আন্তর্জাতিক অর্থ বাজারটা শুধুই সংখ্যাতত্ত্বের উপর চলে না।
গত বাজেটে অর্থমন্ত্রী বিশ্ববাজারে ঋণপত্র বিক্রি করে টাকা তোলার কথা বলেছিলেন। এমন নয় যে এই প্রস্তাব খুব নতুন। প্রতিটি দেশই বিশ্ববাজার থেকে ঋণ করে থাকে। ভারতও করে এবং করেছে। আমাদের আলোচনা অবশ্য এই প্রস্তাব ও তার রকমফের নিয়ে নয়। এই আলোচনা বিশ্ব লগ্নি বা ঋণ বাজারের ঝুঁকির গতিপ্রকৃতিটা বুঝে নেওয়ার। তিন কিস্তির লেখার এটি শেষ কিস্তি।
শুধু সংস্থা নয়, বিশ্ব লগ্নি বাজারে টাকা ধার করে বিভিন্ন দেশও। প্রথম পর্বেই উল্লেখ করেছিলাম ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর ডলারে ঋণ নেওয়ার প্রস্তাবের। এ বার আসা যাক দেশ যখন ঋণ নেয় তখন কী হয়, সেই প্রসঙ্গে।
যে কোনও দেশেই সরকারি বা বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান বা ব্যাঙ্ক যেমন আন্তর্জাতিক লেনদেনের বাজারে আসে, তেমনই আসে সেই সব দেশের সরকার যারা নিজের নামে, মানে সেই দেশের নামে, টাকা ধার করে। কোনও সরকার যখন টাকা ধার করে সেটা অবধারিত ভাবেই বন্ড বা ঋণপত্র হিসেবে। পাঁচ বছরের পূর্ব নির্ধারিত দরে। যেহেতু এই সব বন্ডের নিয়মিত কেনাবেচা হয় বিভিন্ন ব্যাঙ্ক বা নানান আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে, আমরা বাজারে বলি এই দেশের ঋণ আজকাল এই দরে কেনা বেচা হচ্ছে। সেটা হয়ে দাঁড়ায় বাজারদরের মাপকাঠি।
আরও পড়ুন: বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার ঝুঁকিটা কোথায় কোথায়
ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দীর্ঘ দিনের নীতি ছিল— ভারত সরকার নিজের নামে কোনও ঋণপত্র বিদেশের বাজারে ছাড়বে না। দেশে নিশ্চয়। বিদেশে নয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বক্তব্য ছিল তারা কখনও আন্তর্জাতিক বাজারে ভারত নামক দেশটির বিশ্বাসযোগ্যতার বন্ডের কেনাবেচার দর দিয়ে বিচার করতে দেবে না। ফলত আজ আপনি রাশিয়া-ব্রাজিল-মেক্সিকোর ঋণপত্রের বাজারদর জানতে পারেন। শুধু বোতাম টিপে দেখে নিন এই সব দেশের সরকারি বন্ড কী দামে কেনাবেচা হচ্ছে। ভারত নামক দেশটির দর আপনি পাবেন না। এখানে অবশ্য আমরা একটা বিকল্প খুঁজি— ঠিক সরকার নয়, কিন্তু তার সমতুল্য কোনও ঋণ গ্রহীতা কী দরে টাকা ধার করছে।
এ অবধি না হয় বোঝা গেল। কিন্তু ধারের দর বা সুদ ঠিক হয় কী করে? ব্যালান্স শিটের ব্যায়াম চর্চায়? সেটা দেশি টাকায় ধার বেচাকেনার ক্ষেত্রে ঠিক আছে। কিন্তু বিশ্ববাজারে ঋণ দাতা দেখেন— ওই যে চারটি ঝুঁকির কথা আগে বলেছি— ঋণ গ্রহীতার ব্যবসার স্বাস্থ্য, সুদের হার, মুদ্রা বিনিময়ের হার এবং মুদ্রা হস্তান্তরের ঝুঁকি (ডলারে নিলে টাকায় শোধ করা যায় না)। এ ক্ষেত্রে বেশি ভারিক্কি হয়ে দাঁড়ায় মুদ্রা বিনিময়ের ঝুঁকি। এই ঝুঁকি অনেকটা নির্ধারিত হয় দেশের মুদ্রা বাজারের স্বাস্থ্যের উপর। এই যেমন গত কয়েক বছর টাকা দুর্বল হয়েছে। তাতে দেশের ঋণ ফেরত দেওয়ার চাপ বাড়ে। অঙ্কটা সোজা। ডলারের দাম যদি ৬০ টাকা, আর ১০০ ডলার ফেরানোর থাকে, তা হলে ৬০০ টাকা খরচ। ডলারের দাম ৭০ টাকায় চড়লে কিন্তু ১০০ ডলার ফেরত দিতে ৭০০ টাকা লাগবে। মানে চাপ বাড়বে কোষাগারের উপর।
অতএব এন্টার দি ড্রাগনের মতো অনুপ্রবেশ ঘটে মান নির্ধারণের সংস্থাগুলির (রেটিং এজেন্সি)। তারা নানান অঙ্ক কষে, সংখ্যাতত্ত্বের ঝামা ঘষে একটা দেশের মূল্যমান স্থির করে। সবার উপরে ‘ট্রিপল এ’ সত্য তাহার উপরে নাই। ১৯৪টি দেশের মধ্যে মাত্তর ১১টি দেশের মূল্যমান বা রেটিং বিশ্ব সেরা (আমেরিকা, জাপান বা ব্রিটেনও এই তালিকায় পড়ে না)। তবে এত ভাল না হলেও চলে। তিনটে ‘বি’ পেলে তাকে ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড দেশ বলা হয়। মানে, গোদা বাংলায় বললে, এই দেশগুলিতে টাকা ধার দিলে টাকা ফেরত পাওয়ার আশা আছে। যার রেটিং যত ভাল, তার তত সুদের হার কম।
আরও পড়ুন: ঋণ পেলেই তো হবে না, কাজে লাগাতে হবে, কারণ গুনতে হবে সুদ
গত শতাব্দীর শেষ নাগাদ একটি এজেন্সি (মুডিজ) ভারতকে ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড আখ্যা দেয়। কিন্তু স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর রাখে এক ইঞ্চি নীচে। এর ফলে শুরু হয় আর এক জুয়া খেলা। ঋণ গ্রহীতা বললে— ভারত এখন ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড দেশ কারণ মুডিজ বলেছে, সুদের হার সেই মত কম হওয়া উচিত। ঋণ দাতা বললে— ভাই আমরা তো স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর দেখি। তাঁদের মতে ভারত ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড নয়। রেটিং-এর এই দুটি ভাই কখনও কখনও একমত হন, কিন্তু একাধিক ক্ষেত্রে আলাদা মত পোষণ করে পারিশ্রমিক বাড়ান। ফর এ ফিউ ডলারস মোর। আজকে ভারতের রেটিং ইনভেস্টমেন্ট গ্রেডের একটু নীচে। কিন্তু যে চশমা লাগিয়ে এই এজেন্সিগুলি ভারতের ভবিষ্যৎ দেখছেন, সেই চশমায় একটু ভুষোকালি লাগানো আছে।
তো বাজার কী বলে? বাইরের এই বাজার কাদের নিয়ে? ঋণদাতারা শুধুই বিদেশি ব্যাঙ্ক নয়। নানান রকমের ফান্ড, অ্যাসেট ম্যানেজার এমনকি পেনশন ফান্ড— তারাও খুঁজছে লগ্নির সুযোগ। এদের সবার অভিপ্রায় সমান নয়। এটা তো সর্বজনবিদিত সত্য যে— যে কোনও লগ্নিতে আমরা খুঁজি তিনটে জিনিস— উঁচু দর, সুরক্ষিত লগ্নি আর সহজে যাকে কেনা বা বেচা যায়। মুশকিল এই যে, এই তিনটে গুণ কোনও লগ্নিতে একত্র পাওয়া যায় না। যেখানে দর ভাল, সেখানে ঋণ গ্রহীতাকে নিয়ে ভাবনা আছে। কেউ চান লম্বা সময়ের লগ্নি কেউ আবার চান স্বল্প সময়ের।
ইউরোপের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে আজকাল কোনও সুদ পাওয়া যায় না। উলটে টাকা জমা রাখলে ব্যাঙ্ক আপনার কাছে ক্ষতিপূরণ চায় আপনার টাকাপয়সার দেখভাল করার দায়িত্ব তাদের দিয়েছেন বলে। সে বড়ো কঠিন কাজ। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, দুবাই, সিঙ্গাপুরে যাঁরা প্রভূত অর্থের পোঁটলা নিয়ে বসে আছেন, তাঁদের সামনে নানা লগ্নির সুযোগ। ভারত সেখানে আর একটি খেলার মাঠ মাত্র। সেখানে লগ্নি করার সপক্ষে জোরদার যুক্তি থাকা দরকার। সেটি সম্প্রতি অপ্রতুল হয়েছে। ভারতবর্ষ কাহিনী (ইন্ডিয়া স্টোরি) বাজারে তেমন কাটছে না। এমনিতেই উন্নয়নশীল দেশগুলির অর্থনীতির বৃদ্ধির ধারা শিথিল। চিলি, লেবানন, হংকং চারিদিকে রাজনৈতিক ঝামেলা, যেটিকে লগ্নিকারীরা আন্তরিক অপছন্দ করেন। ট্রাম্পের নিত্য নব টুইট জোগায় আরও অনিশ্চয়তা। ব্রেক্সিট খেলা চার বছর চলল। এ যেন বৈঠকি আলোচনার অলিম্পিক। উন্নয়নশীল দেশগুলি অধিক মূল্যে ধারদেনা করছে। উপায় নেই। গৌরী সেন সম্প্রদায়ের লোক বাজারে অমিল।
আন্তর্জাতিক অর্থ বাজারটা শুধুই সংখ্যাতত্ত্বের উপর চলে না। এই সব অঙ্ক অনেক বার ভুল প্রমাণিত হয়েছে। লিমান ব্রাদারস নামক স্বনামধন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি যে দিন লাটে উঠল, তার আগের দিন অবধি রেটিং সংস্থা তাঁদের উঁচু মানের রেটিং দিয়েছিলেন। আবেগ বা অনুভূতিকেও সংখ্যা দিয়ে মাপা যায় না। ভারতের বর্তমান আর্থিক জাহাজের কলকব্জা ও তার বৈঠা বাহকদের সম্যক যোগ্যতা নিয়ে প্রভূত সংশয় অনেকের মনে। তাই লগ্নি বাড়ন্ত। ভাও উচ্চগামী।
(লেখক বৈদেশিক ঋণ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত ম্যানেজিং ডিরেক্টর, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্ক)
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy