Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪

আসুন, আমরাও হয়ে উঠি ‘জলপুরুষ’

উন্নয়নের নামে অবাধে চলছে বৃক্ষছেদন। নদীবক্ষে নির্মিত হচ্ছে অগুন্তি নির্মাণ, বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে নদীর স্বাভাবিক গতি, পলি জমে নদী হারাচ্ছে তার জল বহন ও জল ধারণ ক্ষমতা। লিখছেন জাহির রায়হানআগামী দিনে ভয়ঙ্কর পানীয় জলের সঙ্কটে পড়তে চলেছে দেশ। খুব শীঘ্র শেষ হতে চলেছে দেশের ২১টি নগরীর পানীয় জলের প্রাকৃতিক জোগান।

শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৯ ০৩:৫৬
Share: Save:

পৃথিবীর তিন ভাগ জল, সেই পৃথিবীতেই শুরু হয়েছে পানীয় জলের আকাল। কোনও দিন আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি, এমন দিনও আসতে পারে। এর জন্য দায়ী মানুষের অবিমৃশ্যকারিতা। মাসখানেক আগে তামিলনাড়ুর চেন্নাই শহরে শুরু হয়েছে পানীয় জলের হাহাকার। পাশের রাজ্য কেরল থেকে গ্যালন গ্যালন জল পাঠিয়েও সমাধান হচ্ছে না সেই দুর্যোগের। রাজস্থানে মাত্র কয়েক লিটার জলের জন্য বাড়ির মহিলাদের পাড়ি দিতে হচ্ছে বেশ কয়েক মাইল দীর্ঘ পথ। তবে শুধু তামিলনাড়ু বা রাজস্থান নয়, সারা দেশে ক্রমশ প্রকট হচ্ছে জল নিয়ে আশঙ্কা।

আগামী দিনে ভয়ঙ্কর পানীয় জলের সঙ্কটে পড়তে চলেছে দেশ। খুব শীঘ্র শেষ হতে চলেছে দেশের ২১টি নগরীর পানীয় জলের প্রাকৃতিক জোগান। যার কারণে প্রত্যক্ষ ভাবে প্রায় একশো মিলিয়ন নাগরিকের জীবন সঙ্কটাপন্ন হতে পারে। আবার পানীয় জলের সঙ্কটই বিঘ্নিত করবে দেশবাসীর খাদ্য নিরাপত্তা। কৃষি প্রধান ভারতবর্ষে কৃষিকাজেই ব্যবহৃত হয় প্রায় আশি শতাংশ জল। শুরু হওয়া জল সঙ্কট স্বাভাবিক ভাবেই প্রভাব ফেলবে চাষ-আবাদে। ঘাটতি দেখা দেবে খাদ্যের জোগানে। নীতি আয়োগের প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী ‘এই মুহূর্তে শুধু পানীয় জলের সঙ্কটের কারণেই দেশ জুড়ে প্রতি বছর প্রায় দুই লক্ষ মানুষ মারা যান।’

এখন প্রশ্ন এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে? উত্তরটা খুবই সংক্ষিপ্ত— ‘মানুষ’। পৃথিবীর এক ভাগ মাটি, তিন ভাগ জল। কিন্তু এই বিপুল জলসম্পদের খুব সামান্য অংশই পান করার যোগ্য। আমরা সেটা জানি। এটাও জানি যে, বিশ্বায়নের যুগে জল আজ সর্বজনীন সম্পদ নয়। জল এখন বাণিজ্যিক পণ্যও। জল নিয়ে শুরু হয়েছে ব্যবসায়িক কারবার। অর্থের লোভ মানুষকে করে তুলেছে অবিবেচক। সব কিছুকেই আমরা এখন বিচার করি অর্থের মানদণ্ড দিয়ে। ফলে মানব জাতির ছোট-বড় ভুল এবং বদভ্যাসের কারণে সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছে গোটা মানবজাতি। আমাদের লোভ, লালসা, যথেচ্ছাচার এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রাই একদিন ধ্বংস করে দেবে মানব সভ্যতা এবং এই সুজলা, সুফলা, শস্য শ্যামলা পৃথিবীকে। এ কোনও মিথ্যে ভাষণ বা অসম্ভব পরাবাস্তব নয়; সে সম্ভাব্য, ধ্রুব এবং অলঙ্ঘনীয় সত্য ।

ভারতবর্ষের জলাভূমি, পুকুর, হ্রদ, খাল, বিল-সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক জলাশয়গুলিই জলের চাহিদা মেটানো, জল সংরক্ষণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানীয় জল সরবরাহে দিনের পর দিন পালন করে এসেছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং কার্যকরী ভূমিকা । কিন্তু নগর সভ্যতার বিকাশ, প্রাকৃতিক ভারসাম্যের তোয়াক্কা না করে যথেচ্ছ জলাভূমি, পুকুর ও নদী-নালা ভরাটের ফলে আমাদের জীবন থেকে ক্রমেই বিলীন হচ্ছে প্রকৃতি প্রদত্ত ব্যবস্থাপনা।

উন্নয়নের নামে অবাধে চলছে বৃক্ষছেদন। নদীবক্ষে নির্মিত হচ্ছে অগুন্তি নির্মাণ, বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে নদীর স্বাভাবিক গতি, পলি জমে নদী হারাচ্ছে তার জল বহন ও জল ধারণ ক্ষমতা। যেখানে প্রাকৃতিক ভাবে প্রাপ্ত বিস্তৃত নদী অববাহিকা ও জলাভূমিগুলিই সৃষ্টিলগ্ন থেকে পালন করে আসছিল জল সংরক্ষণ ও ভূ-গর্ভস্থ পানীয় জল ও তার পুনঃসঞ্চালনের গুরুদায়িত্ব। সেগুলোও আজ মানুষের অবিবেচনার শিকার। সেগুলোও একটু একটু করে আজ পৌঁছে গিয়েছে সমাপ্তি পথের প্রায় চূড়ান্ত সীমানায় ।

এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? প্রশ্নটা নিজেদেরই করা উচিত আমাদের। ব্যক্তিগত, ব্যবহারিক ও প্রাত্যহিক জীবনে জলের অপচয় রোধ, অসংখ্য গাছ লাগানো ও তার নিয়মিত পরিচর্যা, বৃষ্টির জল সংরক্ষণ এবং তার পুনর্ব্যবহারে যত্নশীল হওয়া নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু শুধু সেটুকুই যথেষ্ট নয়, এর পাশাপাশি প্রয়োজন জীবন ও পৃথিবীকে ভালবাসা। প্রয়োজন জল ও পরিবেশ সংরক্ষণে সরকারি উদ্যোগ এবং রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রবাসীর ভাল থাকার, ভাল রাখার সদিচ্ছা।

ব্যবসায়ী মুনাফা এবং সর্বগ্রাসী মনোভাবের কবল থেকে জল এবং অক্সিজেনের মতো মৌলিক অধিকারকে সুরক্ষিত রাখতে প্রাকৃতিক সম্পদের জাতীয়করণের কথাও আমাদের ভেবে দেখার সময় এসেছে। ভূ-গর্ভস্থ জলসম্ভার কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলের স্থানিক জলের উৎস নয় বরং তা সামগ্রিক ভাবে মাটির নীচে সঞ্চিত প্রাকৃতিক সম্পদের এক বিপুল ভাণ্ডার। যা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহৃত হচ্ছে মানব সভ্যতায়, মানব কল্যাণে। আবার আবহমান কাল ধরে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে পুনর্সঞ্চিত হয়ে এসেছে সেই অ্যাকুইফার। তাই জলস্তর সংরক্ষণে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে জলের ভূ-তাত্ত্বিক ম্যাপিং এবং কমিউনিটি পার্টিসিপেশন বা পার্টিসিপেটরি গ্রাউন্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্টও জরুরি বিষয়।

আসুন আমরা নিজের স্বার্থে, নিজেদের পরিবার পরিজন ও আগামী প্রজন্মের জন্য আরও একটু দায়িত্বশীল হই। নিজে বাঁচি, পৃথিবীকেও বাঁচাই। কী ভাবে? ভারতের ‘জলপুরুষ’ হিসেবে পরিচিত রাজেন্দ্র সিংহের ঐকান্তিক উদ্যোগে রাজস্থানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জল সঞ্চয় কাঠামো। যেগুলির জন্য একই সঙ্গে হাজারেরও বেশি খরা আক্রান্ত গ্রামে নিশ্চিত হয়েছে জলের জোগান। শুধু তাই নয়, শুকিয়ে যাওয়া পাঁচটি নদীকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের পূর্বের প্রবাহ। ফলে কৃষি উৎপাদন বেড়ে গিয়েছে কয়েক গুণ। ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে সবুজায়ন এবং এ সবের মিলিত প্রভাবে সংরক্ষিত হয়েছে পরিবেশ ও তার জীববৈচিত্র্য। আসুন, নিজেদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে ঘরে ঘরে রাজেন্দ্র সিংহ হয়ে উঠি আমরা।

শিক্ষক, বেলডাঙা এসআরএফ কলেজ

অন্য বিষয়গুলি:

Water Water Crisis Climate Change Chennai
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy