ভারতের ইন্টারনেট কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি দিল্লি পুলিশের নির্দেশে পরিবেশ সংক্রান্ত তিনটি ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাদের অপরাধ? শিল্প স্থাপনের আগে পরিবেশগত সমীক্ষার জন্য কেন্দ্রের পরিবেশ মন্ত্রক একপ্রস্ত নতুন নির্দেশিকা প্রস্তুত করেছে, সে বিষয়ে আইন মোতাবেক জনগণের মতামত আহ্বান করা হয়েছে। ওয়েবসাইটগুলি ওই নির্দেশিকার দোষত্রুটি ধরিয়ে এক একটা খসড়া প্রতিবাদপত্র তৈরি করেছিল: কেউ চাইলে সেটাই ডাউনলোড করে পরিবেশ মন্ত্রকে পাঠাতে পারেন। এই উদ্দেশ্যে মন্ত্রক একটি আলাদা মেলবক্স চালু করেছে।
দুনিয়া জুড়ে জনমত জানানোর এটা প্রচলিত সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ উপায়, আগেকার গণ-পোস্টকার্ড আন্দোলনের মতো। ইমেলগুলো চুপচাপ মন্ত্রকের মেলবক্সে জড়ো হয়, সুবিধামতো পড়া বা অন্তত গোনা যায়। তবু ইমেলের তোড়ে মাননীয় পরিবেশমন্ত্রী বিব্রত হচ্ছিলেন, অনেক মেল নাকি আসছিল সরাসরি তাঁর নিজস্ব মেলবক্সে (তার ঠিকানাও জনলভ্য, সাধারণ গণতান্ত্রিক রীতি মেনে)। অতএব, উৎপাত ঠেকাতে এই বিধান।
ওয়েবসাইটগুলি বন্ধ করা হয়েছিল দেশদ্রোহিতা ও সন্ত্রাসবাদের দায়ে— ভীতিপ্রদ ইউএপিএ আইনের বলে। শোরগোল ওঠায় দিল্লি পুলিশ বলে, হয়েছিল ভুলবশত। সেটাও কম ভীতিপ্রদ নয়। এই মারাত্মক আইন কি এমন হেলায় প্রয়োগ করা হয়? ওয়েবসাইটগুলি ফের চালু হয়েছে। তার একটা চালায় ‘ফ্রাইডেজ় ফর ফিউচার’ অর্থাৎ গ্রেটা থুনবার্গের বিশ্বখ্যাত পরিবেশ আন্দোলন। পৃথিবীর চোখে ভারতীয় গণতন্ত্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হল না।
প্রতিবাদপত্রের খসড়াটা আর ওই সাইটে খুঁজে পেলাম না। নিশানা হওয়া আর একটি সাইট ‘লেট ইন্ডিয়া ব্রিদ’-এ অনুরূপ খসড়া এই লেখার সময় অবধি বজায় আছে, কেউ চাইলে সেখান থেকে মন্ত্রকে বার্তা পাঠাতে পারেন। সত্যি বলতে কি, খসড়াটা আহামরি কিছু নয়। তবে দেশদ্রোহিতা দূরে থাক, আইনলঙ্ঘনের ঘুণাক্ষর চিহ্নও নেই। পুলিশ দিয়ে তার প্রচার বন্ধের কারণ দুর্জ্ঞেয়।
কিংবা কারণ অতি স্পষ্ট। পরিবেশের ব্যাপারে জনমত যাচাইয়ের একটা বালাই আছে, সেটা যথাসম্ভব নিষ্ক্রিয় করা, আইন ও নীতিবোধ চুলোয় যাক। নতুন নির্দেশিকা দেখলে এমন ধারণা দৃঢ় হয়। আমলাতান্ত্রিক অস্বচ্ছতার এমন নিশ্ছিদ্র উদাহরণ বড় মেলে না। পরিবেশ আইনের দুঁদে উকিল হয়তো থই পাবেন, আমি জীবনভর ইংরেজির শিক্ষক, হিমশিম খেয়ে গিয়েছি। আইনি ভাষা সঙ্গত কারণে খানিক দুরূহ হয়, এ ক্ষেত্রে এতটা হওয়া অকারণ ও অমার্জনীয়। অন্তত একটা সংক্ষিপ্তসার (এগজ়িকিউটিভ সামারি) অবশ্যই যোগ করা যেত, আগের আইনের থেকে কী কী পরিবর্তন তা নির্দেশ করা যেত। এক ধারার মধ্যে অন্যান্য ধারার দেদার ব্যাখ্যাহীন উল্লেখ— একটা বাক্য বুঝতে পাঁচ সাতটা আলাদা পাতা হাতড়াতে হয়, খেই হারিয়ে যায়।
এ ক্ষেত্রে ঘাটতিটা অমার্জনীয়, কারণ এই নিয়ম যাঁদের পক্ষে সবচেয়ে জরুরি, এবং যাঁরা জেনেবুঝে সবচেয়ে মূল্যবান পরামর্শ দিতে পারতেন, তাঁরা আমলাতন্ত্রে অনভ্যস্ত, তাঁদের জীবন কাটে মাটির সংস্পর্শে। এমনিতেই তাঁদের পরের মুখাপেক্ষী হতে হবে, কারণ খসড়া নিয়মাবলি প্রকাশ হয়েছে হিন্দি আর ইংরেজিতে, কোনও আঞ্চলিক ভাষায় নয়। নতুন শিল্প স্থাপনের আগে গণশুনানির পদ্ধতি নিয়ে দু’জায়গায় দু’প্রস্ত নির্দেশে কিছু অসঙ্গতি আছে। তবে সেখানেও পুরো নথি পেশ হবে কেবল ইংরেজিতে (হিন্দির উল্লেখ নেই, হয়তো ভুলবশত); আঞ্চলিক ভাষায় থাকবে শুধু সংক্ষিপ্তসার, যার মুসাবিদা নিশ্চয় হবে শিল্প মালিকের স্বার্থ বাঁচিয়ে। সেই নথি একমাত্র সশরীরে সরকারি দফতরে গিয়ে দেখা যাবে। আন্তর্জালে নয়, হোক না ডিজিটাল ইন্ডিয়া। শুনানির প্রস্তুতির জন্য সময় মিলবে কার্যত ২৫ দিন (বলা হচ্ছে ৪০ দিন যার ১৫ দিন কাটবে প্রশাসনিক পাঁয়তাড়ায়)। আর এক মোক্ষম শর্ত, কর্তৃপক্ষ যদি ভাবেন শুনানির পক্ষে অবস্থা অনুকূল নয়, তা বাতিল হতে পারে। অর্থাৎ, বিশেষ ক্ষতিকর কোনও প্রস্তাবের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ হলে সেই প্রতিবাদ সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হবে।
প্রস্তাবিত নিয়মগুলি বুঝতেও অভিজ্ঞ উকিল বা পরিবেশ কর্মীর দরকার, কারণ তার তাৎপর্য সাধারণত ধরা পড়ে একমাত্র আগের নিয়মের সঙ্গে তুলনা করলে। যেমন, কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় সড়কের সমীক্ষা করবে ১০০ কিলোমিটারের চেয়ে লম্বা আর ৭০ মিটারের চেয়ে চওড়া হলে (এত দিন ছিল যথাক্রমে ৩০ কিলোমিটার আর ২০ মিটার)। অর্থাৎ বড় প্রকল্পের উপরই নজরদারি কমল। অবশ্য, এই প্রবণতা ইউপিএ সরকারের শেষ দিকেও দেখা গিয়েছে। তখনও বিধান হয়েছিল, অতিবৃহৎ শিল্প বা খনির ক্ষেত্রে সাধারণ বিধি শিকেয় রেখে ছাড়পত্র বেরোবে। সেই মতো নির্বাচনের আগে অনুমোদন পেয়েছিল একগুচ্ছ প্রকল্প। সত্যি বলতে কী, কোনও শাসক দল পরিবেশ নিয়ে মাতামাতি পছন্দ করে না। আমাদের রাজ্যও জলাভূমি ধ্বংস থেকে বন কেটে পর্যটন, কোনওটাতেই কম যায় না। উন্নয়নে ভোট আছে, পরিবেশে নেই।
বর্তমান নির্দেশিকায় প্রচুর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়েছে বা একেবারে রদ হয়েছে। সবচেয়ে ভয়ের কথা, বিনা শুনানিতে সংরক্ষিত অঞ্চল, পরিবেশগত ভাবে বিপন্ন অঞ্চল এবং অত্যন্ত দূষিত (ক্রিটিক্যালি পলিউটেড) অঞ্চলের কাছে বা ভিতরে নানা রকম কর্মকাণ্ড চলবে। এমনকি ফাউন্ড্রি, রোলিং মিল ও সিমেন্টের ক্লিঙ্কারের কারখানা চলবে, জাতীয় বা রাজ্য সড়ক বাড়ানো যাবে, দেড় লক্ষ বর্গ মিটার পর্যন্ত স্কুল-কলেজ গড়া যাবে, হাসপাতাল মায় বাণিজ্যিক গুদাম এবং ৫০,০০০ বর্গ মিটার পর্যন্ত যে কোনও ভবনও তৈরি করা সম্ভব হবে। কোনও আবাসন প্রকল্পের জন্য, আয়তনে যতই বড় হোক, গণশুনানি লাগবে না।
আর একটি বিষয় পরিবেশবিদদের চিন্তায় ফেলেছে। বিধি লঙ্ঘন করে লঘু দণ্ডে নিষ্কৃতি পাওয়ার অফুরন্ত ছাড় রাখা হচ্ছে। জরিমানার বহর ছোট প্রকল্পে মাসে ৬০,০০০ টাকা, সবচেয়ে বড়গুলিতে মাসে ৩ লক্ষ টাকা! শিল্পপতিরা শুনে হাসবেন। বলা হচ্ছে, সেই সঙ্গে পরিবেশের ক্ষতিও দেড় বা দু’গুণ পূরণ করতে হবে। সদিচ্ছা থাকলেও (থাকবে কি?) সেই ক্ষতির অঙ্ক কষা কঠিন, আর অধিকাংশ ক্ষতি অনিবর্তনীয় বা ‘ইররিভার্সিবল’— স্বাস্থ্যহানি বা মৃত্যু, জনজাতির সামাজিক বিপর্যয়, নদী বুজে যাওয়া, মাটির গুণ নষ্ট হওয়া।
অন্তত দুই দশক ধরে আমরা দেখছি, পরিবেশ কর্তৃপক্ষের মূল লক্ষ্য ইতিবাচক ভাবে পরিবেশ রক্ষা নয়, শিল্প শিবিরের জমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের চাহিদা মেটানো। সে জন্য দফায় দফায় পরিবেশ আইন শিথিল করা, কার্যত শিল্প অনুমোদন দফতরের শাখা হয়ে যাওয়া (কেন্দ্রের বর্তমান পরিবেশমন্ত্রী শিল্পমন্ত্রীও বটে)। যেখানে শিল্প শিবিরের লাভ আছে (যেমন অপ্রচলিত শক্তির উন্নয়নে), এমন দু’-একটি ক্ষেত্রে বর্তমান ভারত সরকারের উদ্যোগ প্রশংসনীয়, কিন্তু সাধারণ ভাবে পরিবেশ ধ্বংসে তা হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। গত বছর ভারতের বন আইনের কিছু সর্বনাশা পরিবর্তনের চেষ্টা হয়েছিল, প্রবল বাধায় সফল হয়নি। নতুন পরিবেশ নির্দেশিকা যেন তার বিকল্প না হয়ে দাঁড়ায়।
এমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy