চাষের কাজেও অবাধে ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার করা হচ্ছে। —ফাইল ছবি।
পুজোর মরসুমে একটি খবর বেশ সাড়া ফেলেছে পূর্ব বর্ধমান জেলা জুড়েই। কাটোয়া পুরসভা জানিয়েছিল, বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করলেই মিলবে দোতলা বা তারও বেশি তল তৈরি করার ছাড়পত্র। জেলার মধ্যে কাটোয়া পুরসভার এই উদ্যোগ বেশ প্রশংসারও দাবি রাখে। উদ্যোগের পিছনে একটিই কারণ, ভূগর্ভের জলের পরিমাণ বাড়ানো। আর এই কাজেই পুরসভা সাধারণ মানুষকে জুড়তে চাইছেন। দোতলা বাড়ির আরও তল বাড়াতে কিংবা একতলা বাড়িকে দোতলা করতে হলে বৃষ্টির জলের সংরক্ষণ করতে হবে। আর তার জন্যই বাড়ির ছাদের উপরে তৈরি করতে হবে, পাঁচ ফুটের একটি জলাধার। সেখানে বৃষ্টির জল ধরে রেখে সেই জল পাইপের মাধ্যমে সরাসরি ভূগর্ভে প্রবেশ করাতে হবে।
পুরসভার তরফে দাবি, পুরসভা এমন উদ্যোগ নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের পরামর্শ অনুযায়ী। কমে যাচ্ছে জলাশয়। বৃষ্টির জল ধরে রাখার প্রাকৃতিক ব্যবস্থা ধাক্কা খেয়েছে বড়সড় ভাবে। বৃষ্টির বিপুল পরিমাণ জল মাটির নীচে ঢুকতে পারছে না। নদীর পথ ধরে তা চলে যাচ্ছে সমুদ্রে। তাই এই মুহূর্তে বৃষ্টির জল ছাদের ওপর ধর আর মাটির তলায় ঢুকিয়ে দাও, এমন বিষয়টি আপাত দৃষ্টিতে মঙ্গলকর বলেই সাধারণের মনে হতে পারে। এ বার প্রশ্ন উঠতে পারে, ভৌগোলিক ভাবে কাটোয়া শহরের অবস্থান ভাগীরথী নদীর তীরে। নদী বিজ্ঞান বলে নদী যে অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, সেই অঞ্চলের ভৌম জলস্তর মাটির খুব কাছাকাছি থাকে। তা হলে, কাটোয়ার ভৌম জলস্তর নেমে যাবার কারণ কী?
কারণটা খুঁজতে গেলে একটু পিছনের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। ২০১১ সালের পর থেকে কাটোয়া শহরে জনসংখ্যার চাপ ক্রমশ বাড়তে থাকে। আর তার কারণেই মাথা পিছু জলের চাহদা ক্রমশ বাড়তে থাকে। পরিবেশ কর্মীদের অভিযোগ, এই সময়ে গজিয়ে উঠতে থাকে একের পর এক বিশুদ্ধ জলের ব্যবসা। এই ব্যবসায় সম্পূর্ণ অবৈধ ও অবৈজ্ঞানিক ভাবে মাটির তলা থেকে জল তোলা শুরু হয়। হিসেব বলছে, এক লিটার শুদ্ধ পানীয় জল উৎপাদনে কম বেশি দু’লিটার জল নষ্ট হয়। এ বার একটা ছোট্ট হিসেব করা যাক। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, কাটোয়া পুরসভার জন সংখ্যা ৮১,৬১৫ জন। ধরে নিলাম পঞ্চাশ শতাংশ মানুষ অর্থাৎ ৪০,৮০৭ জন এই জল কিনে পান করেন। মাথাপিছু পানযোগ্য জলের চাহিদা চার লিটার ধরে ৪০,৮০৭ জনের জন্য মোট জলের জোগান দিতে হয় ১,৬৩,২৩০ লিটার। এ বার লক্ষ করে দেখুন এক লিটার পানযোগ্য জল উৎপাদনে ২ লিটার জল নষ্ট হলে দৈনিক ১,৬৩,২৩০ লিটার বিশুদ্ধ জল উৎপাদনে জল নষ্ট হয় ৩,২৬,৪৬০লিটার। তা হলে, এক বছরে নষ্ট হওয়া জলের পরিমাণ দাঁড়ায় ১১ কোটি ৯১ লক্ষ ৫৭ হাজার ৯০০ লিটার। এই বিপুল পরিমাণ মাটির তলার জল প্রতিবছর নষ্ট হচ্ছে। অতীতে কাটোয়া পুর-এলাকায় প্রচুর পুকুর ছিল। বিগত দশ বছরে ৭০ শতাংশ পুকুর বুজিয়ে বাড়ি ও শপিং মল গড়ে উঠেছে। এমনই দাবি, করেছেন স্থানীয় পরিবেশ কর্মীরা। পাশাপাশি, কৃষিকাজের জন্যও ভূ-গর্ভ থেকে প্রচুর জল তোলা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: দিল্লিকে দেখেও কি আমাদের হুঁশ ফিরবে না
এ বার আর একটি বিষয়ের ওপরে একটু আলোকপাত করতে হবে। বৃষ্টির জল কী ভাবে ধরে রাখতে হবে, তারও একটি পদ্ধতিগত দিক রয়েছে। মরসুমের প্রথমে বৃষ্টির জল যাতে মাটিতে প্রবেশ করানো না হয়। কারণ, বর্ষার প্রথম দিকে বাতাসে প্রচুর পরিমাণে ধূলিকনা ভাসমান অবস্থায় থাকে। তাই বৃষ্টি যখন বাতাসের চাদর ভেদ করে মাটির দিকে নেমে আসে, সেই সময় তার সঙ্গে মেশে প্রচুর ধুলিকনা ও বিভিন্ন বিষাক্ত গ্যাস। এই কারণে সেই সময় বৃষ্টির জলকে ধরে রাখা না হয়, সেই বিষয়ে মানুষকে সচেতন করা দরকার। না হলে দূষিত জল মাটিতে প্রবেশ করালে পৃথিবীর পেটের জলই দূষিত হবে।
কাটোয়া মডেলটির সঙ্গে অনেকটা মিল রয়েছে চেন্নাই মডেলের। চেন্নাই-এ বৃষ্টির জল সংরক্ষণের জনক শান্তাশীলা নায়ার। যিনি ভারতবর্ষে ‘ওয়াটার লেডি অব ইন্ডিয়া’ নামে পরিচিত। তিনি চেন্নাই-এ জল সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করেছিলেন সবার ক্ষেত্রে। তার জন্য তিনি বিভিন্ন রকমের পদ্ধতিকে সাধারণ মানুষের কাছে সরকারি ‘ভর্তুকি’-সহ পৌঁছে দিয়েছিলেন। যার যে রকম আর্থিক সামর্থ্য সে সেই রকম অর্থমূল্যের প্রযুক্তিকে বৃষ্টির জল সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করবে। এতে আখেরে লাভ হয় পুরো শহরটার। বৃষ্টির জল সংরক্ষণের লক্ষ্যপূরণ চেন্নাই এক বছরের মধ্যে করতে পেরেছিল। কাটোয়া যদি তার জল সংরক্ষণের মডেল কেবল মাত্র দোতলা বা বহুতলের জন্য না সীমাবদ্ধ রেখে চেন্নাই-এর মতো সর্বসাধারণের জন্য প্রয়োগ করতে পারে, আখেরে তা হলে, লাভটা হবে সর্বসাধারণের ও আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের।
এক দিকে, জলসংরক্ষণ। আর অন্য দিকে, পুকুর চুরি হবে একের পর এক। তা হলে, স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে। এর জন্য পুকুর বাঁচানোর খুব প্রয়োজন। পুকুরের সঙ্গে বাস্তুতন্ত্রের সম্পর্ক একেবারে সাধারণ মানুষকে সরল ভাবে বোঝানো দরকার। পাশাপাশি, পুকুরের থেকে আর্থিক লাভের দিকটাও বারবার তুলে ধরা উচিত। পুকুরে মাছচাষ ও শখের মাছ শিকারিদের মাছ ধরার বিভিন্ন প্রতিযোগিতা বা ‘অ্যাংলার কনটেস্ট’ প্রভৃতির মাধ্যমে পুকুরের প্রতি মানুষের ভালবাসা তৈরি করা প্রয়োজন।
আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রকৃতির দানকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। তবেই তৈরি করা যাবে জল সঙ্কটহীন পৃথিবী। না হলে পুরো কাজটাই হয়ে যাবে ভবিষ্যত প্রজন্মকে বন্ধক রেখে সাময়িক ভাবে বর্তমান প্রজন্মের আত্মস্বার্থ সিদ্ধি। যা আমাদের কাছে কখনই কাম্য নয়।
লেখক নদী বিশেষজ্ঞ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy