প্রেম দিবসের আগে বোলপুরে গোলাপের বিকিকিনি। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি, বিশ্ব প্রেম দিবস। বাঙালির ভ্যালেন্টাইন্স ডে সবে পেরিয়ে এলাম আমরা। সরস্বতী পুজোয় শীতের আমেজ একটু হলেও ছিল। তবে এ বার বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। সঙ্গে মনও ফুরফুরে। প্রেমিক প্রেমিকার একে অপরের জন্য প্রেম প্রকাশের দিন এসে গিয়েছে। এই একটি দিন লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রেম প্রকাশের দিন। বজরং দলের ভয়ে সে সুযোগ ছাড়া যায় নাকি?
প্রশ্ন হলো একটি দিন কেন? প্রেমের নিত্য যে ফুল ফোটে ফুলবনে তাকে মরসুমি করে এ ভাবে প্রকাশ করা হল কেন? ফেব্রুয়ারির চতুর্দশ দিবস ছাড়া সম্বৎসরে প্রেম কি শীতঘুমে থাকে নাকি? কী এমন ঘটল এ দিন যাতে বিশ্ব জোড়া কপোত-কপোতী হাপিত্যেশ করে বসে থাকে এই মাহেন্দ্রক্ষণের?
হঠাৎ হঠাৎ মানুষের হৃদয় কারার লৌহকপাটে ঘটে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ। মনে ‘বসন্ত এসে গেছে’র রিংটোন বাজতে থাকে। বিশেষত বাঙালি শনি-মঙ্গলবার মাছ ছাড়া কাটিয়ে দেবে, তাই বলে প্রেম ছাড়া নৈব নৈব চ। তা এমন এক অত্যাবশ্যকীয় বিষয়, ভাত-ডাল-বিরিয়ানির থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সম্মান তো জানাতেই হবে। সমীক্ষা করলে দেখা যাবে, যে কোনও বাঙালির এক বছরের সালতামামি তে একটা (একাধিকও হতে পারে) মিষ্টি প্রেমের গল্প থাকবেই। আর যে বাঙালি একদিনের সরস্বতী পুজোকেও টেনে-হিঁচড়ে এক সপ্তাহে নিয়ে যায়, তারা যে এক দিনের প্রেম দিবসে ক্ষান্ত হবে না সে তো জানা কথাই। গোলাপ দাও, প্রপোজ করো, প্রমিস করো, চকলেট দাও, দামি দামি গিফট দাও তারপর সেই বিশেষ ঘটনাটা—এত্ত বড় লিস্ট মিলিয়ে কাজ কি একদিনে হয় নাকি? তাই এখন আর ভ্যালেন্টাইন্স ডে নয় ভ্যালেন্টাইন্স উইক। সমগ্র প্রেম জীবনের সপ্তাহব্যাপী ‘মিনিয়েচার ভার্সন’।
অনেকেই মনে করেন প্রেমের জন্য আলাদা কোনও দিন হয় না, প্রত্যেকটা দিনই প্রেমের দিন। আবার কেউ কেউ বেশ ঘটা করেই উদযাপন করেন প্রেমের সপ্তাহ। প্রেমের সপ্তাহ শুরু হচ্ছে এই দিনটা দিয়ে। রোজ ডে। ৭ ফেব্রুয়ারি। এই সময় বাজারে নানা রঙের গোলাপ পাওয়া যায়। নানা রঙের গোলাপ দিয়ে প্রেমিক বা প্রেমিকাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার দিন। সপ্তাহের দ্বিতীয় দিনটি প্রোপোজ ডে। ৮ ফেব্রুয়ারি। যারা এখনও পছন্দের মানুষকে জানিয়েই উঠতে পারেননি নিজের ভালবাসার কথা, এই দিন তাঁদের জন্য। ৯ ফেব্রুয়ারি চকোলেট ডে। ১০ ফেব্রুয়ারি টেডি ডে। কথায় বলে ‘প্রমিসেস আর মেন্ট টু বি ব্রোকেন’, তবু কী করবেন বলুন? শীত বিদায়ের এই সময়টারই যত দোষ। কথা দিয়ে দিতে ভারী ইচ্ছে হয়। মন খুলে প্রমিস করুন এই ১১ ফেব্রুয়ারি। শুধু জেনে শুনে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলবেন না, যা আপনি রাখতে পারবেন না। কাছের মানুষকে জড়িয়ে ধরতে কার না মন চায় বলুন? ভালবাসার উদযাপন করতে এই ১২ তারিখ উষ্ণ আলিঙ্গনে রাখুন আপনার ভালবাসার মানুষটাকে। এ বার যাকে বলে ডি ডে। সাত দিন একটু একটু করে যে উদ্যাপন করলেন প্রেমের মরসুম, আজ তা বাঁধনছাড়া হবার পালা। গুগ্ল করে দিন মিলিয়ে মিলিয়ে সব কাজ ঠিক ভাবে করা, একি কম কথা! বাঙালি এই একটা ব্যাপারে ঠিক দিনের কাজ ঠিক দিনে করে, শুধু এটুকুর জন্যই ভ্যালেন্টাইন্স উইককে ‘বঙ্গশ্রী’ দেওয়া যেতে পারে।
অনেক নাক উঁচু বিজ্ঞজনদের অভিমত— এ সব নাকি আমাদের সংস্কৃতি নয়, ভারতীয় ভাবধারার পরিপন্থী চর্চা। কিন্তু বাঙালি আর কবেই বা আপন পরের তোয়াক্কা করেছে? হলফ করে বলতে পারি যত বাঙালির ‘জিংগেল বেল’ মুখস্ত তার এক শতাংশও ‘সত্যনারায়ণ পাঁচালী’ মুখস্ত বলতে পারবে না। আর হুজুগের ব্যাপারে নোবেল থাকলে তা বছর বছর বাঙালির একচেটিয়া সম্পত্তিতে পরিণত হতোই। শান্তিনিকেতনে যে বাঙালি এক কিলোমিটার দূর থেকে কালো কালো মাথায় লাল লাল পলাশ ফুল আর সাদা সাদা খুশকিকে পাস কাটিয়ে একঝলক ‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও’ দেখার জন্য দশ-বিশ হাজার হেলায় খরচ করে, তারা প্রেম নিয়ে হুজুক করবে না তা আবার হয় নাকি?
তবে কিনা ঘুম থেকে উঠে অরিজিৎ সিংহ আর ঘুমোতে যাওয়ার সময় জগজিৎ সিংহ শোনা স্বভাব কবি বাঙালি শুধু প্রেমে খুশি থাকে কি করে? মানুষের চাহিদামতো সপ্তাহব্যাপী আয়োজন পা দিলো দ্বিতীয় সপ্তাহে। আড়াই ঘণ্টার সিনেমায় যেমন অ্যারিস্টটলের ‘কালের ঐক্য’কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ছোট্ট সোহম দৌড়াতে দৌড়াতে প্রসেনজিৎ হয়ে যায়, ঠিক তেমনি এক হপ্তার প্রেম প্রাবল্য
আজকের মধ্যরাত্রি অতিক্রম করেই লিখতে শুরু করে দেবে এক ল্যাং মারার ইতিহাস। প্রেম থেকে শুরু করে ব্রেকআপ। বস্তাভর্তি গিফট আর প্রমিসকে ভুলে গিয়ে আবার নতুন সম্পর্কের জন্য বছর ভরের হাপিত্যেশ। আর ছ্যাঁকা খাওয়া অপরপক্ষের আদা-জল খেয়ে কবিতা লেখার শুরু। তবে এই দ্বিতীয় সপ্তাহের ঘটনাবলী কোনওদিনই প্রথম সপ্তাহকে প্রভাবিত করেনি, করবেও না। জাগ্রত বসন্তের চির উপাসক বাঙালির ফোনে (মনেও) তখন একটাই রিংটোন- ‘যদি এক মুহূর্তের জন্যেও আমায় চাও সেটাই সত্যি’।
লেখক বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ছাত্র,
মতামত নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy