ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে যোগাযোগের সুবন্দোবস্ত করার জন্য টয় ট্রেন তৈরির প্রয়োজন অনুভব করেছিল ব্রিটিশ সরকার।
সেই কোন কাল থেকেই পাইন দেবদারুর জঙ্গলের মাঝ দিয়ে পাহাড়ি খরস্রোতা ঝরনার পাশ কাটিয়ে কু-ঝিক-ঝিক শব্দের মধ্য দিয়ে স্টিম ইঞ্জিনের সাথে সাথে দেশলাই বাক্সের মতো দেখতে সেই ছোট্ট ট্রেন কী ভাবে অনির্বচনীয় প্রাকৃতিক শোভা নিয়ে, কাঞ্চনজঙ্ঘাকে সঙ্গে নিয়ে, বাতাসিয়া লুপকে পাশ কাটিয়ে দার্জিলিং পাহাড়ি শহরের উপকণ্ঠে ছোট স্টেশনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে, খেয়ালই থাকে না। বাঙালির স্মৃতিমেদুরতায় দার্জিলিং আর তার টয় ট্রেন যে কখন একাত্ম ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে, সে খেয়াল কেউই করেনি।
পাহাড়ি পাকদণ্ডী বেঁয়ে আঁকাবাঁকা পথে ঘুরে ঘুরে টয়ট্রেনের ভ্রমণকথা, অনেক না বলা কথাকে নীরবে প্রকাশ করে দেয়। সেই কবেকার ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে যোগাযোগের সুবন্দোবস্ত করার জন্য টয় ট্রেন তৈরির প্রয়োজন অনুভব করেছিল ব্রিটিশ সরকার। ১৮৮১ সালের ৪ জুলাই সেই পথের উদ্বোধন হয়। যদিও তার আগের থেকেই দার্জিলিং নামক এই পাহাড়ি জনপদের কথা ধীরে ধীরে জানতে পারছিল বাঙালি, ইংরেজদের সৌজন্যেই। সেই আমলে জলধর সেনের বই থেকে দার্জিলিং তথা হিমালয়ে সম্মন্ধে অনেক কিছুই জানা যায়। তাও টয় ট্রেন তখনও বাঙালি মননে চেপে বসেনি।
এই পাহাড়ি রাস্তায় কী ভাবে এই ছোট ট্রেন যেতে পারে, তা পাশ্চাত্য ঔপনিবেশিক প্রযুক্তির এক অন্যতম উদাহরণ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে, ১৮৯৬ সালে, সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন যখন দার্জিলিং গিয়েছিলেন, তখন তিনি এই ট্রেন চড়ে বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছিলেন। তখন তিনি এর নামকরণ করেন টয় ট্রেন এবং এই রেলপথে ভ্রমণকে তাঁর জীবনের অন্যতম উপভোগ্য একটি অধ্যায় বলে অভিহিত করেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে বলা যায়, টয় ট্রেন চালু হওয়ার আগে ব্রিটিশ শাসক তথা চা-বাগান মালিকেরা পণ্য এবং চায়ের পেটি পরিবহণের জন্য বুলক ট্রেন ব্যবহার করতেন। এই ট্রেন প্রায় ১৮৮ মাইল পথ চলত। যাত্রা শুরু হত সাহেবগঞ্জ থেকে এবং শেষ হত দার্জিলিংয়ে। বাক্সের মতো দেখতে সেই ট্রেনগুলো মূলত পণ্য পরিবহণ করত। দু'টি করে বলদ সেই সব বাক্সের মতো কামরা টেনে নিয়ে যেত দার্জিলিং অবধি। বর্ষাকালে হাতি টেনে নিয়ে যেত সেই সব কামরা।
ব্রিটিশ শাসকেরা দার্জিলিংকে তাদের ইউরোপীয় আবহাওয়ার সঙ্গে মিল পাওয়ায় এই দুর্গম পাহাড়ি এলাকাকে নিজেদের স্বাস্থ্য উদ্ধারের কেন্দ্র হিসেবেই গড়ে তুলেছিল। কিন্তু কালক্রমে এই অঞ্চলের অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও বরফে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য দেখার নেশায় বাঙালি তথা ভারতবাসী এবং বিদেশি পর্যটকেরা প্রতিনিয়ত আসা-যাওয়া শুরু করলেন। এর ফলে দার্জিলিং এখন পৃথিবীর অন্যতম পর্যটন ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। দার্জিলিঙের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে টয় ট্রেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্ন থেকেই বাঙালি মনকে জড়িয়ে ফেলেছিল দার্জিলিং আর তার টয়ট্রেন। যদিও সেই সময় শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন থেকে দার্জিলিং যেতে প্রায় ৯/১০ ঘণ্টা লাগত। বাষ্পচালিত বা কয়লার রেল ইঞ্জিনের মাধ্যমে। যদিও পরবর্তী কালে ডিজেল ইঞ্জিনের দৌলতে তা প্রায় ৬/৭ ঘন্টার মধ্যে নেমে আসে।
কত যে বিখ্যাত বাঙালি তথা বিদেশি এই টয় ট্রেনে দার্জিলিং গিয়েছেন, তার হিসেব নেই! শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন মহামানবদের পদধূলিতে নিজেকে সম্মানিত করেছে!
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। যিনি হিমালয়ে প্রায়ই ঘুরতে যেতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যিনি প্রায়শই সুযোগ পেলে দার্জিলিং চলে আসতেন। নজরুল, বিবেকানন্দ, জগদীশচন্দ্র, মার্ক টোয়েন, চিত্তরঞ্জন, নিবেদিতা, গাঁধী, মৈত্রেয়ী দেবী, বাঘাযতীন, অবনীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, রাজেন্দ্রপ্রসাদ! রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখায় দার্জিলিংয়ের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে বারবার। আর দার্জিলিং গেলে কবির পছন্দ ছিল এই টয় ট্রেন। কবি শেষবার পাহাড়-ভ্রমণ করেন (যদিও দার্জিলিং আসেননি) এই টয় ট্রেনেই পুত্র রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে। ১৯৪০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনে কবিকে দেখার জন্য লোকারণ্য হয়ে গিয়েছিল! যে কথা মৈত্রেয়ী দেবী 'মংপুতে রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থে বিস্তারিত ভাবে লিখেছেন। সুভাষচন্দ্র বসুও বেশ কয়েক বার টয় ট্রেনেই কার্শিয়াং যান।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী, শিবনাথ শাস্ত্রী সবাই এই টয় ট্রেনে চেপেই পাহাড়ে যান এবং ভ্রমণ উপভোগ করেন। বয়সে আশির কোঠায় পৌঁছানোর পর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়তে থাকে প্রবল ভাবে, সেই অবস্থায় তাঁকে দাজিলিং নিয়ে যাওয়া হয় এই টয় ট্রেনেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে এই টয়ট্রেনেই দার্জিলিংয়ে এসেছিলেন এবং সেখানে 'রোজভিলা'তে ১৮৮২ সালের অক্টোবরে কয়েকদিন কাটিয়েছিলেন। শোনা যায়, সেটিই তাঁর প্রথম দার্জিলিং-ভ্রমণ। ‘আরাধনা’ ছবিতে রাজেশ খন্না আর শর্মিলা ঠাকুরের সেই বিখ্যাত স্বপ্ন কি রানি গানের সঙ্গে টয় ট্রেনের দৃশ্যায়ন ষাট-সত্তর দশকের বাঙালিমনকে উদ্বেলিত করে তুলেছিল।
সত্যজিতের 'কাঞ্চনজঙ্ঘা'য় যে ভাবে দার্জিলিংকে ধরা হয়েছে, তাতে দার্জিলিং সাধারণ বাঙালির কাছে পাশের বাড়ি হিসেবে গড়ে উঠেছিল। যদিও সত্যজিৎ টয় ট্রেনকে গুরুত্ব দেননি। সারা সিনেমায় শুধু ট্রেনের হুইসেলের আওয়াজ শুনিয়েছিলেন।
বাঙালি মধ্য বা নিম্ন মধ্যবিত্ত কেরানির জীবন কাটালেও ভ্রমণের বেলায় দার্জিলিং যাওয়ার ক্ষেত্রে লোটাকম্বল নিয়ে একনম্বর পর্যটক। এহং বাঙালিয়ানা টয় ট্রেনে। যদিও বর্তমানে পাহাড়ে নিয়মিত ধসের কারণে টয় ট্রেন এখন অনেকটাই অনিয়মিত। তা সত্ত্বেও পৃথিবীর অন্যতম উঁচু স্টেশন ঘুম পর্যন্ত মোটামুটি ভাবে দার্জিলিং স্টেশন থেকে জয়রাইড হয় এখনও।
কবি আবুল হোসেন ১৯৪১ সালে টয় ট্রেনে দার্জিলিং ভ্রমণ করে এসে একটি কবিতা লেখেন 'ডি এইচ রেলওয়ে' শিরোনামে। মানে, দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে। এই কবিতাটি বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকায় প্রথম ছাপা হয়। টয় ট্রেনে চড়ে দার্জিলিং যাওয়ার কবির অনুভব।
দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়েকে এই স্মৃতিমেদুর ঐতিহ্যের কারণেই ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে গণ্য করেছে। টয়ট্রেন আমাদের অভিজ্ঞান। তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদেরই।
(লেখক শিলিগুড়ির বিধাননগর সন্তোষিণী বিদ্যাচক্র হাইস্কুলের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy