টুইটার-এর কর্ণধার জ্যাক ডর্সি। ছবি এএফপি।
রাজনৈতিক প্রচারের সুযোগ কিনিবার সামগ্রী নহে, তাহা অর্জন করিতে হয়।— নীতিগুরুর প্রচারিত সুসমাচার নহে, বামপন্থী তাত্ত্বিকের উচ্চারিত স্লোগান নহে, কথাটি বলিয়াছেন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির দুনিয়ায় অতিসফল ব্যবসায়ীদের অন্যতম, টুইটার-এর কর্ণধার জ্যাক ডর্সি। এই মাইক্রোব্লগিং সাইট অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত বার্তায় মতামত প্রকাশ তথা প্রচারের মাধ্যমটি ব্যবহার করেন দৈনিক গড়পড়তা বারো কোটির বেশি মানুষ। সংখ্যাটি ফেসবুকের দশ ভাগের এক ভাগও নহে ঠিকই, কিন্তু দৈনিক বারো কোটি উপভোক্তাকে তুচ্ছ করিবার কোনও উপায় নাই। রাজনীতির কারবারিরা তাহাকে তুচ্ছ করেনও না। দেশে দেশে তাঁহারা অনেকেই এখন নানা ঘোষণা এবং মতামত নাগরিকদের কাছে পৌঁছাইয়া দিবার জন্য টুইট করিতে অভ্যস্ত। যথেষ্ট প্রচারের তাগিদে বিজ্ঞাপন দিয়া আপন অবস্থান জানাইবার পথও অনেকেই অনুসরণ করেন। এই দ্বিতীয় পথটিই আগামী ২২ নভেম্বর হইতে বন্ধ হইবে, জানাইয়া দিয়াছেন জ্যাক ডর্সি। এই সিদ্ধান্তের যুক্তি হিসাবেই তাঁহার পূর্বোক্ত মন্তব্য।
সিদ্ধান্তটি অবশ্যই প্রশ্ন তোলে। প্রথমত, স্বাধীনতা খর্ব করিবার প্রশ্ন। ফেসবুক-এর কর্ণধার মার্ক জ়াকারবার্গ যখন টুইটার-প্রধানের বিপরীত অবস্থানে দাঁড়াইয়া বলেন, রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন বন্ধ করিলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়, সেই নীতিকথার পিছনে হয়তো পাটোয়ারি বুদ্ধিই কাজ করে, কিন্তু কথাটিকে উড়াইয়া দেওয়া চলে না। কোনও মাধ্যমে কাহারও বিজ্ঞাপন দিবার স্বাধীনতার উপর নিয়ন্ত্রণ থাকিতেই পারে। অন্যায় বা বিপজ্জনক বিজ্ঞাপন প্রচারে আপত্তির কারণও থাকে। এমন নিয়ন্ত্রণের নানা বিধি ও রীতি প্রচলিত রহিয়াছে। কিন্তু সমস্ত রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন পাইকারি ভাবে বন্ধ করিয়া দিবার সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক রীতির অনুকূল নহে— এই যুক্তি অগ্রাহ্য করা কঠিন। প্রশ্নটি আইনি অধিকারের নহে— ব্যবসায়ী কোন বিজ্ঞাপন লইবেন বা লইবেন না তাহা স্থির করিবার অধিকার তাঁহার আছে। কিন্তু গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে আইনের পরিধির বাহিরে নৈতিকতার প্রশ্নও থাকে। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নটি নৈতিকতার। গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার।
দ্বিতীয় প্রশ্ন জ্যাক ডর্সির সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা লইয়া। তর্ক উঠিয়াছে— ইহাতে ক্ষমতাবান রাজনীতিকদের কোনও সমস্যা হইবে না, কারণ তাঁহাদের কথা সংবাদ হিসাবেই প্রচারিত হয় এবং হইবে, মার খাইবেন তুলনায় দুর্বল এবং অসচ্ছল দল ও রাজনীতিকরা— সংবাদ হিসাবে তাঁহাদের বাজার কম, অথচ এখন বিজ্ঞাপনের টুইটার-পথও বন্ধ হইবে। জ্যাক ডর্সি কার্যকারিতার কথা বলেন নাই, তিনি সওয়াল করিয়াছেন নৈতিকতার যুক্তিতে। তাঁহার বক্তব্য, ইন্টারনেট বাহিত বহুজনপ্রিয় মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের প্রভাব বিপুল বলিয়াই তাহা সামাজিক আলোচনার পক্ষে, এবং তাহার পরিণামে রাজনীতির পক্ষে, বিপজ্জনক হইয়া উঠিয়াছে। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে বহুসংখ্যক ব্যক্তিকে একযোগে নিশানা করিয়া (‘মাইক্রোটার্গেটিং’) বিভ্রান্তিকর সংবাদ পরিবেশন এবং মিথ্যাকে সত্যের মুখোশ পরাইয়া তাঁহাদের নিকট উপস্থাপিত করিবার গভীর ষড়যন্ত্র (‘ডিপ ফেক’) ভয়াল আকার ধারণ করিয়াছে। সোশ্যাল মিডিয়া বা সমাজমাধ্যমে বাহিত বিজ্ঞাপন এই অনাচারের একটি শক্তিশালী প্রকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হইতে পারে। ট্রাম্পের আমেরিকা হইতে মোদীর ভারত— রাজনীতির বিকৃতিতে সমাজমাধ্যমের ভূমিকা এখন প্রতি মুহূর্তে প্রকট। বহু মানুষের নিকট অবাধে, অবিলম্বে এবং একযোগে বার্তা পৌঁছাইয়া দিতে পারে বলিয়াই সমাজমাধ্যম অমিতশক্তিধর এবং একই কারণে তাহার ক্ষতিসাধনের শক্তি অমিত। বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রিত বা নিষিদ্ধ করিবার উদ্যোগ বালির বাঁধ হইতে পারে, কিন্তু এই উদ্যোগকে অহেতুক বলা চলিবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy