়ছে। এই ভূমিআর্দ্রতার জলটিই আগে ফুরোয়। বাস্তবিক, এ দেশে এই শুকিয়ে যাওয়াটা শুরু হয় জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতেই। জলাশয়ে যতটুকু জল দেখা যায়, তারও বেশি জল আশপাশের জমির ভেতরে ধরে রাখা থাকে। সেচের সময় জলাশয়টি খালি হয়ে এলে সেই ভূজল গড়িয়ে এসে জলাশয়কে ভরায়। জলাশয়গুলি ঠিক চৌবাচ্চা নয় যে যতটুকু জায়গা দেখা যাচ্ছে, ততটুকুই শুধু তার জল। এই কারণে জলাশয়ে জলের স্তর নেমে এলে আশপাশের জমিও জলরিক্ত হয়ে যায়, ও সেই জমির চার পাশের মাটির জল বা সয়েল ময়েশ্চারও শুকিয়ে আসে।
গভীর নলকূপ অবশ্য সম্পূর্ণ ভাবে খালি হয় না কখনও, কেবল ভূজলের ভাণ্ডার পুরো খালি হলে তবেই তা হওয়া সম্ভব। এখানে প্রশ্ন, ভূজলের এই ভাণ্ডারটি জমির ওপর কতটা প্রসারিত? জমির বিস্তার যতটা, ভূজলও ততটাই বিস্তৃত। যাঁরা ভূজল ব্যবহার করেন তাঁরা যদি বুঝে নেন যে, বর্ষা বা বৃষ্টিপাতের জলই ভূজলের ভাণ্ডারটিকে ভরে, তা হলে বর্ষার দিকে তাকিয়ে তাঁদের পক্ষে নির্ণয় করা সম্ভব যে কতখানি জলের উপর নির্ভর করা যায়। এক সময়কার গ্রামে গ্রামে গ্রীষ্মকালীন হাতে খোঁড়া কুয়োগুলির জল (ভূজল) সংরক্ষণ হত এই জন্যই।
মধ্য ভারতের এক বিশাল শুষ্ক অঞ্চল বুন্দেলখণ্ডের বারোটা জেলা জুড়ে বিস্তৃত। এখানে ভূজল ধরা থাকতে পারে শুধুমাত্র একটা অগভীর মাটিপাথরের স্তরে। তলার পাথরটিতে জল ধরে রাখার কোনও রন্ধ্র নেই। এখানে বৃষ্টিপাত হয় কম ও অনিয়মিত। কিন্তু তবুও এ জায়গা মরুভূমি হয়ে যায়নি। কেননা, এখানকার প্রাচীন বিচক্ষণেরা জল ধরে রাখার জন্য বিশাল বিশাল পুষ্করিণী নির্মাণ করেছিলেন। কেননা, এখানকার চাষিরা আগেই নির্ণয় করে নিতেন, বর্ষার চাষ কতখানি জমি জুড়ে হবে এবং তাতে কী কী ফসল বোনা হবে।
আসলে রাজ্যের জলনীতি ও রাজনীতিতে জলবিষয়ক ভাবনাকে প্রকৃতিগত জলের সঙ্গে সৎ ভাবে জোড়া হলে দেশে জল সুরক্ষিতই থাকার কথা। এখন আমরা যে পরিস্থিতি দেখতে পাচ্ছি, তাতে এই সমন্বয়ের অভাবই দৃশ্যমান। মনে রাখা দরকার, দেশের পানীয় জল এবং সেচের জলকে ভরসাযোগ্যতার জায়গায় আনার জন্য এখনই জলব্যবস্থার কিছু রদবদল চাই। কে তা করবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy