Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Train

বাতিল বহু ট্রেন, ভোগান্তি দূর হবে কবে

কখনও কখনও মনে হয়, দুর্ভোগ অশান্তির মধ্যে পড়লে মানুষ যেন স্বাভাবিক মানবিকতা ভুলে যায়। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে আমরা এই সময়টা দূরে সরে থাকি। দীর্ঘ দিন ধরে ট্রেন বাতিল হয়ে পড়ে থাকায় আমাদের মনেও কি সেই কুপ্রভাব বাড়ছে? লিখছেন দেবযানী চক্রবর্তীগত বছর এনআরসি-র প্রতিবাদ করার সময় কিছু ট্রেন ভাঙচুর হয়।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০২:০৮
Share: Save:

মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা যাওয়ার ট্রেনগুলোর মধ্যে সব থেকে জনপ্রিয় সম্ভবত লালগোলা প্যাসেঞ্জারই। কিন্তু সেই ট্রেনই এখন কমে গিয়ে দুর্ভোগ বাড়িয়েছে তামাম জেলার মানুষের। রিকশাচালক জুমান শেখের কথা থেকেই যা পরিষ্কার। ‘‘এতগুলা ট্রেন বাতিল, প্যাসেঞ্জার পাচ্ছি না, বৌ-বাচ্চা লিয়ে সংসার, কী করে খরচ চালাই বুলেন তো?’’ বেশি টাকা চাওয়ায় জুমানকে প্রশ্ন করতে হয়েছিল, কেন তিনি এমন অন্যায্য ভাড়া দাবি করছেন। তারই জবাবে জুমানের ওই বক্তব্য। আমরাও যত ন্যায় এঁদের থেকেই আশা করি, যে মানুষগুলোর দিন চলে কোনও মতে। কাজেই চলতে থাকে দর কষাকষি। জুমানকে কিছুতেই অন্যায় কাজ করতে দেওয়া যাবে না যে। শেষে একটা রফা হয় অবশ্য। কিন্তু তার পরেই মনে মনে ভাবি, ট্রেন বাতিলের ধাক্কায় জুমানের মতো এমন অসংখ্য শ্রমজীবীর আজ বড়ই দুর্দিন।

গত বছর এনআরসি-র প্রতিবাদ করার সময় কিছু ট্রেন ভাঙচুর হয়। তার পর থেকেই এই অবস্থা। এনআরসি বা সিএএ নিয়ে চাপা অসন্তোষ তো টের পাওয়াই যাচ্ছিল। আমাদের সর্ব-ধর্ম সমন্বয়ের দেশে এ জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকরণ নিয়ে অনেকেই বিরূপ মনোভাব পোষণ করছিলেন। একটি বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায় এক্ষেত্রে সরকারি সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠছিল। জনদরদী শিক্ষিত মানুষ অনেক পোস্টও দিচ্ছিলেন সামাজিক মাধ্যমে। কিন্তু প্রতিবাদের নামে এমন বরবাদ!

কেন্দ্রীয় সরকারের ওই নয়া নীতিতে ক্ষিপ্ত হয়ে ভেঙে ফেলা হয় একের পর এক স্টেশন। পোড়ানো হল রেলগাড়ি, বাস ইত্যাদি। কত দিনের প্রচেষ্টায় মুর্শিদাবাদ জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটেছিল। দ্রুতগামী ট্রেনে মানুষ কত কম সময়ে মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা গিয়ে শিক্ষা তথা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে সুবিধে পাচ্ছিলেন।সে পথে বাধা তৈরি হল।

এনআরসি এবং সিএএ প্রতিবাদ অবশ্যই করা দরকার। কিন্তু এটা কী ঘটানো হল প্রতিবাদের নামে! অনেক ট্রেন বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। সিগন্যালিং সিস্টেম নষ্ট করে দেওয়ায় পুনরায় গোলা পদ্ধতি চালু হল। তাই কিছু ট্রেন পুনরায় চালানো শুরু হলেও ট্রেনের গতি কিন্তু কমে গিয়েছে। ফলে নির্দিষ্ট সময় আর মান্যতা পাচ্ছে না। আর এর ফলস্বরূপ চূড়ান্ত দুর্ভোগ নিত্য যাত্রীদের।

সুচেতনা মুখোপাধ্যায় কর্মসূত্রে কল্যাণী থেকে আসেন জিয়াগঞ্জ। কল্যাণী থেকে রানাঘাট, তার পর হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেসে জিয়াগঞ্জ। নিত্যদিন এ ভাবেই যাওয়া আসা করেন আরও অনেকেই। অনায়াসেই তাঁরা নিত্যযাত্রা বজায় রাখেন। কিন্তু বেশ কিছু দিন হাজারদুয়ারিও বন্ধ ছিল। ফলে তাঁদের চরম দুর্গতিতে পড়তে হয়। যদিও খুবই সৌভাগ্যের ব্যাপার যে হাজারদুয়ারি পুনরায় চালু হয়েছে। কিন্তু সব ট্রেন এখনও নিয়মিত হয়নি। বাতিল রয়েছে কয়েকটি। বিশেষত যাঁরা লালগোলা যান, তাঁদের সামনে তো এখনও কোনও আশার আলো নেই। চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে তাঁদের। ট্রেন যাচ্ছে না বলে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন অনেকেই। ভাড়া গাড়িতেই কয়েক জন মিলে প্রতিদিন স্কুলে যাতায়াত করছেন বলে জানালেন শিক্ষিকা সুপর্ণা চন্দ। দীর্ঘ পথ নিত্যদিন এভাবে বিপুল অর্থ ব্যয় করে যাতায়াত কী মুখের কথা।

ট্রেন কমে যাওয়ায় নিত্যযাত্রীরা তো চরম দুর্ভোগে আছেনই, তারই সঙ্গে বড় অসহায় পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন ট্রেনের হকাররাও। প্রসাধনী বিক্রেতা দীপঙ্কর দাস বলছিলেন, রুজি রোজগারে বড়ই মন্দা। যেহেতু ট্রেন কম, তাই যেগুলি চলছে সেগুলিতে মাত্রাতিরিক্ত ভিড়। যাত্রীদের ঠিক মতো দাঁড়ানোরই পরিস্থিতি থাকছে না, সেখানে হকাররা ঢুকবেন কী করে! কেউ জোর জবরদস্তি ঢোকার চেষ্টা করলেই বাঁধছে অশান্তি। তবু এরই মধ্যে তাঁদের কাজ করতে হচ্ছে। ফল বিক্রেতা কমল মণ্ডল বলছিলেন, ‘‘আমরা যেন মানুষ না, পাবলিক এত বাজে ব্যবহার করে আমাদের সাথে, খুব মানে লাগে।’’

কখনও কখনও মনে হয়, দুর্ভোগ অশান্তির মধ্যে পড়লে মানুষ যেন স্বাভাবিক মানবিকতা ভুলে যায়। কোনও মতে নিজেরটুকু করতে পারলেই খুশি। সমাজের জন্য যে দায়বদ্ধতা আমাদের দেখানো প্রয়োজন, তা থেকে আমরা এই সময়টা দূরে সরে থাকি। একের পর এক ট্রেন দীর্ঘ দিন ধরে বাতিল পড়ে থাকায় আমাদের মনেও কি সেই কুপ্রভাব বাড়ছে? সকলেরই তো মান রয়েছে, অভিমান আছে। আত্মচেতনা রয়েছে। সেটা সবাই মাথায় রাখলে অনেক সমস্যারই সহজ সমাধান ঘটতে পারে। কিন্তু তা আর দেখতে পাই না।

ট্রেন বা স্টেশনকে কেন্দ্র করে মানুষের জীবন যে কীভাবে যাপিত হয়, তা এই দুর্দিনে বড় বেশি স্পষ্ট প্রত্যক্ষ হচ্ছে। বিপুল জনসংখ্যা বৃদ্ধির দরুণ আজকাল অফিস টাইম বলে চিহ্নিত সময়ে প্রায় সমস্ত স্টেশনেই ভিড় উপচে পড়ে। ট্রেন থেকে নেমে নিত্যযাত্রীরা ম্যাজিক ভ্যান, অটো রিকশা, টুকটুক বা রিকশায় চাপেন। দিনের ওই বিশেষ সময় সেসব গাড়ির চালকদের রোজগার বেশ সন্তোষজনকই হয়। হঠাৎ সৃষ্ট পরিস্থিতিতে জুমান শেখের মতো এ হেন চালকদেরও মাথায় হাত। সংসার চালানোই বড় দায় হয়ে পড়ছে তাঁদের। কারণ মূলত স্টেশননির্ভর জীবন তাঁদের। স্টেশনে ট্রেন না এলে যাত্রী পাবেন কোথা থেকে তাঁরা। সব চেয়ে দুর্গতি রিকশাচালকদের। কম খরচে টুকটুকে হয়ে যাচ্ছে বলে মানুষ ওই দিকেই ঝুঁকছেন। রিকশাচালকদের ক্ষেত্রে সারা দিনে হয়তো একটি বা দু’টি যাত্রী মিলছে। কিন্তু এ ভাবে আর কত দিন চলে!

অভিযোগ যখন যুক্তিমাফিক, প্রতিবাদ সেখানে ন্যায্য। কিন্তু প্রতিবাদের জন্য এত লোকের ক্ষতি হলে সে কথাও তো ভাবতে হবে! দেশের সরকার ট্রেন বাতিল করেই হাত ধুয়ে ফেলেছে। নিত্যযাত্রীরা প্রতিদিন এই সমস্যায় পড়ছি। এনআরসি হলেও আমরা বিপদে পড়ব, তার প্রতিবাদ করার সময়েও আমরা বিপদে পড়লাম। রাজনৈতিক দলগুলি কি সে কথা ভেবে দেখেন না?

তাঁরা কি সে কথা ভেবে দেখবেন?

শিক্ষক, শ্রীপৎ সিংহ কলেজ

অন্য বিষয়গুলি:

TRAIN LALGOLA EXPRESS NRC CAA
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy