—ফাইল চিত্র।
কেন্দ্রীয় বাজেট হাতে পাওয়ার জন্য মানুষ আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করে থাকে। অর্থনীতিকে ভাল দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য কী কী প্রস্তাব রাখলেন অর্থমন্ত্রী, তা দেখার প্রত্যাশা থাকে। নির্মলা সীতারামন তাঁর দ্বিতীয় বাজেট পেশ করলেন, এবং দেখা গেল প্রত্যাশিত বিষয়গুলির অধিকাংশেরই উল্লেখ নেই। তিনি বাজেট পেশ করার আগে থেকেই অবশ্য মনে হচ্ছিল, অর্থনীতির সার্বিক অবনতির দিকে দৃষ্টি দেবেন না নরেন্দ্র মোদী সরকার।
সেই ভয়টাই সত্য হল, যখন অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বললেন যে ‘অর্থনীতির মৌলিক বিষয়গুলি শক্তিশালী।’
ভারতীয় অর্থব্যবস্থা সম্বন্ধে যাঁরা খোঁজখবর রাখেন, অর্থমন্ত্রীর এই মন্তব্যে তাঁরা স্তম্ভিত হয়ে যাবেন। অর্থব্যবস্থার ভিতরে এতটাই ঘুণ ধরেছে, তার কাঠামো এমন ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে, এবং সেই দুর্বলতা অর্থব্যবস্থার উপর এমন তীব্র প্রভাব ফেলেছে যে এখন জাতীয় আয় গত এক দশকের মধ্যে সব চাইতে শিথিল গতিতে বাড়ছে। গত কালই জানা গেল, এনএসও ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের জন্য আর্থিক বৃদ্ধির হার ০.৭ শতাংশ-বিন্দু কমিয়ে ৬.১ শতাংশ করে দিয়েছে। যে বছরের আর্থিক বৃদ্ধির হার সংশোধন করে কমানো হল, তখনও কিন্তু ভারতে অর্থনীতি এতটা নিম্নমুখী হয়নি।
এখন যা ইঙ্গিত মিলছে, তাতে মনে হচ্ছে না যে খুব তাড়াতাড়ি এই নিম্নগতি রোখা যাবে, কারণ খরিফ ফসলের উৎপাদনের পরিমাণ পাঁচ শতাংশ কম হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই কৃষিতেও মন্থরতা আসবে। উৎপাদন ক্ষেত্র (ম্যানুফ্যাকচারিং) গত কয়েক বছর ধরেই ঝড়ঝাপ্টা সামলাচ্ছে। ২০১৯-২০ সালে বেশ কয়েকটি প্রধান শিল্পের বৃদ্ধি তার আগের বছরের চাইতে মন্থর হয়েছে। রফতানির ক্ষেত্রও গতি হারিয়েছে, ২০১৮-১৯ সালের এপ্রিল-ডিসেম্বরের তুলনায় ২০১৯-২০ সালে ওই একই সময়ে রফতানি হওয়ার সম্পদের মূল্য কমেছে দুই শতাংশ। এই পরিস্থিতিতে যে বেকারত্ব বেড়েই চলবে, তা আশ্চর্য নয়। ২০১৯ সালের মে মাসে সরকার জানিয়েছিল, ২০১৭-১৮ সালে বেকারত্বের হার ছিল ৬.১ শতাংশ, যা কয়েক দশকে সর্বোচ্চ। এখন মনে হচ্ছে, এই সংখ্যাটা প্রায় আট শতাংশ।
গত কাল যে আর্থিক সমীক্ষা পেশ করা হয়েছে, তার সুর থেকেই আশঙ্কা হচ্ছিল যে এই সঙ্কটের সময়ে কোনও দৃঢ় ব্যবস্থা করার ইচ্ছা সরকারের নেই। আর্থিক সমীক্ষায় স্পষ্ট ছিল যে অর্থনীতির মোড় ফেরাতে বাজারের অদৃশ্য হাতের উপরেই আস্থা রাখছে সরকার। অথচ অর্থনীতি যেমন তীব্র চাহিদা সঙ্কোচনের মুখে পড়েছে, বিনিয়োগকারীরা কেন তাতে জড়িয়ে পড়তে আগ্রহী হবেন— তা স্পষ্ট নয়। তা সত্ত্বেও দেখা গেল, অর্থমন্ত্রী এই বাস্তবকে উপেক্ষা করলেন, এবং কয়েক মাস আগে কর্পোরেট করে একটা বড়সড় ছাড় দিলেন। কর্পোরেটদের প্রতি এমন উপুড়হস্ত হওয়ার ফলে তাঁর রাজস্ব আদায়ের হিসেবের ওপর বেশ ভাল রকম প্রভাব পড়েছে। অর্থমন্ত্রী আমাদের জানালেন, চলতি অর্থবর্ষে কর আদায় হবে বাজেটে উল্লিখিত অঙ্কের চাইতে বারো শতাংশ কম, যার প্রধান কারণ কর্পোরেট কর আদায় হবে কুড়ি শতাংশ কম। কর্পোরেটদের কর ছাড় দেওয়ার জন্যই এটা হল। পরোক্ষ কর আদায়ের গতিও শিথিল হয়েছে, কারণ অর্থনীতির গতিভঙ্গ হওয়ায় জিএসটি ও আমদানি শুল্ক, দুই ক্ষেত্রেই রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কমেছে।
মূলধনী খাতে ঋণবহির্ভূত রাজস্বের পরিমাণও কমেছে, কারণ গত বাজেটে বিলগ্নিকরণের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের যে হিসেব দেওয়া হয়েছিল, প্রকৃত প্রস্তাবে এই খাতে আদায় হওয়া রাজস্বের পরিমাণ তার চেয়ে ৩৮ শতাংশ কম। অর্থাৎ, সরকারকে খরচ চালাতে প্রচুর ধার করতে হয়েছে, যা এখনকার ঋণের উপর সুদের বোঝা আরও বাড়াবে। অর্থনীতির স্বাস্থ্যোদ্ধারের স্বার্থে টাকা ব্যয় করতে এই সরকারের আগাগোড়া অনীহা ছিল। এখন হাতে ব্যয় করার মতো টাকাই নেই। একটা বৃত্ত পূর্ণ হল।
ক্ষমতায় আসা ইস্তক নরেন্দ্র মোদীরা মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং তথাকথিত ফিল গুড ফ্যাক্টর-এর ওপর বেশি নির্ভর করেছেন। এই বাজেটও তার ব্যতিক্রম নয়। যা কার্যকর করা সম্ভব, এমন শক্তপোক্ত প্রকল্পকে পিছনে রেখে তার আগে ‘আকাঙ্ক্ষা’কে স্থান দিলে কী হয়, তা এখনই বুঝতে পারছে হোঁচট-খাওয়া অর্থনীতি। তো, এ বারের নতুন আকাঙ্ক্ষাগুলো কী? অর্থমন্ত্রী তিনটে প্রধান এলাকা বেছেছেন— ১) কৃষি, সেচ এবং গ্রামীণ উন্নয়ন; ২) সুস্থতা, জল ও নিকাশি; ৩) শিক্ষা ও দক্ষতা। কৃষির ক্ষেত্রে আকাঙ্ক্ষা হল ২০২২ সালের মধ্যে চাষির রোজগার দ্বিগুণ করা। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, কৃষি বাজারকে খুলে দিয়ে, সেখানে প্রতিযোগিতা এনে চাষকে লাভজনক করার মাধ্যমে তাঁরা কৃষকের আয় দ্বিগুণ করবেন। সব আকাঙ্ক্ষার মধ্যে এটাই সব চাইতে অন্তঃসারশূন্য, কারণ এর সঙ্গে বাস্তবের যোগ সব চাইতে কম। সারা দেশে চাষির সঙ্কটের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, তার মাঝে দাঁড়িয়ে অর্থমন্ত্রী একটি ষোলো-পর্যায়ের নীতি ঘোষণা করেছেন, যার রূপায়ণের জন্য কার্যত কিছুই বাড়তি বরাদ্দ করেননি। ২০১৯-২০ সালের তুলনায় কৃষির বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র চার শতাংশ। এই অতি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে (সেচ ব্যবস্থা প্রভৃতি) উৎপাদনশীল সম্পদ সৃষ্টির খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে মাত্র পঞ্চাশ কোটি টাকা। এবং তা এমন সময়ে যখন সরকার সম্পদ সৃষ্টির খাতে ব্যয় (ক্যাপিটাল এক্সপেন্ডিচার) বাড়িয়েছে বাইশ শতাংশ, যা মোট ৪১,২০৮৫ কোটি টাকায় দাঁড়াবে বলে প্রত্যাশিত। অর্থাৎ যে ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ ভাবে দেশের ষাট শতাংশ মানুষের রোজগার জোগায়, তা কেন্দ্রীয় বাজেটের মূলধনী খাতে ব্যয়ের ০.০১ শতাংশ পেল।
সরকার যদি মূলধনী খাতে ব্যয় না বাড়ায়, চাষিরা কী করে প্রত্যাশা করতে পারে যে তাদের রোজগার দ্বিগুণ হবে?
কৃষির মতোই, শিক্ষাও এমন একটি ক্ষেত্রে যেখানে সরকার আকাঙ্ক্ষাকে মেলে ধরেছে, কিন্তু তার জন্য যথেষ্ট বরাদ্দ করেনি। প্রাথমিক শিক্ষায়— যে ক্ষেত্রটিতে শিক্ষার অধিকার আইন সার্থক করতে সরকার দায়বদ্ধ— টাকা বরাদ্দ হয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। সর্বশিক্ষার পরিবর্তে এসেছে সমগ্র শিক্ষা, যা শিক্ষার অধিকারকে রূপায়ণ করার প্রধান প্রকল্প। তার বরাদ্দ ২০১৯-২০ সালের চাইতে কেবল সাত শতাংশ বেড়েছে। সামগ্রিক ভাবে স্কুলশিক্ষা ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত বৃদ্ধি আরও কম। এখানে বলা দরকার, গত বছরে যা বরাদ্দ ধরা হয়েছিল, সংশোধিত বাজেটে দেখা যাচ্ছে তার অনেকটাই খরচ হয়নি। তা হলে এই বাড়তি সাত শতাংশই যে খরচ হবে, সে বিষয়ে কী করে নিশ্চিত হওয়া যায়, বিশেষ করে যেখানে সরকার সম্পদের অভাবের সঙ্গে জুঝে চলেছে?
উচ্চশিক্ষার অবস্থা আরও বিস্ময়কর। বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র তিন শতাংশ, যা ইঙ্গিত দেয় যে সরকার উচ্চশিক্ষার বেসরকারিকরণের দিকে এগোচ্ছে। উচ্চশিক্ষার প্রতি সরকারের এমন মনোভাবের কারণেই এই দেশে চার জন তরুণ-তরুণীর মাত্র এক জন কলেজে ভর্তি হয়।
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সরকারি ব্যয় কতখানি বাড়ল? চলতি অর্থবর্ষের বাজেটে যত টাকা বরাদ্দ হয়েছিল, ২০২০-২১ অর্থবর্ষের জন্য এই বাজেটে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বরাদ্দ দাঁড়াল তার মাত্র চার শতাংশ বেশি। সরকার দাবি করছে যে আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প দারুণ সফল। কিন্তু, দেশের সাধারণ মানুষের ওপর রোগব্যাধিজনিত বোঝা বেড়েই চলেছে। সেটা দেশের ভবিষ্যতের পক্ষে সুখবর নয়।
দেশের অর্থনীতির স্বাস্থ্যোদ্ধার করতে, এবং সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর সুরাহা করতে অর্থমন্ত্রীর পক্ষে কী করা সম্ভব ছিল, বাজেটের দিনে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। প্রথম কথা হল, তিনি এমন কিছু ক্ষেত্রে খরচের পরিমাণ বাড়াতে পারতেন, যাতে একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের উন্নয়নের কাজও হয়, আবার আর্থিক বৃদ্ধির হারেও তার প্রভাব পড়ে। উদাহরণ হিসেবে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যক্ষেত্রের কথাই বলা যেতে পারে। শিক্ষার অধিকার আইনকে যদি ঠিক ভাবে কার্যকর করা হয়, তা হলে গোটা দেশ জুড়ে কয়েক লক্ষ শিক্ষকের প্রয়োজন হবে। একই ভাবে, উচ্চশিক্ষাকে সর্বজনীন অধিকার হিসেবে গণ্য করলে আরও অনেক কলেজ তৈরি করার প্রয়োজন হবে, এবং তাতে বহু উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়ের কর্মসংস্থান হবে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও যদি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, যদি সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরিষেবার ওপর জোর দেওয়া হয়, তা হলে সুচিকিৎসা যেমন সবার নাগালে আসবে, তেমনই বহু লক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর কর্মসংস্থান হবে।
দেশের মানুষের জীবনের উন্নতিসাধনের চেষ্টা করতে, তাঁদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বিপুল রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন, সে কথা বোধ হয় আলাদা করে না বললেও চলে। কিন্তু, সরকারের মন জুড়ে যদি শুধু বাজার থাকে, তবে সেই সরকার নাগরিকদের জন্য প্রকৃত অচ্ছে দিন আনার চেষ্টা করবে, এমন আশা না করাই ভাল।
অর্থনীতি বিভাগ, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy