এক জন অগ্রজপ্রতিম বন্ধু বলেছিলেন, তোমরা কে কী ভাবে বিষয়টাকে দেখো জানি না, তবে আমার মতে জীবনের লক্ষ্য হল ‘ফাউ’ সংগ্রহ করা। কথাটা শুনে সে দিন উপস্থিত সকলেই হেসেছিল। এত দিন পরে বুঝি, তিনি সত্যদ্রষ্টা ছিলেন।
এ দিকে, ফাউ-এর প্রতি মানুষের এই দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষাকে উপজীব্য করে যে একটা গোটা জাতিসত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, এ কথা কিন্তু আমাদের দেশের ধুরন্ধর রাজনীতির কারবারিরা আগেই বুঝে গিয়েছিলেন। তাই স্বাধীন দেশে প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাদের কর্মসূচিতে ‘ফাউ’-এর প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত করা শুরু করেছিল। শুরুতে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ অনুপার্জিত প্রাপ্তি অগৌরবের বিবেচনা করতেন বলে ‘ফাউ’-এর প্রস্তাবে কিছু রাখঢাক ছিল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ফলে জনসাধারণ (মানে, ‘ভোটার’) ধীরে ধীরে দাক্ষিণ্যগ্রহণের অন্তর্নিহিত লজ্জা এবং সঙ্কোচকে জয় করে ‘ফাউ’কে ‘হক’ ভাবতে শুরু করেছিলেন। ফলে মত ও পথের ভিন্নতা সত্ত্বেও প্রায় সব রাজনৈতিক দল উদ্বাহু হয়ে ‘ফাউ’ বিতরণের প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল।
এই যেমন, একটি লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করেছিলেন, বিদেশের ব্যাঙ্কগুলিতে গচ্ছিত ভারতীয়দের ‘কালো ধন’ উদ্ধার করে প্রতিটি ভারতীয়ের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পনেরো লক্ষ টাকা দেওয়া যাবে। কথার মারপ্যাঁচটা সকলের পক্ষে ধরা মুশকিল, বিনা পরিশ্রমে পনেরো লক্ষ টাকা প্রাপ্তির লোভ জয় করা আরও মুশকিল ছিল। কিংবা, আরও সাম্প্রতিক নির্বাচনের আগে প্রচারিত হল, ‘ন্যায়’ আনা হবে, প্রতিটি দরিদ্র পরিবারকে মাসে ছ’হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। সম্পূর্ণ বিনাশ্রমে মাসের শেষে নিশ্চিত ছ’হাজার টাকা অ্যাকাউন্টে আসবে! আর এক রকম ‘রামরাজত্ব’!
রাজ্যের দিকে তাকালেও একই ছবি। সত্তরের দশকে ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই’ বলে গলা ফাটিয়ে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেও তখনকার শাসকরা অমোঘ ভাবে সেই ‘ফাউ’ বিতরণের দিকেই ঝুঁকলেন। বেকার ভাতা থেকে শুরু করে স্বজনপোষণ, এবং পার্টির অনুগতদের চাকরি-সহ নানা অনুগ্রহ পাইয়ে দিয়ে এক বিরাট সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি করে রাজ্যে আধিপত্য বজায় রাখলেন।
এই দশকের গোড়ায় রাজনৈতিক পালা বদলের পরও এই সার সত্য বুঝতে ভুল হল না যে, দানখয়রাতিই ক্ষমতার উৎস। বিষমদে মৃত্যুর জন্যে দু’লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ, ক্লাবগুলোকে বার্ষিক অনুদান, ইমাম-মুয়াজ্জিন ভাতা, যুবশ্রী, রূপশ্রী, ইত্যাদি কত শত খয়রাতির প্রকল্প যে চালু হল, গুনে শেষ করা শক্ত। বুদ্ধিজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিকরাও ‘ফাউ’-এর ফাঁদে পড়ে গেলেন!
রাজনীতিকদের মস্ত সুবিধে এই যে, ভোটাররা ‘উন্নয়ন’-এর অর্থনৈতিক সংজ্ঞা নিয়ে মাথা ঘামান না। রাস্তাঘাটের রুটিন সংস্কার, প্রয়োজনাতিরিক্ত আলো, নানা রকম সরকারি দানখয়রাতি এবং সরকারি ভবনগুলোর নীল সাদা রংকেই ‘উন্নয়ন’-এর পরাকাষ্ঠা বলে বিশ্বাস করেন। ‘আত্মনির্ভর’ হয়ে ওঠার ভাবনা তাঁদের কাছে এক অলীক কল্পনামাত্র।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক হল বেকার যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থান নিয়ে ছেলেখেলা। রাজ্যে কর্মী নিয়োগের যতগুলি সংস্থা আছে, তার সবগুলিরই স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে বহু প্রশ্ন উঠছে। একদা রাজ্যের গর্ব পাবলিক সার্ভিস কমিশন-সহ এসএসসি, সিএসসি, মিউনিসিপ্যাল সার্ভিস কমিশন, সবগুলির বিরুদ্ধেই আদালতে রাশি রাশি মামলা। এই অজুহাতে সর্বত্র নিয়োগপ্রক্রিয়া স্থগিত কিংবা মন্থর, যার জন্যে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সফল চাকরিপ্রার্থীরা সদ্যোজাত সন্তান-সহ খোলা আকাশের নীচে দিনের পর দিন অনশনে বসেন। আর এর ফাঁক গলে সরকারি কাজে নামমাত্র বেতনে নিযুক্ত হচ্ছেন চুক্তিভিত্তিক কর্মী। স্কুল-কলেজে পুরনো আমলের পার্ট টাইম শিক্ষকরা তো আছেনই, তার সঙ্গে স্কুলে ইন্টার্ন শিক্ষক নিয়োগেরও প্রস্তাব উঠেছিল। সুষ্ঠু নিয়োগপ্রক্রিয়াকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে সরকারি দফতরে অবাধে চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ। রাজনৈতিক আনুগত্য অটুট রাখার পাশাপাশি সরকারি কাজে দলীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম— পুরো প্রক্রিয়াটাই যাকে বলে ‘সুচিন্তিত পরিকল্পনা’প্রসূত!
চুক্তির ভিত্তিতে নিযুক্ত হচ্ছেন যাঁরা, তাঁরা কেমন আছেন? এঁদের বেতন অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্রম দফতর নির্ধারিত ন্যূনতম বেতনের চাইতে কম। প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, পেনশন ও সরকারি কর্মীদের অন্যান্য প্রাপ্য সুবিধার কিছুই পান না এঁরা। চাকরির নিরাপত্তাও দাদা-দিদির কাছে প্রমাণসাপেক্ষ আনুগত্য-নির্ভর। তবুও নিরুপায় যুব সম্প্রদায়ের কাছে এ এক পরম প্রাপ্তি! কারণ সরকারি তকমা থাকলে ‘অন্য ভাবে পুষিয়ে নেওয়া’র সুযোগ থাকে, ‘পার্মানেন্ট’ হওয়ার প্রতিশ্রুতি খুড়োর কলও এদের প্রাণিত করে।
সব দেখেশুনে নিশ্চিত— রমাপদ চৌধুরীর বিখ্যাত ছোটগল্প ‘ভারতবর্ষ’-এর সেই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মতোই আমরাও ধীরে ধীরে পরান্নপ্রার্থীতেই পরিণত হতে চলেছি!
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy