সেবায় রত (উপরে)। ‘নাইটিঙ্গেল’ মানপত্রের সঙ্গে তৃপ্তি বন্দ্যোপাধ্যায় (বাঁ দিকে)। ছবি: কল্যাণ আচার্য
‘মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও’— দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রীটিকে ভাবিয়েছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘দাঁড়াও’ কবিতাটি। স্কুলে যাওয়া আসার পথে, পরীক্ষার পড়ার ফাঁকেও নিজের মনে আওড়াতেন, ‘মানুষই ফাঁদ পাতছে, তুমি পাখির মতো পাশে দাঁড়াও, মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।’
মাঝে কয়েক দশক চলে গিয়েছে। কীর্ণাহার তারাপদ স্মৃতি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সেই ছাত্রী বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ থেকে নার্সের প্রশিক্ষণ নিয়ে ততদিনে নানুরের ব্লক স্বাস্থ্য পরিদর্শক। বীরভূম জেলা জুড়ে তাঁর সুখ্যাতি শিশু মৃত্যু প্রতিরোধ, কুষ্ঠ ও যক্ষ্মা নির্মূল করার প্রকল্পকে সফল করার জন্য।
শিশুদের অপুষ্টিজনিত রোগ দূর করা নিয়ে আইসিডিএস কর্মীদের সঙ্গে কাজ করার প্রস্তুতি তখন পুরোদমে। ২০১৫ সালের এমনই এক বৃহস্পতিবারের দুপুরে একটি ক্লাস নিতে গিয়ে তিনি যখন বোঝাচ্ছেন কীভাবে শিশুদের অপুষ্টির মোকাবিলা করতে হবে, চিঠি এল তাঁর নামে। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে আসা অশোক স্তম্ভ বসানো খাম। চিঠির উপর বড় বড় হরফে লেখা তাঁর নাম, তৃপ্তি বন্দ্যোপাধ্যায়। সেবার জন্য দেশের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি, ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল অ্যাওয়র্ড ফর লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট’ নেওয়ার জন্য দিল্লি যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন খোদ রাষ্ট্রপতি। খবরটা পাওয়ার পর সঙ্গে থাকা ছাত্রীরা উচ্ছ্বসিত হলেও সেই মুহূর্তে আনন্দকে চেপে মন দিয়েছিলেন কাজে।
সেদিনের কথা মনে করতে গিয়ে আইসিডিএস কর্মী মুন্তেহানা খাতুন, হাসমাতারা বেগমরা বলেন, ‘‘চিঠিটা আসার পর আমাদের খুব আনন্দ হয়েছিল। দিদি তাঁর যোগ্য সম্মান পাচ্ছেন। আমরা সবাই বলেছিলাম অপুষ্টি নিয়ে পরে শুনব, দিনটা সবাই আনন্দ করে কাটাই, কিন্তু দিদি কানেই তুললেন না। বললেন, ‘আমরা সেবিকা এটা সব সময় মনে রেখো। তোমাদেরও পুরস্কার পেতে হবে। তবেই আমার এই পুরস্কার পাওয়া সার্থক হবে।’ এ রকম করে ক’জন বলতে পারেন!’’
রাষ্ট্রপতি ভবনে পুরস্কারের অনুষ্ঠানটা ছিল জীবনের সেরা দিনগুলোর অন্যতম। সেই স্মৃতির পরতে পরতে অনেক অনুভূতি। নাগডিহিপাড়ার ছোট মেয়েটি স্থানীয় নিম্ন বুনিয়াদী বিদ্যালয়ের পর হাইস্কুলের গন্ডি পেরিয়ে জীবনকে সেবার ব্রতে বাঁধার সঙ্কল্প করে নিয়েছে বুঝতে পেরে অভিভাবকেরা ভর্তি করিয়েছিলেন বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে। নার্সের প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৮১ সালে প্রথম নানুর ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এএনএমআর হিসেবে কাজ শুরু পেশাদার সেবিকার। কিন্তু পেশার থেকেও প্রাণের তাগিদটা অনেক বেশি ছিল। একদিকে সেবার কাজ, অন্যদিকে প্রথাগত লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া বোলপুর কলেজে। স্নাতকের ডিগ্রি পাওয়ার পর অনেকে পরামর্শ দিয়েছিলেন অন্য কোনও চাকরির। কিন্তু ততদিনে মনস্থির হয়ে গিয়েছে। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জীবনী আত্মস্থ করে ফেলেছেন। ২০০৩ সালে বাঁকুড়া ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হেলথ সুপারভাইজার তারপর নানুর ব্লক স্বাস্থ্য পরিদর্শকের পদে চাকরি করতে গিয়ে অনেক ঘাত প্রতিঘাত পার হয়েছেন। মানুষের কষ্টের কথা, কান্নার কথা ছিল যে কবিতার লাইনে সেই কবিতাই তাঁর কর্মজীবনে পাথেয় হয়ে গিয়েছে। অসহায়, অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াতে ছুটেছেন স্থান - কাল, দিন – রাত ভুলে। মনে তখনও তিনি দ্বাদশ শ্রেণির কিশোরী। সমাজকে রোগমুক্ত করার একরাশ স্বপ্ন মনে। স্নেহ আর মমতার পরশে কুষ্ঠ রোগী থেকে যক্ষা আক্রান্ত সবাইকে আগলেছেন নির্দ্বিধায়। কখনও পুরস্কার পাবেন ভাবেননি।
রাষ্ট্রপতি সম্মানে সম্মানিত হওয়ার আনন্দের থেকেও রাষ্ট্রপতি ভবনে যাওয়ার অনুভূতিটা ছিল অন্যরকম। রাষ্ট্রপতি তখন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনিও কীর্ণাহারের মানুষ। ব্যক্তিগত ভাবে তৃপ্তিদেবী প্রণববাবুকে চিনতেন তাঁর বাবার সহপাঠী বলে। ছোটবেলার ‘প্রণবকাকু’। পুরস্কার পাওয়ার খুশির থেকেও বেশি আনন্দ হয়েছিল পিতৃতুল্য সেই মানুষটির সঙ্গে দেখা হবে বলে। স্নেহ আর মমতার স্বীকৃতি মিলবে আর এক স্নেহভরা সম্পর্কের হাত থেকে। এই প্রাপ্তিটাই বা ক’জনের হয়?
রাইসিনা হিলের জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে পুরস্কার পাওয়ার কথা বলতে গিয়ে এখনও চিকচিক করে ওঠে চোখের কোণ। এত বড় অনুষ্ঠানের মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বয়ং রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার নেওয়ার সময়ও মনের মধ্যে ঘুরছিল ছেলেবেলায় পড়া সেই কবিতার লাইনগুলো। সেবার মন্ত্র নিয়ে জীবনের লক্ষ্য শুরু করার সময় যে কবিতাটা জীবনকে অন্য ভাবে ভাবতে সাহায্য করেছিল, কবিতার সেই কথাগুলোই মনে করিয়ে দিয়েছিল রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে উত্তরীয় পরার পর মানপত্র হাতে নিয়ে। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্যই তো
এই সম্মান।
রাঙামাটির মানুষেরা অবশ্য তৃপ্তিদেবীকে চেনেন মুশকিল আসান নামে। বয়স ৫৪’র ঘরে। কিন্তু কেউ অসুস্থ শুনলে এখনও তিনি সদ্য প্রশিক্ষণ নেওয়া নার্সের মতই তৎপর। কেউ অসুস্থ হলেই ডাক পড়ে তাঁর। ছোটখাটো শরীর খারাপ, কাশি, সর্দি, জ্বরে পাড়া – বেপাড়ার মানুষের ভরসা ‘তৃপ্তিদিদি’। নিজের কাছে টুকিটাকি ওষুধপত্র রাখেন। বাড়াবাড়ি বুঝলে স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে পাঠানোর উদ্যোগ নেন নিজেই। নানুর ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক মহম্মদ ইসমাইল, বিএসআই সুব্রত পৈতন্ডীদের কথায়, ‘‘কাজের প্রতি তৃপ্তিদেবীর নিষ্ঠা অনস্বীকার্য। মানুষের পাশে দাঁড়াতে নাওয়া খাওয়া ভুলতে পারেন তিনি।’’ আশাকর্মী পার্বতী মণ্ডল, তাহেরা খাতুন, কাজল সুত্রধরদের কারও কাছে তিনি দিদি কারও কাছে মা।
কৃতী তিনি, তাঁর কথা বলতে গিয়ে আপ্লুত হন পালিতা কন্যা লক্ষ্মী মুর্মু। পিতৃহীন লক্ষ্মীকে চার বছর বয়স থেকে নিজের কাছে রেখে সন্তান স্নেহে মানুষ করেছেন। লেখাপড়া শিখিয়েছেন। লক্ষ্মী এখন আইসিডিএস কর্মী। তাঁর কথায়, ‘‘কৃতি মানুষ বলেই এত ব্যাপ্তি তাঁর। কখনও কোনও অভাব বুঝতে পারলাম না, আগলে রাখলেন বটগাছের মতো।’’
পরিবারে তিন ভাই বোনের বড় তৃপ্তিদেবী। ৩৪ বছর বয়সে মা স্বর্ণময়ীদেবী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ভাই-বোনদের মানুষ করা, পালিত কন্যাকে লালন পালনে নিজের আর বিয়ে করা হয়নি। পাড়া-পড়শিরা বলেন, ‘‘গোটা কীর্ণাহারইতো ওঁর সংসার।’’ তৃপ্তির হাসি হাসেন তৃপ্তিদেবী। এই সম্মানটা তাঁর অর্জিত। বাইরে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার সেবায় নিবেদিত প্রাণ। ঘরে শয্যাশায়ী বাবা। বাড়ি ফিরে তাঁর শুশ্রূষা। আর এসবের ফাঁকেই রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, আশাপূর্ণাদেবী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় ডুবে যাওয়া। তাঁর কৃতি হওয়ার পিছনে এই মানুষদের লেখনির অবদান যে অনেক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy