সবাই মিলে আনন্দে। ফাইল ছবি
বর্তমানে স্কুলস্তরে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই সবার আগে উঠে আসে শিশু মনস্তত্ত্বের প্রসঙ্গ। তবে শিক্ষাবিদেরা মনে করেন শিশু মনস্তত্ত্বের পরিধি এত বিশাল যে শুধুমাত্র শিক্ষাকেন্দ্রিক ভাবে তাকে বিশ্লেষণ করলে অন্ধের হাতিদর্শনের চেষ্টাই হবে। শিশুমনে সব সময়েই পছন্দ-অপছন্দ, ইচ্ছা-অনিচ্ছার দ্বন্দ্ব চলে। শৈশবের ভাল-মন্দ অনেক ঘটনার রেশ থেকে যায় ব্যক্তির পরবর্তী জীবনে। মনোবিদেরা মনে করেন, শৈশবের কোনও একটি ঘটনার অভিঘাত পরবর্তী জীবনের কার্যকলাপকে বহুলাংশে প্রভাবিত করে। ফলে শৈশবে অর্থাৎ জীবনের প্রথম পর্যায় থেকেই তার মানসিক গঠন ও আচার আচরণকে একটি নির্দিষ্ট পথে চালিত করতে শিক্ষার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। একটি শিশুর আচার আচরণ দেখে, তার মনোগঠনের প্রকৃতি বুঝতে চেষ্টা করেন শিক্ষক-শিক্ষিকা ও অভিভাবকেরা। শিশু মনস্তত্ত্বের প্রথম ধাপ হল— তার আচার আচরণের মধ্যে দিয়ে শিশুটির মনোজগৎকে চেনার চেষ্টা করা।
মনোবিদদের মতে, শিশুর মনোজগৎ এবং বড়দের জগতের মধ্যে একটা বিপরীতমুখী চিন্তার প্রাচীর রয়েছে। সেই প্রাচীর ভাঙার কাজ শিশুর নয়, বড়দেরই। বড়রা যে বিষয়কে ‘অমূলক’ বা ‘কাল্পনিক’ বলে মনে করেন তা হয়তো কোনও শিশুর কাছে এক দারুণ ঘটনা হিসেবে প্রতিভাত হয়। একই ভাবে বড়রা শিশুর যে অনিচ্ছা বা ভয়কে ‘অমূলক’ বলে বলে ভাবেন তা হয়তো শিশুর কাছে এক দারুণ দুর্দৈব হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, গ্রাহাম গ্রিনের ‘এন্ড অব দ্য পার্টি’ গল্পের সেই ছোট ছেলেটির কথা। ছেলেটি অন্ধকারকে ভয় পেত। লুকোচুরি খেলায় তাই তার ছিল অনীহা। কিন্তু বড়রা তার ভয়কে ‘অমূলক’ বলে মনে করতো। তাই প্রতিবেশীর জন্মদিনে তাকে এক প্রকার জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সে যেতে অস্বীকার করেছিল। কারণ, সে জানতো সেখানে গেলেই তাকে লুকোচুরি খেলতে হবে। কিন্তু তার আপত্তি অগ্রাহ্য করে তাকে এক প্রকার জোড় করে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অন্ধকার তাকে চিরতরে গ্রাস করে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে। আবার একই বার্তা পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পে। ফটিক নতুন জায়গায় ভাললাগাহীন জগতের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত মৃত্যু তাকে সেই জগত থেকে উদ্ধার করে।
মনে রাখা প্রয়োজন শৈশবেরও একটা নির্দিষ্ট চাহিদা রয়েছে। তাকে অস্বীকার করে বড়রা যদি নিজেদের মন গড়া কোনও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে যান তা হলে সেই জগতের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া অবশ্যম্ভাবী। এই ভাবনাচিন্তার জগতের যে স্তরগুলি রয়েছে তার দিকে নজর না দিলে তার বিকাশের পথ ও অভিমুখটিকে সম্পূর্ণ ভাবে চেনা যায় না। এখানেই আধুনিক সভ্যতার সবথেকে বড় দ্বন্দ্ব। আগেকার দিনে সমাজ যখন একান্নবর্তী পরিবারে বিভক্ত ছিল তখন নানা বয়সী শিশু একসঙ্গে খেলাধুলো করে নিজেদের মতো করে একটা জগত তৈরি করে নিত। সেই জগতের সঙ্গে বড়দের জগতের সঙ্ঘাত তৈরি হলে তার কপালে জুটত তিরষ্কার ও বকুনি। কিন্তু বর্তমান পরিবেশে অধিকাংশ পরিবারই ‘নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি’-র ধারণায় বিশ্বাসী। সেই জগতে শিশুর জগত গড়ে ওঠে তার বাবা-মাকে কেন্দ্র করেই। আর বাবা-মায়ের কাছেও একমাত্র সন্তান হয়ে ওঠে পরম স্নেহের পাত্র। শিশুর সব রকমের চাহিদাকে পূর্ণ করতে গিয়ে তাঁরা অনেক সময় এমন কিছু আবদারে সায় দিয়ে ফেলেন যা তার মনোজগতকে বিরূপ ভাবে প্রভাবিত করে। তার মধ্যে ‘যা চাইবো তা আমায় পেতে হবে’ এই ধারণার সৃষ্টি হয়।
এই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির ধারণার সঙ্গেই আরও একটি বিষয় জড়িয়ে রয়েছে তা হল শিশুদের চাহিদার জিনিসপত্রের তারতম্য। আগেকার শিশুদের জন্য সে ভাবে কোনও খেলার সামগ্রী প্রয়োজন হত না। বরং এক সঙ্গে খেলাধুলো করতে করতে করতেই সময় কেটে যেত। কিন্তু এখন ছোটদের খেলার সঙ্গী সে ভাবে না থাকায় তার জায়গা নিয়েছে মোবাইল, কার্টুন-সহ নানা বৈদ্যুতিন পণ্য ও মাধ্যম। আগে শিশুদের জন্য যে পুস্তকগুলি ছিল তা ছিল বয়সের মনস্তত্ত্বের সঙ্গে সমাঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন প্রথম দিকে ‘টুনটুনির গল্প’ থেকে শুরু করে ‘রামের সুমতি’ পড়ত শিশুরা। ধাপে ধাপে নিজের অতীত ও সংস্কৃতিকে বোঝার একটা স্তর তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মোবাইল-নির্ভর ভার্চুয়াল জগত শিশুর মনোজগতের বিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়—এমন অভিযোগ শোনা যায়। ফলে আজকের প্রজন্মের শিশুদের মধ্যে অনেকেই বয়সের তুলনায় ‘অতিরিক্ত পরিপূর্ণতা’ দেখতে পান।
কিন্তু এই অতিরিক্ত পূর্ণতা সব সময়েই যে খারাপ এমন নয়। অতিরিক্ত পূর্ণতা শিশুকে বহু বিপদ সম্পর্কে আগাম সতর্ক করে দেয়। কিন্তু এর খারাপ দিকও রয়েছে। এই জগত অনেক সময়েই তাকে অজানাকে জানতে ও অচেনা চিনতে এত বেশি উদগ্রীব করে তোলে যে তার টানে সে দিশাহারা হয়ে পড়ে। তারই ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করে বিপদ। বিগত কয়েক বছরে আমরা দেখেছি ‘ব্লু হোয়েল’, ‘মোমো’-র মতো মারণ খেলা কী ভাবে প্রাণ কেড়েছে। আবার পারিবারিক জীবনে বাবা-মায়ের মধ্যে অশান্তির মতো ঘটনা একটি শিশুর উপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই শিশুদের পরিস্থিতি অনুসারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তৈরির জন্য ধাপে ধাপে তার মনস্তত্ত্বকে বিকশিত দিতে হবে। এই বিকাশের ক্ষেত্রে বই পড়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
বদলে যাওয়া এই সমাজে দায়িত্ব বাড়ছে শিক্ষকদেরও। এক দিকে, যেমন শিক্ষার্থীকে কোনটা ভাল কোনটা মন্দ এবং কেন মন্দ তা বোঝানোর তাগিদ রয়েছে অন্য দিকে, তেমনই শিক্ষার্থীর কল্পনাবৃত্তি ও সৃজনশীলতার বিকাশের জন্যও পরিকল্পনা নেওয়াও জরুরি হয়ে পড়েছে। সেই কারণে, নতুন করে সাজানোর দরকার পাঠ্যক্রমকেও। বর্তমানে বিভিন্ন প্রাথমিক ও প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের খেলার মধ্যে দিয়ে শিক্ষার জন্য নানা পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। পাঠ্যক্রমে বাড়ছে শিখন সহায়ক উপকরণের ব্যবহারও। তবে শিশুর কল্পনাবৃত্তির বিকাশের জন্য ও তার জগতকে সুস্থ ও সুন্দর করে তোলার জন্য বই পড়ার অভ্যাস ছোট থেকেই গড়ে তোলার দিকে নজর দেওয়াটা বাঞ্ছনীয়। উচ্চ প্রাথমিক স্তরে শিশুর সামাজিকীকরণ ঘটানোর জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্র সমীক্ষা, সচেতনতামূলক কর্মসূচিতে তাদের শামিল করা হচ্ছে। তাই আমাদের প্রত্যেকরই উচিত নিজেদের সন্তানের চাহিদাকে বোঝা এবং তার মানসিক চাহিদাগুলিকে সুস্থ-স্বাভাবিক দিকে প্রবাহিত করে এক জন সুস্থ নাগরিক গড়ে তোলে সে দিকে নজর রাখা।
প্রধান শিক্ষক দুর্গাপুর বিদ্যাসাগর মডেল হাইস্কুল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy