প্রতীকী ছবি।
সিকিমের ভার্সে জঙ্গল ট্রেকিং শুরুর মুহূর্তে আমাদের দলপতি (Group Leader) সকলকে কিছু লজেন্স, চিউইং গাম দিয়ে সতর্ক করলেন খোলাগুলো জঙ্গলের মধ্যে যত্রতত্র না ফেলার জন্য। ‘‘ওগুলো পকেটে রেখে দেবেন, পরে একসঙ্গে কোনও ডাস্টবিন দেখে, সেখানে ফেলবেন’’— এই ছিল তাঁর সাবধান বাণী। কারণ, সিকিম ‘পলিথিন ফ্রি’ জায়গা। এখানে যত্রতত্র পলিথিন, প্লাস্টিক ফেলা নিষিদ্ধ। যদি কেউ দেখতে পায়, সোজা ফাইন এবং হাজতবাস।
আমার নিজস্ব এলাকার ছবি ভেসে উঠল। বাজারে বড় বড় হোর্ডিং দিয়ে পুরসভা পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছেন। দু’দিন সব ঠিকঠাক চলল। তৃতীয় দিন থেকে আবার সেই পলিব্যাগ। আমি বললাম, ‘‘হ্যাঁ রে তোরা শালপাতার ঠোঙা ব্যবহার কর না।’’ ওরা প্রায় সমস্বরে বলে উঠল— ‘‘আর অসুবিধা নেই, ও সব উঠে গিয়েছে।’’
মানে আর ধরপাকড় হবে না, এমনই আশ্বাস দিয়েছেন কোনও কেউকেটা। মনে মনে ভাবলাম, শহরে তো শিক্ষিত-সচেতন মানুষের বাস, তাই তাঁরা বেপরোয়া। আর অশিক্ষিত, সাধারণ, শ্রমজীবী, পাহাড়ি মানুষ অতশত বোঝেন না, তাঁরা প্রকৃতি নির্ভর। কোনও এক জন সচেতন মানুষ নিষেধ করেছেন, সুতরাং, সে কথা তাঁদের শিরোধার্য। সমস্ত সিকিম ঘুরে মাথা নত হয়ে আসে। যততত্র ফেলা কোথাও কোনও পলিথিন নেই। পরিবেশকে তাঁরা কলুষিত করতে নারাজ। পাশাপাশি, আমরা আমাদের মাথা উন্নত রাখতে যত নিষিদ্ধ কাজ করার দুঃসাহস দেখিয়ে বাহাদুরি পেতে চাই। হেলমেট-বিহীন মোটরবাইক চালকের সংখ্যাই রাস্তায় বেশি। পথচলতি মানুষের কানে হেডফোন বা মোবাইল এক ধরনের আধুনিকতা।
সভ্য সমাজ গঠনের জন্য ফ্ল্যাটবাড়ি, শপিংমল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তা কিংবা রেস্তরাঁ বানানোর জন্য হাজার, লক্ষ, কোটি গাছের নিধন যোগ্য চলছে। কিন্তু পাশাপাশি গাছ লাগানোর উদ্যোগ তেমন চোখে পড়ছে না। অরণ্য সপ্তাহ পালনের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় হচ্ছে আর হচ্ছে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। ইদানীং এ বিষয় নিয়ে ‘বসে আঁকো’, ‘শুয়ে পড়ো’, ‘দাঁড়িয়ে লেখ,’ জাতীয়’ বর্ণময় প্রতিযোগিতার আয়োজন লক্ষ করা যায়। এতে পুরস্কার আসে, পরিসংখ্যান বদল হয় না। নম্বরের পারদ চড়ে, নম্রনত প্রাণ জাগে না। ‘মরু বিজয়ের কেতন ওড়াও’… গানে কান ঝালাপালা হয়, কিন্তু তার মর্মবাণী কান থেকে প্রাণ স্পর্শ করে না। শুধু দেখনদারি বজায় রাখার প্রতিযোগিতা। দেখাও দেখাও… কে কত দেখাতে পার!
এত গরম, এত অসহ্য গরম! তার প্রতিকারের উপায় তো হাতের মুঠোয়। সে তো হাতছানি দিয়ে ডাকছে রোজ। মাত্র এক টাকা দিয়ে নিয়ে যান আপনার ঘর ঠান্ডা করার মেশিন! আর বাকি টাকা সহজ কিস্তিতে শোধ করুন। টাকা নেই, আমরা আছি। আমরা দিয়ে দিচ্ছি। আপনি শুধু সই করুন। এ রকম শত শত লোভনীয়, আকর্ষণীয় হাতছানি ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। মনে রাখতে হবে এসি ব্যবহারের ফলে বাতাসে যে পরিমাণ ‘ক্লোরোফ্লুরো কার্বন’ মেশে, তা উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের সমূহ ক্ষতির কারণ। পৃথিবীর উপরে যে বায়ু্স্তরগুলি বর্তমান, তার স্ট্রাটোস্ফিয়ার অঞ্চলে ওজন (O3) গ্যাসের স্তর থাকায়, সূর্যের সব চেয়ে ক্ষতিকারক আলট্রা-ভায়োলেট রশ্মি ভূপৃষ্ঠে পৌঁছতে পারে না। অথচ, ক্লোরোফ্লুরো কার্বনের প্রভাবে ওজন স্তরের ক্ষতি হওয়ায় তার মধ্যে দিয়ে ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মি-সহ নানা বিষাক্ত পদার্থ সরাসরি আমাদের পৃথিবীতে পৌঁছে যাচ্ছে। যার ফলে ক্ষতির পরিমাণ ক্রমশই বাড়ছে। এর ফলস্বরূপ পেলাম গ্রিনহাউস এফেক্ট।
বিভিন্ন ধরনের জ্বালানির প্রভাবে যে বিপুল পরিমাণ কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্যাস পৃথিবীতে জমছে, তার ফলস্বরূপ তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধির অর্থ মরুভূমি সম্প্রসারণ, জলাভাব, মরু অঞ্চলের বরফ গলন ইত্যাদি নানা বিপজ্জনক আবাহাওয়ার পরিবর্তন।
বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, কেবল মাত্র মরু বরফ গলনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে জলস্তর এমন অবস্থায় পৌঁছবে যে, শুধুমাত্র কিছু জমি নয়, দেশ এমনকি, মহাদেশও জলের নীচে চলে যাবার আশঙ্কা আছে। বিজ্ঞানীদের সতর্ক বার্তা— আগামী ২১০০ সালে সমুদ্র জলতল দুই মিটারের বেশি বৃদ্ধি পেতে পারে।
শুধু তাই নয়, উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিপাত অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। ফলে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, নিম্নচাপের প্রভাবে কোথাও অতিবৃষ্টি, কোথাও অনাবৃষ্টির আশঙ্কা যাবে বেড়ে। ফলস্বরূপ আমরা প্রভূত ক্ষতির সম্মখীন হব। যে ভাবে আমরা বর্তমান দশকে আয়লা, হুদহুদ, ফণীর মতো ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী ঝড়ের সম্মুখীন হলাম, তা বিগত দিনে দেখা যায়নি।
এর ফলে কৃষি, শিল্প, মানব সভ্যতার ক্ষতি এমনকি, প্রাণহানির আশঙ্কাও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। বাড়ছে নানা রোগব্যাধি। শ্বাসকষ্ট এমনকি, ক্যানসারের মতো মারণরোগও আমরা আহ্বান করছি। বিশ্ব-উষ্ণায়ন, গ্রিনহাউজ এফেক্টের মতো পরিবেশ দূষণের জন্য আমরাই দায়ী। পরিসংখ্যান বলছে, আমাদের দেশের রাজধানী শহর দিল্লি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বায়ুদূষিত শহর। ২০০৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, কলকাতাবাসীর ৭০ শতাংশ মানুষ শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগছেন। আগামী শতকে পৃথিবীর তাপমাত্রা ৫.৮ বেড়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান বলছে ৭৫ শতাংশ মৃত্যুর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কারণ বায়ুদূষণ।
অথচ, আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আমরাই পারি এ পৃথিবীকে শিশুর শুধু নয়, নিজেদেরও বাসযোগ্য করে তুলতে। প্রচলিত শক্তির পরিবর্তে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জৈব গ্যাস ব্যবহার, অরণ্যভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি, পলিথিন বর্জন, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের বিকল্প সন্ধান, জলের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ— ইত্যাদি ব্যাপারে সচেতন হতে। দৃঢ় সংকল্পের অঙ্গীকারই আমাদের সভ্যতাকে রক্ষা করতে পারে। নতুবা সত্যি সত্যিই ধ্বংসের মুখোমুখি হব আমরা। নয়তো সে দিন দূরে নয়, যে দিন সত্যি হবে— ‘কোথা রবে তোর এ ঘর বাড়ি, কোথা রবে এই সুন্দরের বাহার, এক দিন ভবে দেখবি অন্ধকার…।’
প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক, ঘূর্ণি উচ্চবিদ্যালয়
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy