জেলকুঠুরির পিছন দিকে পায়রাদের নিরন্তর বকবকম, নিভৃত আলাপ-পরিচয় চলে। তাই ওই কুঠুরির বাসিন্দা পিছনের দিকে পায়চারি করতে যেতেন না, পাছে তাদের বিঘ্ন ঘটে। সেলের ঘুলঘুলিতে যে কপোত-কপোতী বাসা বেঁধে আছে, তাদের যাতে কোনও অসুবিধা না হয় তার জন্য নিঝুম রাতেও অতি সন্তর্পণে পদচারণা ছিল বন্দির।
সেই কবি-অধ্যাপক ভারাভারা রাও দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত। অভিযুক্ত ভীমা-কোরেগাঁওয়ে এলগার পরিষদ মামলায়, অভিযুক্ত সিপিআই (মাওবাদী)-র সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে, অভিযুক্ত হত্যার ষড়যন্ত্র মামলায়। এই যাত্রায় কারাবাস হতে চলল প্রায় বাইশ মাস।
অবশ্য, জেলখানা তাঁর দ্বিতীয় বাড়ি। সেই ১৯৭৩ সাল থেকে। লেখার মাধ্যমে হিংসা ছড়াচ্ছেন ভারাভারা, এই অভিযোগে কুখ্যাত মিসা আইনে সে বার প্রথম গ্রেফতার হন এই তেলুগু কবি। তাঁর কবিতার সঙ্গে নিপীড়িতদের কণ্ঠের মেলবন্ধন সেই কবে থেকে। তাঁর কবিতায় ঝরে পড়ে আগুন। শব্দরা যেন প্রতিবাদ করে অন্যায়ের। শুধু শব্দ নিয়ে তাঁর জীবনবোধ ব্যতিক্রমী।
যেমন ব্যতিক্রমী ভারাভারা রাওয়ের প্রতিবাদী সত্তা। বিরোধিতার সত্তা। নিছক বিরোধিতার জন্য নয়, সৎ বিরোধিতা। বার বার তিনি নৈতিকতার জায়গা থেকে বিরোধিতা করেছেন রাষ্ট্রের। তাঁর অবস্থান বরাবরই প্রতিষ্ঠানবিরোধী। পৃথক তেলঙ্গানা রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন হোক বা কৃষকের অধিকার, মাওবাদীদের সাবেক সংগঠন জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর (পিডব্লিউজি) হয়ে সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনা হোক বা আদিবাসী, দলিতদের অধিকার রক্ষা— রাষ্ট্রের চোখে চোখ রাখতে ভয় পাননি ভারাভারা।
গত শতকের ষাটের দশকের শেষ ভাগে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি আন্দোলন তাঁকে গভীর ভাবে আলোড়িত করেছিল। এর সঙ্গেই যুক্ত হয় অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীকাকুলামে সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ। ১৯৬৯ সালে শুরু হয় পৃথক তেলঙ্গানা রাজ্যের দাবিতে তীব্র গণ আন্দোলন। এর গভীর প্রভাব পড়েছিল তেলুগু সাহিত্যেও। প্রবীণ লেখক-কবিদের সংগঠন ‘আরাসাম’ সেই বিপ্লবী ভাবাবেগের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করতে পারছে না বা করছে না, এই মতাদর্শগত লড়াইয়ে সরব ভারাভারা। নিরাপদ দূরত্বে বসে সাহিত্যচর্চা নয়, কবিতাকে তিনি নিয়ে গিয়ে ফেলতে চেয়েছেন আন্দোলনের ময়দানে। পরে তিনি ও তাঁর মতো মতাদর্শে বিশ্বাসীরা তৈরি করেন রেভোলিউশনারি রাইটার্স’ অ্যাসোসিয়েশন, যা ‘ভিরাসম’ নামে পরিচিত।
অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশের গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছেন ভারাভারা। মাটিতে নেমে কৃষকের প্রকৃত অবস্থা বোঝার চেষ্টা করেছেন, দিনের পর দিন তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন, স্বরূপ বুঝেছেন দশকের পর দশক কৃষিজীবীর প্রতি বঞ্চনা ও নির্মম উদাসীনতার। তাঁর উপলব্ধি হয়েছে, মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলি শুধু ভোটব্যাঙ্ক হিসেবেই ব্যবহার করে এসেছে প্রান্তজনদের।
এই উপলব্ধিই প্রকাশ পেতে থাকে ভারাভারার কবিতায়। দিনে দিনে তিনি হয়ে ওঠেন ‘বিপ্লবী কবি’। রাষ্ট্রের চোখে ‘বিদ্রোহী কবি’ও বটে। সভার পর সভা, ঘরোয়া আলোচনা, লেখালিখি— ভারাভারা ও তাঁর বন্ধুরা তুলে ধরেছেন, সরব হয়েছেন কৃষক, প্রান্তিক, দলিত, আদিবাসীদের হয়ে। অন্ধ্রে সশস্ত্র আন্দোলন যখন তুঙ্গে, সে সময় সেখানকার পুলিশ পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের দেখানো পথই অবলম্বন করে। রাজনৈতিক বিরোধিতাকে একেবারে নিকেশ করার পথ। একের পর এক ভুয়ো সংঘর্ষে অতি বাম রাজনৈতিক কর্মীদের হত্যার অভিযোগ ওঠে পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে। মানবাধিকার কর্মী ভারাভারা সে সময় থেকেই ভুয়ো সংঘর্ষের বিরুদ্ধে সরব, বারে বারে দ্বারস্থ হয়েছেন আদালতের।
ভারাভারা রাও সব থেকে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও প্রতিবাদের রাস্তা থেকে সরেননি, সরছেনও না। তিনি ক্ষমতার অলিন্দে পা রাখার চেষ্টাই করেননি কোনও দিন। বরং চিরকালীন প্রতিবাদের কঠিন-কঠোর পথই বেছে নিয়েছেন স্বেচ্ছায়। তাই জেলে গুরুতর অসুস্থ হলেও, স্মৃতিভ্রংশের মতো রোগে আক্রান্ত হলেও, রিপোর্টে কোভিড পজ়িটিভ এলেও আদালতের হস্তক্ষেপ ছাড়া অশীতিপর বৃদ্ধ বন্দির চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত হয় না। সুকৌশলে ভারাভারার মতো ‘বিপজ্জনক’ কণ্ঠ রুদ্ধ করে দেওয়ার প্রয়াস চালাতে হয় রাষ্ট্রকে। বার বার আবেদন করা সত্ত্বেও তাঁর জামিন না-মঞ্জুর হতেই থাকে।
ভারাভারার লড়াই দেখতে দেখতে প্রকৃত স্বাধীনতা প্রসঙ্গে দার্শনিক রোজা লুক্সেমবার্গের সেই অবিস্মরণীয় উক্তি মনে পড়ে যায়, “শুধুমাত্র সরকারের সমর্থকদের জন্য যে স্বাধীনতা, সেটা স্বাধীনতাই নয়... স্বাধীনতা শুধুমাত্র একটি দলের সমর্থকদের জন্য নয়, তা সংখ্যায় যত বড়ই হোক না কেন। বরং স্বাধীনতা সর্বদাই এবং প্রকৃত অর্থে তার জন্য, যে অন্য রকম করে ভাবে।”
এখনকার ভারতে ভারাভারা রাও সেই অন্য ‘স্বাধীনতা’র যোদ্ধা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy