তিন তালাক বাতিল ঘোষিত হওয়ায় পাশ হয়ে যাওয়া ‘মুসলিম মহিলা (বৈবাহিক অধিকার সুরক্ষা) বিল’ একটা সংগ্রামের দলিল। মুসলিম মেয়েদের অধিকারের রক্ষাকবচ। পাঁচ তালাকপ্রাপ্ত মহিলার মামলার প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট আগেই মৌখিক তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথাকে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে। এ বারে বিল পাশের ফলে প্রণীত আইন মুসলিম মেয়েদের আর এক ধাপ এগিয়ে দেবে, এটাই প্রত্যাশা। ক্ষমতায়নের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত মুসলিম মেয়েদের হাতে ধরা দিল। উচ্ছ্বাস নয়, শুধু অধিকারের আহ্বানে এক নতুন দরজার সন্ধান পেল মুসলিম মেয়েরা। কৃতিত্বের দাবিদার অনেক। কিন্তু জয়ের প্রকৃত হকদার মুসলিম মেয়েরাই।
২০১৮ সালের তিন তালাক অধ্যাদেশে প্রাপ্ত মেয়াদ ২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি শেষ হওয়ার কথা ছিল। অধ্যাদেশটি প্রতিস্থাপনের জন্য সরকার লোকসভায় নতুন বিল উত্থাপন করে ২০১৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর। সেখানে পাওয়া বিলের বিধান অনুযায়ী, লিখিত বা বৈদ্যুতিন আকারে তাৎক্ষণিক তিন তালাকের সমস্ত ঘোষণা বাতিল (আইনে প্রয়োগযোগ্য নয়) এবং অবৈধ। সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড এবং জরিমানা-সহ স্বীকৃত হবে অপরাধ। জরিমানার পরিমাণের বিষয়ে ম্যাজিস্ট্রেট সিদ্ধান্ত নেবেন। অপরাধ সম্পর্কিত তথ্য কেবল স্ত্রী বা তাঁর রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় যদি দেন তবেই এই অপরাধটি বোধগম্য হবে। অপরাধটি জামিনযোগ্য নয়। তবে ম্যাজিস্ট্রেট অভিযুক্তের জামিন মঞ্জুর করতে পারেন এমন বিধান রয়েছে। জামিন মঞ্জুর করা যেতে পারে কেবল স্ত্রীর কথা শুনে। এবং ম্যাজিস্ট্রেটকে জামিন দেওয়ার পক্ষে যুক্তিসঙ্গত কারণে সন্তুষ্ট হতে হবে। স্ত্রী খোরপোষ পাওয়ার অধিকারী। ম্যাজিস্ট্রেট তার পরিমাণও নির্ধারণ করবেন। স্ত্রী বিবাহজাত নাবালক বাচ্চাদের হেফাজত পাওয়ার অধিকারী। হেফাজতের পদ্ধতি ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা নির্ধারিত হবে। মহিলার অনুরোধে (যাঁর বিরুদ্ধে তালাক দেওয়া হয়েছে) ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধটি আরও মিশ্র ভাবে দেখতে পারেন (অর্থাৎ আইনি কার্যক্রম থামিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি)। গত বছর রাজ্যসভায় আটকে পড়া বিল এ বছর পাশের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেল সংশয়ের সব আখ্যান। তালাকের বিরুদ্ধে মুখ খোলার আইনসম্মত অধিকার আদায় করে নিল মেয়েরা।
তালাক বা বিচ্ছেদ এক ঋণাত্মক স্বর বহন করে। বিবাহ যদি বন্ধন হয় তবে সেটা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে যায় না সব। সম্পর্কে ইতি টানা মানেই সম্পর্কজাত যাবতীয় কিছু ঝেড়ে ফেলা নয়। জুড়ে থাকা অজস্র সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে বড় হল সন্তানের ভবিষ্যৎ ও তালাক পাওয়া স্ত্রীর জীবনধারণের উপায়। অর্থমূল্যের বাইরেও সেই মহিলার দৈনন্দিন নানাবিধ প্রয়োজন থাকে। এই প্রয়োজনকে কোনও সংজ্ঞা দিয়ে বেঁধে দেওয়া মুশকিল। এক মেয়ের সীমাবদ্ধতা অনেক। এক মায়ের প্রতিবন্ধকতা পদে পদে। প্রান্তিক এলাকার মুসলিম মেয়েরা বিয়ের পরে স্বামীকেই অভিভাবক মানে। তাই স্বামী চলে যাওয়া মানে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া। নিজে তেমন শিক্ষিত নন, আর্থিক সমস্যা রয়েছে এবং স্বামী বিচ্ছিন্ন। এমন ত্রিমুখী সমস্যার চাপে জেরবার মুসলিম মহিলা। তাই বৈবাহিক সুরক্ষা মুসলিম মেয়েদের জন্য যে জরুরি ছিল তা বলাই বাহুল্য। তা উপেক্ষিত রইল না আর। এ নিঃসন্দেহে এক উদ্যাপনের মুহূর্ত।
বেআইনি ঘোষিত তালাক পদ্ধতিকে প্রয়োগ করলে দোষীর জেল–জরিমানা হবে। আবার স্ত্রীর কথা শুনে ম্যাজিস্ট্রেট সিদ্ধান্ত নিলে তবেই জামিন। মেয়েদের হাতে এই ক্ষমতা তুলে দেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী তালাক দেওয়ার অধিকার পুরুষের হাতে দেওয়া হয়েছে। মুসলিম মেয়েদের তালাক দেওয়ার অধিকার নেই। কিন্তু চাওয়ার অধিকার আছে। স্ত্রী শুধুমাত্র তখনই তালাক চাইতে পারবেন, যদি বিয়ের সময় এর লিখিত অনুমতি স্বামীর কাছ থেকে নেওয়া থাকে। আর এমন অনুমতি নেওয়ার কথা কেউই বিবাহের মতো এক অনুষ্ঠানে ভাবেন না। আবার অনেকে এ ব্যাপারে ওয়াকিবহালও নন। তাই দাম্পত্যের মধ্যবয়সে এসে হঠাৎ ভাল না লাগার কারণে বা অন্য কোথাও মন উড়ে গেলে তালাক পদ্ধতির অবাধ অপব্যবহার হয়ে থাকে। মৌখিক তাৎক্ষণিক তিন তালাক তাই এক হাতিয়ারে পরিণত হয়। মেয়েদের সব সময় তালাকের ভয় দেখিয়ে চাপে রাখার শর্ত হয়ে উঠেছিল এই মৌখিক তাৎক্ষণিক তিন তালাক।
বাইরে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন স্বামী। তাঁর বাড়ি ফেরার কথা ছিল সকালে। কিন্তু রাতে বাড়ি ফিরে দেখেন, স্ত্রী রান্না করে রাখেননি। রেগে গিয়ে তিনি তিন বার তালাক বলে দিলেন। তার পরে ভোরের আলো ফুটতেই ফিরে গেলেন ভিন্রাজ্যে। এ বার মেয়েটিকে আর শ্বশুরবাড়ি থাকতে দেওয়া হল না। তিনি ছেলে কোলে চলে এলেন বাপের বাড়ি। এমন ঘটনায় ছেয়ে আছে গ্রামাঞ্চল। ঘরে ঘরে মেয়েদের এক কথা, ‘স্বামী কাজে গিয়ে আসেনি আর।’ এ এক বিবাহিত বৈধব্যের জীবন তাঁদের। হয়তো পরবর্তীতে কারও সঙ্গী জুটে যায়, কারও জোটে না। এমনকি বহু শিক্ষিত লোকজনও ব্যবহার করেন এই তালাক পদ্ধতি। সরকারি দফতরের প্রাক্তন এক আধিকারিক স্ত্রীকে তাৎক্ষণিক ‘তিন তালাক’ দেন। অপরাধ, অনেক দিন ধরে ডাল কৌটোবন্দি থাকায় তা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এখন তিনি সেই স্ত্রীর সঙ্গেই সংসার করছেন। কিন্তু কথায় কথায় ধমকের সুরে বলেন, ‘আমি তো তালাক দিয়ে দিয়েছি।’ বাড়ির মহিলাকে দমিয়ে রাখার এটা একটি বড় অস্ত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল। যদিও হিসেবের মধ্যে এই ঘটনাগুলি না আসায় গুরুত্ব পায়নি কোনও দিন।
সংসারে তালাকের নিরন্তর ভয় দেখানোটাও একধরনের অপমান। নিজের ইচ্ছে প্রতিষ্ঠার জন্য স্বামী স্ত্রীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন এবং নানা অজুহাত খুঁজবেন, এ কখনও মেনে নেওয়া যায় না। বৌ ভাল নয়— এ কথা চিরদিনের। কেন? এ কথা কেউ ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করেন না। তালাক কেন? ‘বৌ খারাপ’। কী করেছিল? কখনও উত্তর আসে ‘বৌয়ের অসুখ খুব’। কখনও ‘বয়স বেশি’। কখনও ‘শুয়ে থাকে দিনরাত’। আবার কখনও ‘অলস, কাজ করে না বাড়ির’। আবার ‘মাথায় কাপড় দেয় না। মোবাইল টিভি নিয়ে বসে থাকে।’ এর একটিও চিকিৎসা বিজ্ঞান বা জীববিদ্যা সমর্থিত অসুখ বা জটিলতা নয়। এক আরবির শিক্ষক গত পাঁচ বছরে তিন বার বিয়ে করলেন। প্রথম বউ প্রতিজ্ঞা করলেন, স্বমীকে তিনি প্রশ্রয় দেবেন না। দুই সন্তান নিয়ে নিজের মতো থাকবেন। কিন্তু বাকি বৌয়েরা সমঝোতায় রাজি হলেন। এখন সেই শিক্ষক ইচ্ছেমতো আরও বিয়ে করতে পারেন। এ ভাবে মেয়েদের আর্থিক দুরবস্থা ও বাবার বাড়িতে ফিরে যাওয়ার অযথা এক অসম্মানবোধের ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে অত্যাচার চলতেই থাকে।
আসলে আর্থিক স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদা বোধ মেয়েদের মধ্যে গড়ে তোলা হয় না। তার প্রধান কারণ শিক্ষার অভাব ও পারিবারিক দিক থেকে মেয়েদের স্বাধীন করে তোলার ভাবনার অভাব। বিয়ের পরে বাড়ির বৌকে হেনস্থা করতেই যে মৌখিক তিন তালাক সে নিয়ে কোনও পদক্ষেপ করেন না মেয়ের বাবার বাড়ির লোক।
সবচেয়ে দুঃখের কথা, স্বামী ধর্ম, সমাজ শরিয়তকে হাতিয়ার করে তিন তালাক দিচ্ছেন। কিন্তু স্ত্রী প্রতিবাদ করতে পারছেন না। মেনে নিচ্ছেন। এ বারে প্রতিবাদের ক্ষমতা স্ত্রীদের হাতে আসবে। তাঁরাও শাস্তির জন্য আবেদন করতে পারবেন। এ অধিকার খুব জরুরি ছিল।
শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy