Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

নামমাত্র নহে

ঝুলিতে যথেষ্ট নাম না থাকিলেও রাস্তা-স্টেশন-শহর-গ্রামের নাম বদলাইয়া দেওয়ার তাগিদ ছাড়া যায় না কেন? তাহার কারণ, নাম বদলাইয়া দেওয়া দখলদারি প্রতিষ্ঠার অতি মোক্ষম হাতিয়ার।

শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০১৭ ০০:০৫
Share: Save:

উইলিয়াম শেক্সপিয়র বিজেপি-র রাজত্ব দেখিলে হয়তো কলম সামলাইতেন। ‘নামে কী আসিয়া যায়’ গোত্রের কোনও কথা তাঁহার লেখনীনিঃসৃত হইয়া ক্রমে প্রবাদে পরিণত হইত না। তিনি জানিতেন, নামের মধ্যে ইসলামের গন্ধ থাকিলে তাহা পাল্টাইয়া দেওয়াই দস্তুর। যোগী আদিত্যনাথ যেমন ‘মুঘলসরাই’ রেল স্টেশনের নাম মুছিয়া লিখিতেছেন ‘দীনদয়াল উপাধ্যায়’। ‘মুঘলসরাই’ নামটিকে ঐতিহাসিক বলিলে ভুল হইবে। জায়গাটি স্বয়ং ইতিহাস। ভারতের ভূগোলের ইতিহাস, ‘দেশ’ নামক ধারণাটির নির্মাণের ইতিহাস। পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব ভারত হইতে উত্তর ভারতে যাওয়ার প্রধান এবং কার্যত একমাত্র রাস্তায় মধ্যবর্তী জনপথটি ক্রমে পথিকদের বিশ্রামের ঠাঁই হইয়া উঠে। এক অর্থে, সরাইখানাগুলি ছিল ভারতের কেন্দ্রবিন্দু। মুঘল যুগ ফুরাইয়াছে, জনপদটি মরে নাই। যে অবস্থানগত কারণে মুঘল আমলে মুঘলসরাই গুরুত্বপূর্ণ হইয়াছিল, ঔপনিবেশিক যুগে রেলপথ বিস্তারেও তাহাই এই জংশন স্টেশনটিকে মাহাত্ম্য দিয়াছে। আজ স্টেশনের সাইনবোর্ড হইতে নামটি মুছিয়া দিলেই সুদীর্ঘ ইতিহাস মুছিবে? কী ভাবে ভারতীয় অর্থনীতির সংগঠন রচিত হইত, তাহা ভুলিয়া যাওয়া সম্ভব হইবে? নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে ইতিহাসকে অস্বীকার করিবার প্রকল্পটি সর্বত্রই নিন্দনীয়। কিন্তু, ঔরঙ্গজেব রোডের নাম বদলাইয়া দেওয়া আর মুঘলসরাইয়ের নাম মুছিয়া ফেলা যে এক কথা নহে, তাহাও স্মরণে রাখা প্রয়োজন। প্রথম ক্ষেত্রে নামটি নামমাত্র ছিল— অন্য কাহারও দেওয়া। মুঘলসরাই নামটি ইতিহাসের তৈরি। দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নামে সেই ইতিহাস ঢাকিতে চেষ্টা করিলে প্রচেষ্টাটি বড় দৃষ্টিকটু হইয়া উঠে।

প্রশ্ন উঠিবে, দীনদয়াল উপাধ্যায়ই কেন? নাগপুর তাহার উত্তরে বলিতে পারে, স্টেশনের নাম পাল্টাইয়া দেওয়া হইয়াছিল প্রায় অর্ধশতক পূর্বেই, ১৯৬৮ সালে মুঘলসরাই স্টেশনে সংঘ পরিবারের এই তাত্ত্বিক গুরুর মৃতদেহ উদ্ধার হইবার পরই। আদিত্যনাথ এত দিনে সেই পরিবর্তনে সরকারি শিলমোহর লাগাইলেন মাত্র। কিন্তু, এই ব্যাখ্যা নেহাতই গৌণ। প্রধান কারণটি জানাইয়া গিয়াছিল হুঁকোমুখো হ্যাংলা— ‘দুটি বই ল্যাজ মোর নাই রে।’ দামোদর বিনায়ক সাভারকর, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বা দীনদয়াল উপাধ্যায় বই আর বিশেষ কোনও নাম সংঘের ইতিহাসভাণ্ডারে নাই। ফলে, ভারতের ইতিহাসে তাঁহার তাৎপর্য কী, বর্তমান ভারত কোন অর্থে তাঁহার নিকট ঋণী, স্টেশনের সাইনবোর্ডে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নাম লিখিবার পিছনে এই প্রশ্নগুলির উত্তরের ভূমিকা খোঁজা নিরর্থক। তাঁহার নামে স্টেশন তাঁহার মাহাত্ম্যের অভিজ্ঞান নহে, দলের বৌদ্ধিক ঐতিহ্যের দৈন্যের প্রমাণপত্র।

ঝুলিতে যথেষ্ট নাম না থাকিলেও রাস্তা-স্টেশন-শহর-গ্রামের নাম বদলাইয়া দেওয়ার তাগিদ ছাড়া যায় না কেন? তাহার কারণ, নাম বদলাইয়া দেওয়া দখলদারি প্রতিষ্ঠার অতি মোক্ষম হাতিয়ার। ধর্মতলা স্ট্রিটের নাম বদলাইয়া লেনিন সরণি করিয়া দিলে যাহা হয়, আকবরপুরের নাম অম্বেডকর নগর করিলেও তাহাই হয়। রাজনৈতিক আধিপত্যকে ইট-কাঠ-পাথরের বাস্তবে গাঁথিয়া ফেলিতে চাহিলে, জনমানসে কিছু নামের মাধ্যমে নিজেদের মতবাদকে প্রায় স্বতঃসিদ্ধ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করিতে চাহিলে জায়গার নাম বদলাইয়া দেওয়া অতি কার্যকর চাল। যোগী আদিত্যনাথদের হাতের তরবারির দুই দিকেই ধার। এক দিকে ‘মুসলমান’ ইতিহাসকে মুছিয়া ফেলা যায়, অন্য দিকে গৈরিক মতাদর্শের দামামা বাজানোও হয়। অতএব, মুঘলসরাই স্টেশনের নাম পরিবর্তন যে একটি রাজনৈতিক প্রকল্প, সে বিষয়ে সংশয় পোষণ না করাই ভাল। শেক্সপিয়রও হয়তো স্বীকার করিতেন, গোলাপকে ‘ভগওয়া ধ্বজ’ বলিলে তাহার গন্ধ বদলাইয়া যায়।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE