Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
valentine'day

হানাহানির বাইরে একটি দিন

চোখ বুজে প্রেমদিবস পালন কতটা যৌক্তিক সে প্রশ্নে না গিয়ে একটা কথা বলা যায়, ভালবাসার প্রকাশ, দিন দেখে নিশ্চয়ই হয় না। তবু চারিদিকে এত ভেদাভেদ, হানাহানির মধ্যে যদি একটি দিন হিংসা ছাড়া, রক্তপাত ছাড়া, শুধু ভালবাসার জন্য তোলা থাকে, ক্ষতি কী? লিখছেন সুমনা কোনারদিনটা বাকিদের জন্য সাধারণ হলেও প্রেমিক, প্রেমিকাদের জন্য অবশ্যই বিশেষ দিন।

দুর্গাপুরে ভ্যালেনটাইন্স ডে উদ্‌যাপন। ছবি: বিকাশ মশান

দুর্গাপুরে ভ্যালেনটাইন্স ডে উদ্‌যাপন। ছবি: বিকাশ মশান

শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৩:৪১
Share: Save:

কাল চলে গেল দিনটি!

ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ জুড়ে মিমের ছড়াছড়ি!

রেস্তরাঁয় ছাড়ের বিজ্ঞাপন!

শপিং মল থেকে ই-কমার্সের বিভিন্ন সাইটে চলছে ছাড়ের প্রতিযোগিতা!

আর রাস্তার দু’ধারের দোকানগুলি সম্ভারে ভরে উঠেছে, হঠাৎ যেন রঙিন হয়ে উঠেছে চারপাশ!

সবার এই হঠাৎ জেগে ওঠার কারণ, ভ্যালেনটাইন্স ডে।

দিনটা বাকিদের জন্য সাধারণ হলেও প্রেমিক, প্রেমিকাদের জন্য অবশ্যই বিশেষ দিন। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই শুরু হয়ে যায় ভ্যালেটাইন্স ডে’র প্রস্তুতি। এ প্রস্তুতি চলে লুকিয়ে-চুরিয়ে। গোলাপ, চকলেট, টেডি ইত্যাদি ডে পার করে শেষমেষ আসে ভ্যালেনটাইন্স ডে। কিশোর, কিশোরী থেকে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই দিনটি নিয়ে উন্মাদনা থাকে চরমে। নিজের ভালবাসার মানুষটিকে নানা রকম উপহার দিয়ে পালন করেন এই দিনটি। এমনিতে ১৪ ফেব্রুয়ারি কেন ভ্যালেনটাইন্সডে পালিত হয়, তা আমরা প্রায় সকলেই জানি।

অনেক দেশেই পালিত হয় ভালবাসার দিন। তবে অন্য নামে বা অন্য কোনও সময়ে। চিনের উৎসবের পিছনে আছে রাজার মেয়ে আর রাখাল ছেলের প্রেমকাহিনি। ব্রাজিলে জুন মাসে পালন করা হয়। দক্ষিণ কোরিয়াতে আবার ১৪ ফেব্রুয়ারি মেয়েরা ছেলেদের চকোলেট দেয়। আর ১৪ মার্চ ছেলেরা মেয়েদের ফুল, চকলেট, উপহার দেয়। আবার ১৪ এপ্রিল যাঁরা কোনও কিছুই পায় না, তাঁরা ‘ব্ল্যাক নুডুল্‌স’ খেয়ে একাকিত্ব পালন করেন। স্লোভানিয়াতে আবার ভালবাসার দিনটি কৃষির সঙ্গে জড়িত। বসন্তের সূচনায় কৃষির ভাল ফলন আর ভালবাসার দিন এক সঙ্গে পালন করা হয়। তবে বিশ্বায়নের সঙ্গে ১৪ ফেব্রুয়ারি দেশকালের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

অর্থনীতির দিকে চোখ ফেরালে খুব সহজে বোঝা যাবে এর কারণ। ভ্যালেনটাইন্স ডে’র সঙ্গে ভীষণ ভাবে জড়িয়ে আছে কার্ড, ফুল, উপহার। আর্থিক উদারীকরণের পর থেকে বিজ্ঞাপন এবং বাজারের হাতে চলে গিয়েছে প্রায় পুরো অর্থনীতির রাশ। যার ফলে ভ্যালেনটাইন্স ডে উপলক্ষে সুলভে কেনাকাটি থেকে খাওয়াদাওয়া— সবেতেই লেগেছে ‘ভালবাসার ছোঁয়া’। খেয়াল করলে দেখা যাবে, গত ১৫-২০ বছর আগেও কিন্তু ভ্যালেনটাইন্স ডে পালনের এত রমরমা ছিল না। বাড়ির মা, কাকিমারা জানতেন না, এটা খায় না মাথায় দেয়। কিন্তু টিভি, সিরিয়াল আর বিজ্ঞাপনের দৌলতে তাঁদের জ্ঞানভাণ্ডারও এখন পূর্ণ। একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান বললে বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে। গত বছর শুধু আমেরিকাতে ভ্যালেনটাইন্সডে’র দিন ২০.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আর্থিক লেনদেন হয়েছিল। ভারতের ক্ষেত্রেও এই অঙ্কটা কিন্তু কম না। আসলে মানুষ যতই বিশ্বায়িত হচ্ছেন, তত পাল্টাচ্ছে তাঁর মত প্রকাশের ধরন। সেটা ভালবাসা হোক বা হিংসার প্রকাশ।

বড় শহরগুলি তো আছেই, বর্ধমান, দুর্গাপুর, আসানসোলের মতো ছোট শহরগুলিও এখন মেতে ওঠে ভ্যালেনটাইন্স ডে নিয়ে। এটা এখন একটা উন্মাদনায় পরিণত হয়েছে। জুড়ে গিয়েছে সংস্কৃতির সঙ্গে। তবে সেটা সংস্কৃতি না অপ-সংস্কৃতি সেটা নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হয়েছে, আজও হয়। যেমন, মালয়েশিয়াতে এর বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি হয়েছে। একই পথে হেঁটেছে ইন্দোনেশিয়া, ইরান, সৌদি আরব, পাকিস্তানের মতো দেশগুলি। ভারতেও প্রতিবাদ হয়েছে। এ বার উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যেও এর বিরুদ্ধে হুমকি দিয়ে প্রচার চলছে। তবে সেটা নীতি পুলিশগিরির পর্যায়ে, প্রশাসনিক ভাবে নয়। তবে প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন মদত আছে বলেও অভিযোগও উঠেছে।

আসলে ভারতীয় সংবিধানের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি গায়ে যতই ভারী জামা পড়ে থাকুক, তার অর্থটা সুপ্ত ভাবে ভারতীয়দের বিশেষ করে বাঙালির চরিত্রে মিশে আছে। যেমন খ্রিস্টমাস, নিউ ইয়ার থেকে পয়লা বৈশাখ— কোনটাই বাঙালি উদ্‌যাপন করতে ছাড়ে না, তেমনই প্রাচীন এই রোমান উৎসবকেও আপন করে নিতে সময় লাগেনি। বাঁশিওয়ালা প্রেমের ঠাকুরের সঙ্গে দিব্য সোনালি তীর হাতের কিউপিডকে জায়গা করে দিয়েছে।

তবে বর্তমান প্রেক্ষিতে ভ্যালেনটাইন্স ডে পালনের কতটা পরিবেশ আছে সেটা বোঝার জন্য আবহাওয়া দফতরের সাহায্য লাগে না। দেশ জুড়ে এক দিকে অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব, অবশিল্পায়নের অন্ধকার ঘিরে ধরেছে, আর অন্য দিকে রাজনৈতিক নেতারা ভোটের বাইরে কিছু ভাবেন না। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী কেউ ভাল নেই বলে অভিযোগ। কেরল ভালবাসার নামে ‘লাভ জিহাদের’ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কালি মুছতে ব্যস্ত, অন্য দিকে হরিয়ানার খাপ পঞ্চায়েতের হাতে ‘অনার কিলিং’-এর রক্ত। এর বাইরেও আছে উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের অসম প্রেমের করুন পরিণতি। আসলে ভালবাসায় যখন বিভেদ চলে আসে সেটা ধর্মীয় বা অর্থনৈতিক যাই হোক— তার পরিণতি কখনই সুখের হয় না। জাত, পাত, ধর্মের ভাগ বাঁটওয়ারা হতে হতে শেষমেষ দেশের সর্বজনীন পরিচয়টা সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ে। ধর্ম, জাতপাত, লিঙ্গভেদে জর্জরিত একটা দেশে আলাদা করে ভালবাসার দিন উদ্‌যাপনের গুরুত্ব সত্যি প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় আমাদের।

গত বছর সাড়া দেশ যখন ভ্যালেনটাইন্স ডে পালনে মত্ত তখন চুপিসারে উগ্রবাদীরা রক্ত মাখিয়েছে পুলওয়ামায়। এ বছর দেশজুড়ে এনআরসি, সিএএ-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। আর ধর্ষণ তো এখন রোজকার ঘটনা। আলাদা করে বলার দরকার পড়ে না। এই অবস্থায় চোখ বুজে প্রেমদিবস পালন কতটা যৌক্তিক সে প্রশ্নে না গিয়ে একটা কথা বলা যায়, ভালবাসার প্রকাশ, দিন দেখে নিশ্চয়ই হয় না। তবু চারিদিকে এত ভেদাভেদ, হানাহানির মধ্যে যদি একটি দিন হিংসা ছাড়া, রক্ত ছাড়া, শুধু ভালবাসার জন্য তোলা থাকে তো থাকুক না! ক্ষতি কী?

অতিথি শিক্ষক, বিবেকানন্দ মহাবিদ্যালয়

অন্য বিষয়গুলি:

Valentine's Day 14 February Durgapur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy