মস্ত একটা বাক্স। ভিতরে কিছু নেই, বাইরেটা মোড়া খবরের কাগজ দিয়ে, উপরে আবার লাল কাপড়ের টুকরো দিয়ে বাঁধা ফুলের মতো একটা ‘বো’। পাভলভ হাসপাতালের আবাসিক বিপ্লব লাজুক মুখে সেই উপহার তুলে দিয়েছেন তাঁর মওরাদিদির হাতে। বিদেশিনি মওরা হার্লি পাভলভের আবাসিকদের কেক তৈরি করা শেখাতেন। তাঁর চলে যাওয়ার দিন হাসপাতাল চত্বর ঘুরে একটা পরিত্যক্ত কার্ডবোর্ডের কার্টন, কিছু কাগজ আর লাল ছেঁড়া কাপড় কুড়িয়ে এনে বিপ্লব তৈরি করেছেন এই উপহার। ‘‘আমার আর তো কিছু নেই, এই বাক্সটা দিলাম!’’
মনোরোগীদের দয়ার পাত্র বলে দেখা হয়। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে তাঁদের করুণা, সহমর্মিতার এমন প্রকাশ দেখেছি, যা অভিভূত করেছে। প্রতি বছর ১০ অক্টোবর পালিত হয় আন্তর্জাতিক মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। অক্টোবর জুড়ে সচেতনতা প্রসারের চেষ্টা করা হয়। এ বছর ‘থিম’ হল ‘কাইন্ডনেস’: করুণা, দয়া, দরদ। যে মানসিকতা থেকে মানুষ পাশের জনের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।
মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে করুণা বা দয়ার সম্পর্ক কোথায়? মানসিক রোগীরা এ সমাজে প্রান্তবাসী, নিষ্প্রয়োজন। সমাজ তাঁদের কোনও কাজেই ডাকে না। যদিও কাজের সুযোগ পেলে ‘মনোরোগী’ পরিচয় অতিক্রম করে তাঁরা ‘কর্মী’ও। যেমন, পাভলভ হাসপাতালে লন্ড্রি ‘ধোবিঘর’-এ কর্মরত আবাসিকরা। রীতিমতো পেশাদারদের মতো কাজ করেন, তার জন্য পারিশ্রমিকও পান। এক দিন আমাকে ঘামতে দেখে কর্মীদের এক জন, নারান, একটা ট্যালকম পাউডার কিনে দিতে চেয়েছিলেন। কী ভাবে ব্যাখ্যা করব নারানের এই ইচ্ছাকে? করুণা?
পুজোর সময়ে কিছু আবাসিককে ঠাকুর দেখতে নিয়ে যাওয়া হয়, পাত পেড়ে খাওয়া হয়। এক বার খাওয়ার সময়ে কমলদা কিছুতেই খাবেন না, তাঁর নাকি খুব পেটব্যথা। শুধু দইভাত খেলেন। লাস্ট ব্যাচ যখন বসছে, তখন খবর এল, কমলদা উল্টোপাল্টা কাণ্ড করছেন। গিয়ে দেখি, সকালের জলখাবারের লুচি থেকে দুপুরের মাছ, সব ঝোলায় ঢোকাচ্ছেন। এ কী, কিছুই খেলেন না, এ ভাবে সব তো মাখামাখি হয়ে গেল! কমলদা তখন বলছেন, ‘‘নাটু তো আসতে পারেনি, তাই ওর জন্য নিয়ে যাচ্ছি!’’ শেষে মিষ্টির বড় বাক্সে সব খাবার ওঁর বন্ধুর জন্য গুছিয়ে দেওয়া হল! সে বার থেকে নিয়ম হয়ে গেল, কমলদার বন্ধুর জন্য একটা আলাদা খাবারের প্যাকেট থাকবে।
হাসপাতালের খাবার কেমন, সবারই কমবেশি ধারণা আছে। বছরের একটা দিন ভালমন্দ খেতে পেয়েও সব বন্ধুর জন্য রেখে নিজে দইভাত খাওয়া, এই আচরণকেই কি করুণা বলে? না কি ‘পাগলামি’?
কিছু দিন আগে একটা ভিডিয়ো দেখলাম। এক ব্যস্ত শহরে অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে। একটি পথকুকুর বৃষ্টি থেকে বাঁচতে জড়োসড়ো হয়ে আশ্রয় নিয়েছে একটি সুসজ্জিত দোকানের দরজায়। দোকানের মালিক খানিক পর কাচের দরজাটা খুলে ধরলেন। কুকুরটিও একটু ইতস্তত করে ভেতরে ঢুকে বসল।
এই মায়ার জন্যই তো চিপকো আন্দোলনে মেয়েরা জড়িয়ে ধরেছিলেন গাছেদের। এই দরদ থেকেই তো রাস্তার ভিখারি অত্যন্ত কষ্ট করে জোগাড় করা দুটো রুটির একখানা রেখে দেন পায়ে পায়ে ঘোরা কুকুরটার জন্য! পরোপকার (অলট্রুয়িজ়ম) বলতে আমরা যা বুঝি, তার চেয়ে কিন্তু এই দরদ আলাদা! অপরের জন্য অনেক কিছু করা যায়, কিন্তু তার মধ্যে করুণা বা দরদ থাকবেই, এমন কোনও কথা নেই। ‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি’ বিভাগের কথা মনে করুন! দরদ অনুভব বা প্রকাশের জন্য কিন্তু ধনী বা শিক্ষিত হওয়ার দরকার পড়ে না। কেবল একটি নরম মন চাই।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে যে আমরা ‘করুণাসাগর’ বলি, তা তো এই জন্যই। তিনি কেবল বিধবাদের দুঃখ দেখে সমাজ-সংস্কার করেছিলেন, তা-ই নয়, কন্যা হেমলতা বিধবা হলে তিনিও একাদশীর দিন অন্নজল ত্যাগ করেছিলেন। শেষে মেয়ের অনুরোধে বাধ্য হয়ে ফের অন্নগ্রহণ শুরু করেন। সিস্টার নিবেদিতা যে পরম মমতায় পরিচর্যা করতেন মরণাপন্ন প্লেগ রোগীদের, সে-ও এই করুণার প্রকাশ। আর দলাই লামার কথা, ‘‘আমার ধর্ম খুব সহজ! দয়া-মায়া-করুণাই আমার ধর্ম!’’
বেলজিয়ামে জিল নামে ছোট্ট একটা গ্রাম আছে। সেখানকার বাসিন্দারা অপরিচিত মনোরোগীদের নিজের বাড়িতে রেখে শুশ্রূষা করেন, বিনিময়ে কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা না করেই। বিদেশের বহু কফিশপে মানুষ একটা কফি খেয়ে দুটোর দাম দিয়ে যান, যাতে কোনও নিরাশ্রয়, অভুক্ত মানুষ এক কাপ কফি খাওয়ার সুযোগ পান। এই ছোট ছোট উদাহরণগুলোই আমাদের নতুন ভাবে বাঁচতে শেখায়, এবং একই সঙ্গে যেন এক একটা ঘোষণাও হয়ে ওঠে! স্বার্থপরতার যে সব দৃষ্টান্ত সারা ক্ষণ আমাদের একটু একটু করে মেরে ফেলে, তাদের প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠে এ সব ঘটনা!
ডেসমন্ড টুটু বলেছিলেন, যে যেখানেই থাকুন, নিজের মতো করে ছোট ছোট ভাল কাজ করার চেষ্টা করুন। এই সব ছোট কাজই এক দিন একজোট হয়ে মহীরুহের মতো ছায়া দেবে পৃথিবীকে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy