ফরাসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেলের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই কবুল করেছিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাকরঁ (ছবিতে)। জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধি করতে হলে চাই ফ্রান্সের সমাজের গভীরে বেশ কিছু পরিবর্তন। ইউরো-অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই অচলায়তনকে ভাঙার সাফল্যের ওপর। ঊনচল্লিশ বছরের সদ্য-নির্বাচিত রাষ্ট্রনায়ক এমন কিছু করে দেখালেন যা তাঁর আগে আর কেউ পারেননি। শ্রমিকের কাজের অধিকারে হস্তক্ষেপ, শ্রম-আইনের আমূল সংশোধন। যে সংস্কার ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে ইতালি স্পেন জার্মানির মতো পশ্চিম ইউরোপের অন্য কয়েকটি দেশে। ফ্রান্সে তা গত সেপ্টেম্বর থেকেই অর্ডিন্যান্স মারফত বলবৎ হয়ে গিয়েছিল। ২৮ নভেম্বর পাশ হয়ে গেল আইনসভায়, ৪৬৩ বনাম ৭৪ ভোটে।
অনেকে বলছেন, নীরব রক্তহীন প্রতিবিপ্লব। ‘কাজ বেশি, মজুরি কম’— শিল্পবিপ্লবের পর থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবধি শ্রম-বাজারের মূল সুরটি বেঁধে দিয়েছিলেন শিল্পমালিকরা। ইউরোপে প্রথম এর ব্যতিক্রম ১৯৩৬-এ, ফ্রান্সে। সমাজতন্ত্রী, সাম্যবাদী ও গণতান্ত্রিক শক্তি একজোট হয়ে সেখানে সরকার গড়ল। শ্রমিকের মজুরি ও অবসরের বিষয়টি প্রথম সরকারি স্তরে গুরুত্ব পেল। যুদ্ধপরবর্তী কল্যাণব্রতী রাষ্ট্রনীতিতে এই সমাজতন্ত্রী আদর্শই প্রতিষ্ঠা পেল। খ্রিস্টীয় পরম্পরাগত শ্রমের বন্দনা ছেড়ে সমাজ-সংস্কৃতি ক্রমে অবসরকেন্দ্রিক হয়ে উঠল। শুরু হল ‘শ্রম-সংস্কৃতি’র অবমূল্যায়ন।
বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ফ্রান্সে অর্থনীতি শুধু উৎপাদনমুখী ছিল না, তার মধ্যে ছিল এক সামাজিক দায়বদ্ধতাও— শ্রমিকের স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তার অঙ্গীকার। সত্তরের দশকে পেট্রোল ও পেট্রোলজাত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কায় এই দায়বদ্ধতার ভাঁড়ারে টান পড়ল। কলকারখানা বন্ধ, বেকারত্ব আকাশ-ছোঁয়া— চাকরির সঙ্গে কর্মীর আত্মমর্যাদা, আত্মপরিচয়ের অনুষঙ্গ যত ক্ষীণ হতে থাকল, জোরদার হতে লাগল নেতিবাচক নিরাপত্তার অনুষঙ্গটি। চাকরিকে যেন তেন প্রকারেণ টিকিয়ে রাখতে না পারলে নির্বাসিত হতে হবে সমাজের অন্তেবাসীর দলে— এই ভয়ের সেই শুরু। বহিষ্করণের এই ভয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লাগামছাড়া হল কাজের চাপ, তজ্জনিত রোগ ও দুর্ভোগ।
এত দিন অবধি তবুও এক রক্ষাকবচ ছিল ফ্রান্সের শ্রমিকের হাতে। শ্রম-আইন সম্পর্কিত সরকারি এক সংকলন। এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে ঊনবিংশ শতক থেকে শ্রমিকের অর্জিত অধিকারের খতিয়ান। গ্রন্থটি বৃহদাকৃতি, কয়েক হাজার পৃষ্ঠাব্যাপী আইনের ধারা-উপধারার এক জটিল সন্নিবেশ। মালিক-পক্ষ, বিশেষত ছোট ও মাঝারি উদ্যোগপতিদের মতে তার সরলীকরণ খুবই জরুরি। এই আইন-গ্রন্থের জটিলতা নাকি এমনই যে, শিল্প-সংস্থাগুলি শ্রমিক নিয়োগ করতে পারছে না ছাঁটাই করতে গিয়ে আইনি ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়ার ভয়ে। নয়া সরলীকৃত আইনে কী থাকছে?
অস্থায়ী কর্মী নিয়োগের বিষয়টি জাতীয় স্তরে একটি আইন মোতাবেক এ যাবৎ স্থির হত। সেটি এখন স্থির হবে শিল্পক্ষেত্রের স্তরে। অর্থাৎ গাড়ি, ইস্পাত, শক্তি ইত্যাদি শিল্পক্ষেত্রের নিজের নিজের চাহিদা অনুসারে সেই সেই ক্ষেত্রে অস্থায়ী কর্মীর মেয়াদ ও চুক্তি-নবীকরণের বিষয়টি স্থিরীকৃত হবে।
স্থায়ী নিয়োগের চুক্তিতে পরিবর্তন এসেছিল আগেই; শিল্পের কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রকল্পভিত্তিক স্থায়ী কর্মী নিয়োগ, আসলে যা ছদ্মবেশী অস্থায়ী নিয়োগ। কেন না প্রকল্প শেষ হয়ে গেলেই চুক্তির শেষ। এ দিকে কর্মীর চাকরিটিও গেল অথচ চুক্তি-অন্তে অস্থায়ী কর্মীর আর্থিক ক্ষতিপূরণটুকুও পাওয়া হল না। নয়া আইনে এই নিয়োগের ক্ষেত্রটিকে আরও সম্প্রসারিত করা হচ্ছে।
কী পরিস্থিতিতে কর্মী কাজ করবে— কর্মস্থলের নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যের বিষয়টি তত্ত্বাবধানের জন্য কর্মস্থলভিত্তিক কমিটি গঠন করা হয়। বর্তমান আইনে এই কমিটি তুলে দেওয়ার কথা উঠেছে। কঠোর পরিস্থিতিতে কর্মরত শ্রমিকের যে মানসিক ও শারীরিক ক্ষয়, শ্রমিক সংগঠনগুলোর শতাব্দীপ্রাচীন আন্দোলনের ফলে তার কিছুটা প্রতিকার হয়, স্বীকৃত হয় শ্রমিকের নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যের অধিকার। বর্তমান আইনের ফলে তার ওপর আঘাত নেমে এসেছে। বস্তুত এই আইন মোতাবেক, শ্রম যে মূলগত ভাবে একটি কঠোর ও কষ্টকর প্রক্রিয়া, সেই ধারণাটিই লোপ পেতে চলেছে। এই ধারণার বশবর্তী হয়েই কিন্তু যুদ্ধপরবর্তী ফ্রান্সে গড়ে উঠেছিল কর্মী ও শ্রমিকের সামাজিক সুরক্ষাতন্ত্র।
রোগভোগে ছুটি নিলে সরকারি কর্মীদের এমনিতেই এক দিনের বেতন কাটার রেওয়াজ ছিল। বেসরকারি সংস্থায় এ ক্ষেত্রে এক দিনের ছুটি নিলে তিন দিনের বেতন খেসারত দিতে হয়। নয়া আইন বলছে, এই নিয়ম বরাবর হওয়া উচিত। অর্থাৎ সরকারি বাবুদেরও এক দিনের ছুটিতে তিন দিনের খেসারত দিতে হবে। মালিকের চোখে এই অসুস্থতা, আসলে কাজ না-করার ছুতো। অর্থাৎ আলিস্যি ও বদভ্যাসের প্রতিষেধক হবে এই খেসারত-ব্যবস্থা।
সর্বশেষ প্রসঙ্গটি শ্রম-আদালত বিষয়ক। বেআইনি ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে শ্রমিক যেখানে তাঁর অভিযোগ দায়ের করতে পারেন ও উপযুক্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন। মালিকপক্ষের সুবিধার্থে এই ক্ষতিপূরণে একটা ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, এর ফলে এত দিন যে ছাঁটাই বেআইনি ছিল, তা আইনি বৈধতা পেল।
বলা হচ্ছে, শ্রমিক মালিক সরকার, তিন পক্ষের যৌথ চিন্তনের ফসল এই আইন। উদ্দেশ্য: বেকারদের ক্ষতিপূরণের ‘নিষ্ফল’ নীতি ছেড়ে কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ। তথাকথিত সামাজিক সুরক্ষা বলয় এ যাবৎ সুরক্ষিত রাখতে পারেনি কর্মপ্রার্থীর স্বার্থ, বরং ঘুরপথে বেকারত্ব বাড়িয়েছে। কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে বিনিয়োগের খরা কাটাতে হবে। উদ্যোগপতিকে আরও অক্সিজেন দিতে হবে। মালিক-শ্রমিক চুক্তিতে আইনি বাধ্যবাধকতা থেকে বেরিয়ে এসে নমনীয়তা আনতে হবে। অর্থনৈতিক সংকটকে চাহিদার দিক থেকে নয়, বরং জোগানের দিক থেকে মোকাবিলা করতে হবে। অর্থাৎ শুধু শ্রমিকের বেতন ও সুরক্ষা বৃদ্ধির পথে ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে (এ দাওয়াই ইতিপূর্বেই ডাহা ফেল) তার সুরাহা হবে না, শ্রম তথা উৎপাদনের খরচ কমাতে হবে। আজকের অর্থনীতিতে চাকরি আজ আছে কাল নেই। কিন্তু টালমাটাল এই চাকরির বাজারে মানুষকে বেঁচে থাকার সম্বল জোগানো যায় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। সরকারি অর্থের বহুলাংশ তাই ব্যয় হবে কর্মপ্রার্থীর প্রশিক্ষণের খাতে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও সরকার শ্রম আইন সংস্কারের ডাক দিয়ে নির্বাচনে জিতে এসেছেন, তাঁদের কাছে এটা গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা।
২০১৭ সালে এমানুয়েল মাকরঁ যে কোনও নতুন কথা বললেন তা নয়। ডান-বাম নির্বিশেষে ফরাসি রাষ্ট্রনায়কদের পুরনো বক্তৃতা-বিতর্ক-বিবৃতিগুলি ঘাঁটলেই এই সত্যের আভাস পাওয়া যাবে। ২০১৬’য় ফ্রঁসোয়া ওলঁদ বা এমানুয়েল ভাল্জ, ২০১২’তে নিকোলা সারকোজি, এমনকী ১৯৮৮’তে জাক শিরাকের গলায়ও শোনা গিয়ে ছিল ঠিক এক লব্জ। নিন্দুকের মতে, এই শ্রম-নীতির আসল প্রবক্তা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। প্রশ্ন হল, ফরাসি সমাজের গভীরে প্রোথিত ‘শ্রমিক-প্রীতি’-র ‘অচলায়তন’ এ বার যে এত সহজে নড়ানো গেল, তার পেছনে নতুন সরকারের হাতযশ, বিরোধী পক্ষ ও শ্রমিক সংগঠনগুলির ভিতর বোঝাপড়ার অভাব, না কি জনসাধারণের নীরব সম্মতি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy