টিভি সিরিয়ালে ভূত-চর্চা।
হঠাৎই খুব হইচই পড়ে গিয়েছে। টিভির একটি জনপ্রিয় রিয়্যালিটি শো-তে ভূত ধরার যন্ত্রপাতি নিয়ে হাজির হয়েছেন এক মহিলা। অতিনাটকীয় কুরঙ্গে রুচিসম্পন্ন দর্শক তো আহত হয়েছেনই, তার চেয়েও বড় প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, কী ভাবে ভূত-পেত্নির মতো লালিত কুসংস্কার টিভির পর্দায় এ হেন বৈধতা পেয়ে গেল? এ তো ভূতের গপ্পো নয় যে স্রেফ বানানো গল্প বলেই ছাড় পেয়ে যাবে! এ নিয়ে ইতিমধ্যে রুজু হয়েছে মামলাও।
কিন্তু শুধুই কি একটি রিয়্যালিটি শো বা একটি টিভি চ্যানেলে এ হেন দায়িত্ববোধহীন কুসংস্কারের চাষ? টিভি সিরিয়ালগুলো আষাঢ়ে গপ্পো বলে ছাড় পেয়ে যাবে?
এখন একটা মজা হয়েছে, যে সব সিরিয়ালে এ ধরনের মশলা থাকছে, সেখানে আগেভাগেই লিখে দেওয়া হচ্ছে ‘বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ’— ‘‘এই চ্যানেল কোনও রকম কু-প্রথাকে সমর্থন করে না।’’ কিন্তু তাতেই কি দায় এড়ানো যায়? প্রত্যন্ত বহু গ্রামে টিভির সামনে বসে আছেন এমন বহু মানুষ যাঁদের প্রাথমিক অক্ষরজ্ঞান থাকলেও একটা সম্পূর্ণ বাক্য পড়তে অক্ষম। অনেকে আবার সক্ষম হলেও এ সব আইন-বাঁচানো সতর্কীকরণ খেয়ালই করেন না। তাঁরা যা দেখেন ও শোনেন, সেটাকেই আত্মস্থ করেন।
ঘটনাচক্রে, এমনই একটি প্রত্যন্ত গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে গিয়ে এই বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছি প্রায়ই। দিনের পড়া নামে মাত্র শেষ করেই ছোট ছেলেমেয়েরা বাবা-মা বা বাড়ির অন্যদের সঙ্গে সিরিয়াল দেখতে বসে যায়। তাদের অপরিণত মস্তিষ্কে চুঁইয়ে ঢোকে ডাইনি আর নানা অতিপ্রাকৃতিক কাণ্ডকারখানা। ঢোকে, এবং গেঁড়ে বসে। তাদের মনে সত্যি হয়ে ওঠে ‘ভূতে পাওয়া’। ক্লাসে এসে তারা যে গল্পগুজব করে, তাতেও ফুটে ওঠে তার ছায়া।
কখনও শিক্ষিকার কাছে পড়ুয়ারা গল্প করে—‘‘জানো, বিনুনি কারা বাঁধে? ডাইনিরা... ওদের বিনুনিতে অনেক ক্ষমতা!’’ কাছে ডেকে যখন জিজ্ঞাসা করি, ‘‘এ সব কে বলেছে? কোথায় শুনেছিস?’’ তারা বলে, ‘‘টিভির নাটকে দেখায় না!’’ এর মধ্যে দু’এক জনের সন্দেহ হয়— ‘‘ডাইনি বলে কিছু নেই, বলো দিদিমণি?’’ তৎক্ষণাৎ চারপাশ থেকে অনেকগুলো গলা হইহই করে ওঠে, ‘‘সত্যি নয়? তা হলে টিভিতে দেখায় কেন!’’
আফশোস হয়, এ ভাবে কিছু টিআরপি-ভিক্ষু টিভি চ্যানেলের কাছে হার মানবে আমাদের শিক্ষাবিস্তারের চেষ্টা! ওরা বা ওদের পারিপার্শ্বিক বহু জনই তো বোঝে না কোনটা গল্প, কোনটা অভিনয়, কোনটা গ্রাফিক্সের কারসাজি, আর কোনটা বাস্তব। স্কুলে শিক্ষকেরা হয়তো বারবার বোঝাচ্ছেন, অন্ধবিশ্বাস মুছতে চাইছেন। কিন্তু তারা স্কুলে যা শুনছে আর বাড়িতে গিয়ে যা দেখছে, সে দুটো মিলছে না। ভয়ে, রোমাঞ্চে অন্ধবিশ্বাসকেই বরং আঁকড়ে ধরছে শিশুমন।
এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে কারও-কারও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও। মাতৃহারা এক বালিকা কিছু দিন জ্বরে ভোগায় তার ঠাকুমা তাকে নিয়ে যান ওঝা বা পিরের কাছে ‘ঝাড়িয়ে আনতে’। তার বাড়ির লোকের বিশ্বাস, মায়ের অতৃপ্ত আত্মাই ছ’বছরের মেয়ের স্বপ্নে আসে, তার কুনজরেই এই অসুখ! ডাক্তারের চেয়ে ‘জল পড়া’, ‘তেল পড়া'-তেই তাঁদের আস্থা বেশি। এঁরাই যখন দর্শক, তখন অলৌকিকত্বের বাজার থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। টিভি সিরিয়াল তারই ফায়দা তুলছে।
গত সেপ্টেম্বরে নাকাশিপাড়া থানা এলাকার অসুস্থ দুই শিশুকে ঝাড়ফুঁক করার নামে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল ওঝার বিরুদ্ধে। জাহ্নবী শেখ নামে বছর দশেকের এক বালিকা মারা যায়। গুরুতর জখম হয় তার ভাই, চার বছরের জাহাঙ্গির শেখ। ওই এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক আমার সহযাত্রী। সে দিন আক্ষেপ করছিলেন, ‘‘হয়তো এর দায় আমাদেরই! আমরাই পারিনি জ্ঞানের আলো জ্বালাতে।’’
নদিয়া বা তার আশপাশের জেলার গ্রামগুলোয়, অনেক ক্ষেত্রে শহরেরও আনাচে-কানাচে ভূতের নাচন চলছে। ওঝা, গুনিন, জানগুরুদের এখনও প্রবল দাপট। আজও এ রাজ্যে ডাইনি প্রথা বিরোধী কোনও আইন নেই। অবশ্য থাকলেও লাভ হত কি না, সন্দেহ। প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ডে সে রকম আইন থাকলেও সেখানেই ডাইনি অপবাদ দিয়ে হত্যার ঘটনা দেশে সর্বাধিক। কিছু টিভি সিরিয়াল এই আগুনে ঘৃতাহুতি দিচ্ছে। বাংলা ও হিন্দি দুই ভাষাতেই বুজরুকির ডুগডুগি বাজছে। তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধ হতে শিশু বলি, ডাকিনী বিদ্যা, মৃতের পৈশাচিক শক্তি নিয়ে ফিরে আসা, কপালের মাঝে হাত রেখে ভূত-ভবিষ্যৎ আন্দাজ করতে পারা—এ রকম রোমহর্ষক সব দৃশ্যে ছেয়ে রয়েছে মেগাসিরিয়ালের বাজার। অলৌকিক-লৌকিকে ফারাক বোঝানোর ক্ষীণ প্রচেষ্টা এক-আধটা যে হয় না, তা নয়। কিন্তু তা ঝড়ের মুখে নেহাতই খড়কুটোর মতো। মজার ব্যাপার, সিরিয়াল নির্মাতারা মাঝে-মাঝে এমনও দাবি করেন যে শেষে দেখানো হবে, তন্ত্রমন্ত্রের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু সেই মোক্ষম লগ্নে পৌঁছনোর আগে কমপক্ষে চারশো-পাঁচশো পর্বে যে দর্শকের মনে দৈবশক্তির সিংহাসন পাতা হয়ে গিয়েছে!
স্কুলে ছোটদের ‘বিজ্ঞান বনাম কুসংস্কার' রচনায় হামেশাই লেখানো হয়, ‘গণজাগরণের জন্য গণমাধ্যমকে সরব হতে হবে’। কার্যক্ষেত্রে হচ্ছে তার উল্টো। বেশির ভাগ শিক্ষক তাঁদের ভূমিকা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। অথচ কিছু টিভি চ্যানেল জেনে-শুনে বিষ ছড়ানোর আগে আইন বাঁচিয়ে বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে, ‘‘এই ধারাবাহিক শুধু মনোরঞ্জনের জন্য সম্প্রচারিত। এর দরুন কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে তার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষ নেবেন না।’’
তবে দায় নেবে কে?
ঈশ্বর? ভূত? ভূতের ওঝা?
শিক্ষিকা, ঘাটেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়, ধুবুলিয়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy