দেড়শত পার হইলেই জরিমানা। ইহা জলের হিসাব। কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের অধীনস্থ জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ কারিগরি সংস্থার নির্দেশিকা বলিতেছে, কলিকাতা, মুম্বই, দিল্লির মতো বৃহৎ শহরে দৈনিক জলের প্রয়োজন মাথাপিছু দেড়শত লিটারের অধিক হইবার কথা নহে। অথচ জল খরচ হইতেছে বহু গুণ বেশি। এমতাবস্থায় বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাব, দৈনিক ব্যবহার্য জলের পরিমাণে ঊর্ধ্বসীমা আরোপ এবং সীমা লঙ্ঘনকারীদের নিকট হইতে জরিমানা আদায়। ইহা সত্য যে, শুধুমাত্র মৌখিক প্রচারে আশানুরূপ ফল মেলে না। আর্থিক জরিমানার ভয় না থাকিলে জল হইতে জঞ্জাল, কোনও বিষয়েই নাগরিকের সুঅভ্যাস তৈরি হইবার সম্ভাবনা কম। অতএব জল নষ্ট করিলে গৃহস্থের জরিমানা করিবার প্রস্তাবটি যুক্তিযুক্ত। জলের অভাব যে বিপুল সঙ্কট হইয়া উঠিতেছে, তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া কলিকাতার কাছে ইহা পরিত্রাণের অন্যতম পথ। কিন্তু পথটি কি পূর্বে জানা ছিল না? কলিকাতা পুরসভার তথ্য বলিতেছে পূর্বেও জল অপচয় রোধ করিতে জলকর, জলের মিটার বসাইবার প্রস্তাব উঠিয়াছিল। হয় নাই কেন? কারণটি অবশ্যই রাজনৈতিক। জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতির হাত ছাড়িতে সরকার সম্মত হয় নাই। জলের উপর কর বসাইলে গৃহস্থ রুষ্ট হইবার, এবং পরিণামে ভোটব্যাঙ্ক হাতছাড়া হইবার সম্ভাবনা প্রবল।
সেই ঝুঁকি লইতে সরকার অনিচ্ছুক। কলিকাতার ছয়টি ওয়ার্ডে মিটার বসিয়াছে, তাহাতে জলের অপচয় ধরাও পড়িয়াছে, কিন্তু তাহার প্রতিকার করিবার উপায় পুরসভার হাতে নাই। কারণ, প্রকল্পটি এখনও পরীক্ষামূলক স্তরেই রহিয়া গিয়াছে। সরকার জলকর বসাইবার ব্যবস্থাও করে নাই, অপচয়ের জন্য জরিমানা করিবার উপায়ও রাখে নাই। সম্প্রতি চেন্নাইয়ের তীব্র জলসঙ্কট এবং প্রায় একই সময়ে নীতি আয়োগের সমীক্ষায় অদূর ভবিষ্যতে মহানগরগুলি জলশূন্য হইবার হুঁশিয়ারি না শুনিলে কবে টনক নড়িত বলা মুশকিল। এখনও যে সরকার জাগিয়াছে, তাহা বলা যায় না। জলকর এবং জল-জরিমানা সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলি লইয়া কলিকাতা পুরসভা এখনও উচ্চবাচ্য করে নাই। অভ্যাস মতো নাগরিকের ‘সচেতনতা বৃদ্ধি’র বুলিটিই আওড়াইতেছে।
জনগণকে জলের সংরক্ষণের বিষয়ে সতর্ক করা প্রয়োজন, তাহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না। নাগরিকের অভ্যাস খারাপ হইবার কারণ, অন্যান্য শহরের তুলনায় কলিকাতার জলের উৎস এবং পরিমাণ অধিক। তাই এত কাল যথেচ্ছ অপব্যবহার সত্ত্বেও নগরের অনেক অংশে প্রকৃত জলাভাব অনুভূত হয় নাই। কিন্তু বেহিসাবি ব্যয়ে কুবেরের ভাণ্ডারও ফুরায়। কলিকাতার ভূগর্ভস্থ জলভাণ্ডারে টান পড়িতেছে। দোসর হইয়াছে প্রোমোটারচক্র। জলাভূমিগুলি দখল করিয়া তাহারা বহুতল বানাইতেছে। কত জলাশয় ‘নিখোঁজ’ হইয়াছে, রোজই তাহার নূতন হিসাব মিলিতেছে। সেই সকল জলসম্পদ পুনরুদ্ধার করিতে হইবে। সেই সঙ্গে জলের সাবধানি, হিসাবি ব্যবহার প্রয়োজন। এলাকার জলাশয়গুলির সংরক্ষণে বহু নাগরিক সংগঠন অগ্রণী হইয়াছে। পুলিশ-প্রশাসনের উদাসীনতা এবং রাজনৈতিক প্রশ্রয়ধন্য দুষ্কৃতীদের জন্যই সেগুলিকে পিছু হটিতে হয়। সরকার যদি দুষ্কৃতীদের সংযত না করিয়া কেবল নাগরিকের উপর কর-জরিমানা আরোপ করিতে থাকে, তাহা এক প্রকার প্রতারণা। সরকারের কাজ ভাঙা কল মেরামত করিয়া, গাড়ি ধুইবার জায়গা নির্দিষ্ট করিয়াই শেষ হইয়া যায় না। জলসম্পদকে রক্ষা করিবার জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ লইয়া একটি সুষ্ঠু এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা লইতে হইবে। তৎসহ, জনমোহিনী নীতি ছাড়িয়া সুশাসনের নীতি লইতে হইবে। প্রয়োজনে কঠোর হইতে হইবে। সম্মুখে পুরভোট, এখন এই ঝুঁকি তৃণমূল সরকার লইতে পারিবে কি? নাকি কুর্সি বাঁচাইতে জল নষ্ট হইতে দিবেন মমতা?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy