ছবি: পিটিআই।
সাধরণ ভাবে, বিশেষ করে এ দেশে, অধিকাংশ সময় সমাজের সার্বিক কল্যাণ মাথায় রেখে কোনও কাজ হয় না। কারণ, অবশ্যই জনমতের চাপ। ভোটের সাফল্য বোঝা যায়। কিন্তু গান-বাজনার সঠিক সুর পর্যন্ত যখন জনমত নির্ধারণ করতে চায়, তখন তো একটা সমস্যা আছে মানতেই হয়।
এই প্রেক্ষিতে ভারতের কর নীতির পরিচালনা নিয়েও সমস্যা তৈরি হওয়া তো স্বাভাবিক। বিশেষ করে যদি দলবাজি বা অর্থের জোরে সরকারি সিদ্ধান্ত এ পাশ-ও পাশ হয়ে যেতে থাকে, তা হলে সাধারণ করদাতা— অর্থাৎ মধ্যবিত্ত, খানিকটা উচ্চবিত্ত, কিংবা পেনশনভোগী বুড়োমানুষরাও যে তার বলি হবেন তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন থাকতে পারে কি?
আসলে যাঁরা কর দেন, তাঁদের সামাজিক সুরক্ষার অধিকারের দাবি কোথাও গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে ভোটের অঙ্কে। যাঁরা কর দেন তাঁদের টাকাতেই যাঁদের কোনও আয় নেই তাঁদের সুরক্ষার, তা সে যতটুকুই হোক না কেন, ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু যদি তাঁদের স্বার্থে আমাদের ফুটপাতে হাঁটার অধিকারও কেড়ে নেওয়া হয়, তখনই কিন্তু তৈরি হয় একটা বৈষম্য। দলবাজি আর ভোটের অঙ্কে হারিয়ে যেতে থাকে করদাতাদের হাঁটার অধিকারও।
আরও পড়ুন: নিজেই বুঝুন বাজেট, জেনে নিন ঘাটতির অআকখ
সামাজিক সুরক্ষার প্রেক্ষিতে এ হেন অবস্থায় কিন্তু করদাতাদের ক্ষুণ্ণ নাগরিক অধিকারকে তাঁদের ক্ষতি হিসাবে দেখে তা করযোগ্য আয় থেকে বাদ দেওয়ার দাবি উঠতেই পারে। এটা একটা সামাজিক অন্যায় এবং প্রগতিশীল কর ব্যবস্থার এক নতুন চেহারা। এই বাজেট কি সুশিক্ষিতের মতো, সুসভ্য দেশের মতো, সুশিক্ষিত অর্থনীতির চিন্তায় উজ্জ্বল হয়ে আমার আয়করের দায়ভার কমিয়ে দেবে যাতে, আমার কষ্টের পরিমাণ না বাড়ে?
এটা আমার সামাজিক সুরক্ষার অঙ্গ। যে সব অর্থনীতির মানুষেরা শুধু দরিদ্রদের চোখের জল দেখতে পান এবং সাতমহলা জীবনযাপনে অভ্যস্ত, যাঁরা আমি যে অত্যন্ত বেশি আয়কর দিচ্ছি এ কথা বলেন না, তাঁরা কিন্তু দেশের বৈষম্য সৃষ্টির অন্যতম কারিগর। আমার অধিকার কারও চেয়ে কম হতে পারে না। এ কথাটা অনেকে অনেক বার বলেছেন যে, তথাকথিত প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি যখনই সরকারের ব্যয় বাড়াতে শুরু করে তখন মধ্যবিত্ত করদাতাদের উপর বিভিন্ন ভাবে চাপ সৃষ্টি হয়। এবং বর্তমান আবহে এই কথাটা মাথায় রেখে আলোচনার পরিসর তৈরি হওয়া কিন্তু অত্যন্ত জরুরি।
এ বাজেট কি আমার আয়কর কমাবে? কমালে ভাল, না কমালে দেশের উন্নতিকল্পে যা কিছুই হোক না কেন সেটা আমার ধর্তব্যের মধ্যে আসে না। আমি নিশ্চিত, আমি একটি বিশেষ শ্রেণির প্রতিভূ হিসেবে সঠিক কথাই বলছি। সুদ কমানোর অর্থনীতি যে অর্থেই সঠিক হোক না কেন, ফুটপাত পরিষ্কার করে দেওয়ার অর্থনীতিও সেই অর্থেই সঠিক। এই যুক্তিতে কিন্তু ফুটপাত পরিষ্কার করা এবং আমার সঞ্চয়ের উপর দাম বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অবসরের পরে আয় বাড়ার ব্যবস্থা করার দাবি সরকারকে মাথায় রাখতেই হবে।
আরও পড়ুন: পরিস্থিতি বিপজ্জনক, খুব জরুরি রফতানি নিয়ে ভাবনাও
সরকারের সামাজিক সুরক্ষা দেওয়ার বৃত্তান্ত নিয়ে ‘ওয়্যার অ্যাণ্ড পিস’ লেখা যায়। গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনায় অন্তত ১০ লক্ষ কোটি টাকা এখনও পর্যন্ত খরচ হয়েছে। অথচ আজকেও গ্রামের দরিদ্র মানুষ ‘গেল গেল’ বলে সবাই উত্তেজিত। তাদের নাকি খরচ কমে গিয়েছে। সরকারি কোনও তথ্যকেই বিশ্বাস করতে গেলে বুকের পাটা দরকার। তবুও তাকেই আমরা সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসযোগ্য তথ্য বলে মনে করি।
এত টাকা কল্যাণমুলক কাজে খরচ করে আসলে কী হল? অনেক দলের সরকার উতরে গেল, ভোট পেল— কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী সম্পদ কতটা তৈরি হল? এত করে কিছুই হল না কি? কোনও সরকারি প্রকল্পের ‘সঠিক মূল্যায়ন’ হয় না— সরকার করতে চায় না। ‘সঠিক মূল্যায়ণের’ বৈজ্ঞানিক প্রথা আছে— কিন্তু কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোবে কি না— সেটাই প্রশ্ন। এই বাজেটে কি সরকারি প্রকল্পের মূল্যায়ন সাংবিধানিক ভাবে বাধ্যতামূলক করা হবে? হবে না।
সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা পাওয়ার খরচ অনেক বাড়ানো উচিত এবং সঠিক অর্থে দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে কোনও পয়সা নেওয়া উচিত নয়। এটাই অর্থনীতির সমাজ কল্যাণের কথা। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ আর সেই কথার ভয়ে গর্তে ঢুকতে পারলেই হল— এমন একটা বিশ্বাসের ফলে অর্থনীতি ও রাজনীতির কোনও মানুষ এটা বলেন না। কেন বিত্তশালী বাবা-মায়ের ছেলেমেয়েরা প্রায় বিনা পয়সায় সরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়বে? প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এই বৈষম্য কমানোর কি ব্যবস্থা হবে এই বাজেটে? হবে না।
যাঁদের পেনশন নেই তাঁদের সরকার কি কোনও ছাড় দেবে? পরিশেষে এই বলে শেষ করি, কারণ, আমি সুরক্ষিত না হলে ‘আমার’ সমাজ সুরক্ষিত নয়। যাঁরা দরিদ্র তকমা পান আর যাঁরা কর ফাঁকি দেওয়ার হাজারো রকম পন্থা ব্যবহার করেন— তাঁদের সরকারকে দোমড়ানো-মোচড়ানোর অনেক সুযোগ আছে। সাধারণ চাকুরে, সৎ নাগরিক এবং পেনশনহীন মধ্যবিত্তের নেই। তাই আমাকে ব্রাত্য করে যে বাজেট, তাকে মহানুভব আখ্যা দিতে আমার বাধে।
(লেখক অর্থনীতির শিক্ষক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy