ভিডিয়ো অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি
দেখে বোঝা গিয়েছিল মারাদোনা হাত লাগিয়েই বলটা ঠেলে দিলেন ইংল্যান্ডের গোলে। নজর এড়িয়ে যায় রেফারির। ’৮৬-র বিশ্বকাপে ২-১ ব্যবধানে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছে যায় আর্জেন্টিনা। খেলার শেষে মারাদোনা বলেন ওটা ছিল ‘হ্যান্ড অব গড’। তিন দশক পরে, বিশ্বকাপ উপলক্ষে এক সাক্ষাৎকারে তাঁর স্বীকারোক্তি: এই প্রযুক্তি সেই সময় থাকলে আমার ‘হ্যান্ড অব গড’ ধোপে টিকত না। আর একটা সাক্ষাৎকারে বলেছেন তিনি: এই ভিএআর আমাকে হাজতবাস করিয়ে ছাড়ত!
ভিএআর— ভিডিয়ো অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি। এক ধরনের উন্নত ভিডিয়ো প্রযুক্তি। যা খেলার প্রতিটা পদক্ষেপের ছবি নিখুঁত ভাবে তুলে পাঠিয়ে দেয় এক দল বিশেষ রেফারির কাছে, তাঁদের মূল্যায়নের জন্য। ২০১৮-র ফুটবল বিশ্বকাপে এই পদ্ধতি নতুন সংযোজন।
এ বারের বিশ্বকাপ শুধু ফুটবলের নয়, প্রযুক্তিরও। বলা চলে, ডিজিটাল বিশ্বকাপ। ক্যামেরার কেরামতিতে খেলার যাবতীয় ত্রুটিবিচ্যুতি শনাক্ত করে ফুটবলকে আরও স্বচ্ছ বিনোদনের উপকরণ করে তোলার বিশ্বকাপ। ভিএআর-এর পাশেই এ বার আর এক দল ক্যামেরা তাক করা গোল লাইনের দিকে। বল বারে লেগে গোল লাইনের কয়েক চুল ভিতরে না বাইরে পড়ল, ছবি তুলে নেয় তারা। যে সূক্ষ্ম তফাত রেফারির খালি চোখে নির্ণয় করা দুষ্কর। এই প্রযুক্তির নাম গোল লাইন টেকনোলজি (জিএলটি)। জিএলটি নিখুঁত ভাবে জানিয়ে দেবে বলটা বারে লাগার পর গোল লাইনের ভিতরের মাটি ছুঁয়ে বেরিয়ে এসেছে, না কি লাইন অতিক্রমই করেনি। জিএলটির ছবি দেখে রেফারি জানাবেন গোল ব্যর্থ, না উল্লাস যথার্থ।
১৯৮৬-র বিশ্বকাপে ভিএআর প্রযুক্তি থাকলে যেমন ‘হ্যান্ড অব গড’ এড়ানো যেত, ১৯৬৬-র বিশ্বকাপে জিএলটি হাজির থাকলে অব্যাহতি মিলত গোল সংক্রান্ত আর এক বিতর্কের ঝড় থেকে। কী ঘটেছিল বাহান্ন বছর আগের সেই বিশ্বকাপ ফাইনালে? ইংল্যান্ডের জিয়ফ হার্স্টের শটে বলটা ক্রসবারে লেগে পড়েছিল। ইংল্যান্ডের দাবি ছিল, বল পড়েছে গোললাইনের ভিতরে। জার্মানদের দাবি, বাইরে। রেফারি ইংল্যান্ডকে গোলটা দিয়েছিলেন। ইংল্যান্ড ৪-২’তে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে জুলে রিমে কাপ জিতে নেয়। কিন্তু ওই গোল নিয়ে বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে আজও বিতর্ক রয়ে গিয়েছে। অনুরূপ ঘটনা ২০১০ বিশ্বকাপেও। জার্মানি ও ইংল্যান্ডের নকআউট ম্যাচ। ইংল্যান্ডের ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড-এর শটে বল ক্রসবারের নীচে লেগে মাটিতে ড্রপ খেতেই পাকড়াও করে ফেলেন জার্মান গোলরক্ষক। ইংল্যান্ডের দাবি ছিল, বল গোললাইন পেরিয়েছে। নস্যাৎ করে দেন রেফারি। বেধে যায় তুমুল বিতর্ক। ম্যাচ হারে ইংল্যান্ড। ভুল স্বীকার করে ফিফা। ইতিমধ্যে কিন্তু বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছে ইংলিশ টিম। শিক্ষা হয় মান্ধাতামনস্ক ফিফার। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে চিন্তাভাবনা শুরু করে গোললাইন প্রযুক্তি ব্যবহারের।
‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আৰ্থ’ থেকে এই ধরনের যাবতীয় বিতর্ক ও বিচ্যুতির ভ্রুকুটিকে নির্মূল করতে মাঠে নেমে পড়েন ফিফার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জিয়োভান্নি ইনফান্তিনো। প্রশাসক হিসেবে এটা তাঁর প্রথম বিশ্বকাপ। খেলার মান উন্নয়নের জন্য তিনি বিশ্বকাপে এনেছেন ভিএআর, জিএলটির মতো প্রযুক্তি। ফুটবলের দুনিয়ায় সম্ভাব্য ‘গেম চেঞ্জার’।
যদিও ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপে গোললাইন প্রযুক্তি প্রথম ব্যবহার করে ২০১৪ সালে। সেপ ব্ল্যাটার তখন ফিফার সর্বময় কর্তা। তবুও বলা যায় তাঁর ১৭ বছরের কার্যকালে, ব্ল্যাটার বিশ্ব ফুটবলে প্রযুক্তিকে অচ্ছুত করে রেখেছিলেন। ফুটবল তাঁর কাছে আবেগের খেলা, যাতে থাকবে শুধু মানব-স্পর্শ। খেলোয়াড়দের ভুলচুক হবে, কোচদের গলদ থাকবে, রেফারিরা মাঝেমধ্যে ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। কোনও রকমের প্রযুক্তির যান্ত্রিকতা ঢোকানো চলবে না এই খেলায়। ইনফান্তিনো কিন্তু ফিফার দায়িত্ব নিয়ে ফুটবলে মানব-আবেগের সঙ্গে প্রযুক্তির আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন সুকৌশলে।
ফিফা এ বার বিশ্বকাপে সোনি-র হক-আই ইনোভেশনস-এর প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। মাঠ ঘিরে স্টেডিয়ামের উপর থেকে হরেক অ্যাঙ্গলে ফোকাস করা চোদ্দো খানা হাই প্রিসিশন ক্যামেরা। সাতটা করে ক্যামেরা দু’দিকের গোলের অভিমুখে তাক করা। সেকেন্ডে পাঁচশো ফ্রেম গতিতে ছবি তোলে ক্যামেরাগুলো। সেই ফুটেজ নিমেষে পাঠিয়ে দেয় ইমেজ প্রসেসিং কম্পিউটারে। বিশেষ সফটওয়্যার গোলের মুখে খেলোয়াড়-রেফারির জটলাকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র বলের অবস্থান নির্ণয় করে, তার থ্রিডি ছবি বানিয়ে, ধরে ফেলে, বল গোললাইন অতিক্রম করেছে কি না। সেই খবর এক সেকেন্ডের মধ্যে পাঠিয়ে দেয় ম্যাচ রেফারির হাতে পরা স্মার্টওয়াচে।
ভিএআর-এর কাজেও রয়েছে ক্যামেরার কারসাজি। তবে গোললাইন প্রযুক্তির থেকে এর কর্মপদ্ধতি আলাদা। রাশিয়ার এগারোটা শহরের যে বারোটা স্টেডিয়ামে এ বারের বিশ্বকাপ খেলা চলছে, তাতে সাকুল্যে ৩৩টা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্রডকাস্ট ক্যামেরা বসানো। এর মধ্যে আটটা সুপার স্লো মোশন, চারটে আল্ট্রা স্লো মোশন। অফসাইড ধরার জন্য আছে আরও দু’খানা ক্যামেরা।
যাবতীয় ক্যামেরা ফিড পর্যবেক্ষণের জন্য ভিএআর টিমে আছেন ফিফার তেরো জন সদস্য। এর মধ্যে এক জন ভিডিয়ো অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি এবং তিন জন অ্যাসিস্ট্যান্ট ভিডিয়ো অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি। এঁরা বসেন মাঠ থেকে বহু দূরে, মস্কোর ইন্টারন্যাশনাল ব্রডকাস্ট সেন্টারের ভিডিয়ো অপারেশন রুমে। খেলার প্রতিটা মুহূর্তের ফুটেজ ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক মারফত চলে যায় ভিডিয়ো অপারেশন রুমে। তার ভিত্তিতে দূরস্থিত রেফারিরা খেলার চারটে বিশেষ ক্ষেত্র কম্পিউটারে যাচাই করেন: গোলের বৈধতা (গোলদাতা অফসাইডে ছিল কি না), পেনাল্টির সিদ্ধান্ত কতটা ঠিক (বক্সের ভিতরে ফাউল বা হ্যান্ডবল হয়েছে কি না), যে খেলোয়াড় সরাসরি লাল কার্ড দেখেছেন তাঁর দোষ কতটা গুরুতর, এবং নির্দোষ খেলোয়াড়কে ভুলবশত শাস্তি দেওয়া হয়েছে কি না।
কোনও বিষয়েই ম্যাচ রেফারি যদি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন বা খেয়াল না করে থাকেন, তখনই ভিএআর টিম রেফারির ইয়ারফোনে সতর্কবার্তা জানিয়ে দেয়। রেফারি তখন খেলা থামিয়ে মাঠের বাইরে বসানো কম্পিউটারে ভিএআর-এর অন-ফিল্ড রিভিউ দেখে ঠিক করেন নিজের সিদ্ধান্ত বহাল রাখবেন না ভিএআরের রায় বলবৎ করবেন। প্রযুক্তির এমন নিপুণ নজরদারি রেফারিকে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। তার প্রমাণও মিলেছে এ বার। তবু বিতর্ক আর অসন্তোষ আছে। যেমন, ফিফার কাছে ক্ষোভ উগরে দিয়েছে সার্বিয়া। সুইৎজ়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলায় পেনাল্টি দেওয়া হয়নি। বিশ্বকাপ থেকে মরক্কোর বিদায়ের পর সে দেশের রয়াল ফুটবল ফেডারেশন রেফারি এবং ভিএআরের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়েছে।
যে কোনও নতুন উদ্যোগে ভুলভ্রান্তি থাকবে, বিতর্ক বাধবে, ক্ষোভ অসন্তোষ মাথা চাড়া দেবে, স্বাভাবিক। নতুন প্রয়াসের ভুল বার করা বা তাকে মেনে নিতে অনীহাও প্রত্যাশিত। কিন্তু ইংল্যান্ডের ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড-এর কথায়: আমার গোল বাতিল হওয়াতে আর দুঃখ নেই; আনন্দ এই যে, ওই একটা ঘটনার জেরে, ফুটবলের সার্বিক উন্নতির কথা ভেবে ফিফা গোললাইন প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে। বহু ভুল সিদ্ধান্তের ক্ষতি থেকে বেঁচে যাবে ফুটবল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy