প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে আমরা অনেকেই কমবেশি চিন্তিত। ‘প্লাস্টিক বর্জন করুন’ এই স্লোগানও বেশ পরিচিত। কিন্তু প্রতি দিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রাত পর্যন্ত আমাদের জীবন জুড়ে থাকা প্লাস্টিক আমরা কেন বা কী ভাবে বর্জন করব, এটা একটা বড় প্রশ্ন ।
প্লাস্টিকের বহু সুবিধা থাকলেও সবচেয়ে বড় অসুবিধা হল, এটি ‘বায়োডিগ্রেডেবল’ নয় অর্থাৎ প্রকৃতিতে মিশে যায় না। পৃথিবীতে প্রথম তৈরি প্লাস্টিকটিও আজও ধ্বংস হয়নি। তাই ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অতিরিক্ত প্লাস্টিক নির্ভরতার কারণে প্রতি বছর তৈরি বর্জ্য ৫.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন ছাড়িয়ে চলেছে। ভারত থেকে সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত প্লাস্টিকের পরিমাণ পৃথিবীর প্লাস্টিক বর্জ্যের ৬০ শতাংশ। ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের সমীক্ষা অনুযায়ী, এ ভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সালে সমুদ্রে মাছের থেকে প্লাস্টিক বেশি হবে। আর এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিকের বিষময় ফল আমাদেরই ভুগতে হবে।
আসলে প্লাস্টিক হল বেশ কিছু যৌগের পলিমার রূপ। এই যৌগগুলি মানুষের শরীরে দীর্ঘমেয়াদি বিষক্রিয়া তৈরি করে। প্লাস্টিকের বোতল বা ডায়াপারে বহুল ব্যবহৃত বিসফেনল ‘এ’, থ্যালেট প্রজননতন্ত্রের ক্ষতি করে। প্লাস্টিকের কাপে বা অন্য পাত্রে গরম পানীয় বা খাবার খেলে তার থেকে যে ডাইঅক্সিন শরীরে ঢোকে তা প্রতিরোধ ক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্য ভাবে কমিয়ে দেয়, মহিলাদের বন্ধ্যত্ব ঘটায়। এ ছাড়াও ‘এন্ডোক্রিন ডিজ়রাপটার’ রাসায়নিকগুলি দেহের হরমোনের কাজে ব্যাঘাত ঘটায় ।
পশুপাখি বা মাছ বহু সময়েই খাবার ভেবে বা খাবারের সঙ্গে প্লাস্টিক খেয়ে ফেলে। তার ফলে তাদের মৃত্যুর কথা প্রায়ই খবরে উঠে আসছে। আবার তাদের থেকেও খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে মানুষের শরীরে ঢুকছে প্লাস্টিকের বিষ।
বিপদ আসে অন্য দিক থেকেও। নর্দমা বা অন্য জমা জলে আটকে থাকা প্লাস্টিকে বিভিন্ন রোগজীবাণু বহনকারী কীটপতঙ্গ, মশা-মাছির জন্ম ও বংশবিস্তার হয়। তা থেকে ডায়রিয়া, ডিসেন্ট্রি, টাইফয়েড, কলেরা, জন্ডিস, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি ইত্যাদি রোগের সংক্রমণ হয়। বহু জায়গায় এই বর্জ্যের পরিমাণ কমাতে পুড়িয়ে ফেলার অভ্যাসও আছে যা একই সঙ্গে বিপজ্জনক। কারণ তা মারাত্মক বায়ুদূষণ করে যাতে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি এমনকি ক্যানসার অবধি হতে পারে। আর তা বেআইনিও বটে। এই বর্জ্য প্লাস্টিকের কারণে তৈরি মিথেন, ইথিলিনের মতো ‘গ্রিনহাউস গ্যাস’ উষ্ণায়ণে প্রত্যক্ষ কুপ্রভাব ফেলে।
প্লাস্টিক থেকে অল্প বৃষ্টিতে জল জমা, বন্যা, তার থেকে জল, মাটি, বাতাসের দূষণ এ সবও ঘটে। জমিতে বা মাটিতে জমে থাকে বলে চাষের আনাজ, গাছের ক্ষতি হয়, মাটির নীচে জল ঢুকতে বাধা পায়। জলসঙ্কটের তা একটি কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দেশজুড়ে জলাভাবের যে সাম্প্রতিক চিত্র তাতে এই বিষয়টি ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ।
নিজেদের আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে প্লাস্টিক দূষণ কমাতেই হবে। রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিবেশ বিভাগের পাঁচ দিনের সম্মেলন থেকে সমস্ত দেশের কাছে ২০৩০ সালের মধ্যে প্লাস্টিকের ব্যবহার ন্যূনতম করার আর্জি রাখা হয়েছে।
প্রথম উপায়, ব্যবহার যথাসম্ভব কমানো। ‘ডিসপোজ়েবল’ প্লাস্টিক বিশেষ করে যে কোনও ক্যারিব্যাগ, প্লাস্টিক কাপ বা গ্লাস, চামচ, প্যাকেটবন্দি জল, স্যাশে, স্ট্র ইত্যাদির ব্যবহার বন্ধ করা বা কমানো খুব কঠিন নয়। বাজার করুন বা না করুন, সঙ্গে একটা ব্যাগ সব সময়ে রাখলে হঠাৎ প্রয়োজনে প্লাস্টিকের প্যাকেট দোকান থেকে নিতে হয় না। মুদির দোকানের জিনিস অর্থাৎ ডাল-চিনি ইত্যাদি নিজের ব্যাগে কাগজের ঠোঙাতে নিন। কোনও জিনিস প্লাস্টিকের প্যাকেটে থাকলে বাড়ি এনে তা ঢেলে রেখে পরের দিন সেই দোকানে ফেরত দেওয়াই যায়।
এ ভাবে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ অর্ধেক করে ফেলা সম্ভব। এর পরে আসছে ব্যবহৃত প্লাস্টিকগুলির বিষয়। সেগুলি বারবার ব্যবহার করলে আরও খানিকটা কমবে বর্জ্য। যে বর্জ্য তৈরি হচ্ছে, সেগুলির যথাযথ ব্যবস্থাপনাও জরুরি। পুনর্ব্যবহার বা ‘রিসাইকেল’ শব্দটি আমাদের পছন্দের হলেও সেই পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব নয় বেশির ভাগ সময়ে। আর তাতেও একটি প্লাস্টিক ৩-৪ বার ব্যবহারযোগ্য করা যায় মাত্র। আদতে তাকে ‘ডাউনসাইকেল’ বলা যায়। এর পরেও যে প্লাস্টিক ঢুকছে বাড়িতে, তা পুরোনো বোতলে ভর্তি করে ‘ইকো-ব্রিক’ বানিয়ে বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করা সম্ভব। এতে খুব অল্প জায়গায় প্রচুর প্লাস্টিক আটকে দেওয়া সম্ভব।
প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য গত বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের থিমই ছিল ‘বিট প্লাস্টিক পলিউশন’। আয়োজক দেশ ভারত। সচেতনতার জন্য ৩ জুলাই দিনটি পালন করা হয় বিশ্ব প্লাস্টিকব্যাগ মুক্ত দিবস হিসেবে। কিন্তু সত্যিই কতটা কমানো গিয়েছে বা যাচ্ছে প্লাস্টিক দূষণ?
এই পৃথিবীতে টিকতে হলে প্রতিটি মানুষকে ভাবতে হবে, দায়িত্ব নিতে হবে। পরিবেশ দফতর, প্রশাসন, সরকারকে মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি উপযুক্ত আইন করে তার কঠোর প্রয়োগে উদ্যোগী হতে হবে। প্লাস্টিক তৈরির ধাপ থেকে শুরু করে বিক্রি, ব্যবহার, বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা প্রতিটি ধাপেই। দীর্ঘমেয়াদি ও সুস্থায়ী উন্নয়নের জন্য ব্যক্তিগত স্বার্থের বদলে ভাবতে হবে পরিবেশের কথা। দেশের মানুষের ভাল থাকার জন্যে ভাল রাখতে হবে মাটি-জল-জঙ্গলকে। সেটা করার চেষ্টাই সত্যিকারের দেশপ্রেম। এই ভালবাসার বীজই বোনা হোক।
চিকিৎসক ও পরিবেশকর্মী, রানাঘাট
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy