সাদাফ জাফরের নিজের আত্মপরিচয় নিয়েই ধন্দ লেগে গিয়েছিল। তিনি অভিনয় করেন, থিয়েটার বা ওয়েব সিরিজ়ের দৌলতে যথেষ্ট পরিচিত মুখ, অথচ লখনউয়ে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশ পুলিশ তাঁকে গ্রেফতারের পর যে ভাবে মারধর করে, ‘পাকিস্তানি’ বলে গাল পাড়ে, তাতে তাঁর মনে হচ্ছিল ‘‘আমি যেন হিটলারের জার্মানিতে এক জন ইহুদি। কেন আমার সঙ্গে এমন আচরণ করা হল? আমি মুসলিম। বারবার ‘তুম লোগ’ শব্দটাই শুনেছি।’’ (আবাপ, ১৭-১) সাদাফ গ্রেফতার হয়েছেন শুনে থানায় যান সমাজকর্মী দীপক কবীর, তাঁকে ‘কমিউনিস্ট’ ‘শহুরে নকশাল’ বলে হাত-পা চেপে ধরে পুলিশ, তার পর নির্দেশ আসে ‘‘এমন পেটাও যেন হাত-পা-মুখ দু’ইঞ্চি ফুলে যায়।’’
গত জানুয়ারিতে দিল্লিতে গণ-আদালত বসিয়েছিল কয়েকটি নাগরিক সংগঠন। জুরি-র আসনে ছিলেন এ পি শাহ, সুদর্শন রেড্ডি-র মতো প্রাক্তন বিচারপতিরা। দিনভর চলেছিল উত্তরপ্রদেশের পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে নানা অভিজ্ঞতার বিচার। হর্ষ মন্দার বা নিবেদিতা মেননদের তুলে আনা ছবি-ভিডিয়ো দেখে বিচারকরা রায় দেন— ‘হিংসা চালাচ্ছে যোগীর পুলিশই’।
সম্প্রতি দেখা গেল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে পুলিশের প্রশংসা আর ধরে না। এ দিকে দিল্লি পুলিশের যে রূপ দেখে ফেলেছেন সাধারণ মানুষ— তাতে বাইরের দুষ্কৃতীদের খোঁজার আর দরকার নেই, আমাদের রক্ষকরাই আজ ভয়ঙ্কর ভক্ষকে পরিণত। জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, জেএনইউ থেকে সাম্প্রতিক কালের মুসলিম-নিধন যজ্ঞ, পুলিশি ‘সক্রিয়তা’ এখন ভয়াবহ।
বর্তমান আমলে এই আইন-বহির্ভূত শাসন যদিও অভূতপূর্ব আকার নিয়েছে, মূল ব্যাপারটাকে অবশ্য নতুন কিছু বলা যাবে না। পুলিশ ও প্রশাসনকে এই ভাবে আইন থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছে আমাদের দেশ গত সত্তর বছর ধরেই। দেখেছে সেই আইন-বহির্ভূত শাসনকে নানা ভাবে গৌরবান্বিত করতেও। এই গৌরবায়নের কাজে বিরাট ভূমিকা নিয়েছে ভারতীয় চলচ্চিত্র, বিশেষ করে বলিউড।
মনে করা যেতে পারে, ১৯৭৫-এর ২৫ জুন মধ্যরাতে যখন ভারতের ‘নিরাপত্তা, স্থায়িত্ব, সংহতি ও ঐক্য অটুট রাখা’র জন্য জরুরিকালীন ব্যবস্থা ঘোিষত হয়, পুলিশ-প্রশাসনের হাতে ‘বিশেষ’ কিছু ‘ক্ষমতা’ তুলে দেওয়া হয়, তার পর ১৫ অগস্ট স্বাধীনতা দিবসে মুক্তি পায় ‘শোলে’। সেখানে ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন সঞ্জীবকুমার— ছবির পুলিশ অফিসার ঠাকুর বলদেব সিংহ। ছবির আসল নায়ক তো তিনিই (যিনি রোজগারের জন্যে নয়, দেশসেবার জন্যেই পুলিশে যোগ দিয়েছিলেন), তাঁর পরিকল্পনা মতোই গোটা ছবির ঘটনাগুলি ঘটতে থাকে। জেল-ভেঙে-পালানো হিংস্র ডাকাত আমজাদ খান একের পর এক সঞ্জীবকুমারের পরিবারের প্রায় প্রত্যেককে হত্যা করেন, নৃশংস অত্যাচার করতে থাকেন গ্রামবাসীদের উপর। এবং সঞ্জীবকুমার আর আইনের পথে না হেঁটে পাল্টা ভায়োলেন্স তৈরির জন্যে নিয়ে আসেন জেলফেরত দুই আসামি ধর্মেন্দ্র আর অমিতাভ বচ্চনকে, লোহা দিয়ে লোহা কাটার যুক্তিতে। তাঁর যুক্তি ছিল: ‘‘ওয়হ্ বদমাশ হ্যায় লেকিন বাহাদুর হ্যায়।’’ ছবির শেষে আমজাদকে যখন আক্রমণ করেন সঞ্জীবকুমার, তাঁর প্রতিহিংসাপরায়ণ চেহারাটা আমজাদের নৃশংসতার মতোই ভয়ঙ্কর। পুলিশের এই হিংস্রতা দেখা গিয়েছে ‘শোলে’রও আগে ‘জঞ্জির’ সিনেমায়। সেই সত্তর দশকেই। পুলিশ অফিসার অমিতাভ বচ্চন শত্রুকে শায়েস্তা করতে আইনের বাইরে বেরিয়ে তুমুল ভায়োলেন্সে মেতে ওঠেন। ‘শোলে’র মতোই বদমাশ অথচ বাহাদুর চরিত্র প্রাণ-কে সঙ্গী করে নেন।
ভারতের জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমা, দক্ষিণী সিনেমা দীর্ঘকাল ধরে এ ভাবেই আইন-বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংবিধান-বহির্ভূত ভাবে দমন-পীড়ন-নিধনকে রীতিমতো স্বাভাবিক করে তুলেছে। জনমানসে শিকড় গেঁথে দিতে পেরেছে বলেই তো এ-সমস্ত ছবির এত জনপ্রিয়তা। স্বাভাবিক নিয়মেই বাণিজ্যমুখী সিনেমা যে জনপ্রিয় সংস্কৃতির জন্ম দেয় প্রতিনিয়ত, সেখানে নির্দিষ্ট কোনও রাজনৈতিক মনোভঙ্গি প্রকট হয়ে ফোটে না যদিও, প্রচ্ছন্নই থাকে বরং, কিন্তু গোটা ব্যাপারটাকেই অর্থাৎ এই রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদকে একটা সাংস্কৃতিক-সামাজিক রূপের আদলে এনে ফেলার চেষ্টা চলে। ফলে এ-ধরনের সিনেমা যে ধরনের তথ্য সাজায়, দৃশ্য সাজায়, তাই আমাদের চোখে প্রমাণ-মাপে মানানসই হয়ে ওঠে। সেখানে জাতীয় রাজনীতির বিরোধীপক্ষ আস্তে আস্তে দেশদ্রোহী সমাজবিরোধী হয়ে ওঠে, আমাদের আর খেয়ালই থাকে না যে কখন আমরা এই সরলীকরণের চাতুর্যে মজে গিয়েছি।
সত্তর থেকে নব্বই, গত শতকের শেষ তিনটি দশক ধরে জনপ্রিয় ছবিতে বারবার একা বীরের মতো কোনও ‘ভাল’ পুলিশ অফিসার ঘুরেফিরে আসতে থাকেন, যিনি আইনি মারপ্যাঁচের তোয়াক্কা না করে প্রচণ্ড ভায়োলেন্সে কাবু করে ফেলেন ‘ভিলেন’দের। দুর্বৃত্ত-দুষ্কৃতী থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত অসৎ রাজনীতিক, সমাজবিরোধী থেকে দেশদ্রোহী— মোদ্দা কথা, যাঁরা অসাধু উপায়ে নষ্ট করে দিচ্ছেন এ-দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, তাঁদের জব্দ করার জন্যেই অর্জুনের মতো এই লড়াকু পুলিশ অফিসারদের আবির্ভাব। রাষ্ট্রের প্রতিনিধি এঁরা, এই দেশ আর তার গণতন্ত্র রক্ষার দায় কাঁধে নিয়েছেন বলেই সংবিধানে বর্ণিত ব্যক্তির মানবাধিকার কিংবা বিচার-ব্যবস্থার রীতিনীতির প্রতি তাঁদের থোড়াই কেয়ার! সত্তর দশকের ছবিগুলিতে তবু তাঁরা পুলিশের পোশাক বা উর্দিটুর্দি খুলে নিধনযজ্ঞে যেতেন, কিন্তু নব্বই দশকের ছবিগুলিতে ভিলেন নিধনের সময় ডিউটির পোশাক বা বন্দুক ব্যবহারে এতটুকু দ্বিধা করতেন না। আগেকার ছবিগুলিতে আইনের পথে হাঁটছেন না বলে পোশাক বা বন্দুক ব্যবহারে তাঁরা সতর্ক থাকতেন, কিন্তু এখন আইন ভাঙাটাই তাঁদের নৈতিকতার প্রকাশ।
‘মিশন কাশ্মীর’-এ কাশ্মীরের ইনস্পেকটর জেনারেল সঞ্জয় দত্ত কাশ্মীরি জঙ্গিদের হাতে তাঁর স্ত্রী নিহত হওয়ার পর জেলে ঢুকে ধরা-পড়া তিন আততায়ীর মধ্যে দু’জনকে প্রথমেই মাথায় গুলি করে মেরে ফেলেন, তৃতীয় জনের মাথায় বন্দুক ঠেকাতেই হাতেনাতে ফল, প্রকৃত সত্য বেরিয়ে পড়ে। ‘ভাল’ পুলিশ অফিসারের এই ভায়োলেন্সকে সমর্থন জানানো ছাড়া আমাদের আর উপায় কী! এমন পুলিশ অফিসারের আরও উদাহরণ ‘যশোবন্ত’-এর নানা পটেকর বা ‘কুরুক্ষেত্র’-র সঞ্জয় দত্ত। দ্বিতীয় ছবিতে সঞ্জয়ের সার্ভিস রিভলভারের গুলিতে খুন হয়ে যান রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, উপ-মুখ্যমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর ছেলে। ‘শূল’-এ আদর্শবাদী পুলিশ অফিসার সমরপ্রতাপ সিংহের চরিত্রে মনোজ বাজপেয়ী অন্যায় ভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়ে জেল খাটার পর এক দিন থানায় ঢুকে, ডিউটির পোশাক পরে, হাতে বন্দুক নিয়ে প্রথমেই দুর্নীতিগ্রস্ত (মুসলমান) সহকর্মী আনোয়ারকে গুলি করেন। তার পর মূল ভিলেন বিহারের (পিছনের বর্গের হিন্দু) যাদব এমএলএ-কে গুলি করেন বিধানসভায় ঢুকে। গুলি করার আগে ও পরে বিধানসভায় এক নাতিদীর্ঘ বক্তৃতায় সমরপ্রতাপ বলেন— এ ধরনের রাজনীতিক-ই সংবিধানকে অপবিত্র করছে। তাঁর এ ভাবে হিংস্র হয়ে ওঠার পিছনে থাকে তাঁর রাজপুত রক্ত, সৎ দেশপ্রেমিক গর্বিত হিন্দুর রক্ত। আর যে সহকর্মী তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি পুলিশ অফিসার তো বটেই, উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণও।
নতুন শতকের প্রথম দু’টি দশকেও একই চালচিত্র। কখনও ‘অব তক ছাপ্পান’-এর সাধু আগাসে, কখনও-বা ‘সিংহম’-এর বাজিরাও সিংহম: এনকাউন্টারে দেশদ্রোহী ‘খতম’ করায় এই পুলিশ অফিসারদের জুড়ি মেলা ভার! ক্রমশ ব্যক্তি-পুলিশকর্মীর এই জেহাদ ব্যক্তি-নাগরিকেরও জেহাদ হয়ে দাঁড়াচ্ছে জনপ্রিয় ছবিতে। এত কালের পুলিশি সন্ত্রাস শিকড় ছড়াচ্ছে আপনার-আমার মধ্যেও, ‘আ ওয়েনেসডে!’ ছবিটার কথা এক বার ভাবুন। সেখানে নাম ধরে ধরে মুসলমান সন্ত্রাসবাদীদের বোমা মেরে বা গুলি করে উড়িয়ে দেওয়া হয়, মূল মন্ত্রণাদাতা চরিত্র এক সাধারণ নাগরিক— নাসিরুদ্দিন শাহ। তাঁর তৈরি এই ‘ভায়োলেন্স’কে পুলিশ কমিশনার অনুপম খের শুধু নীরব সমর্থনই জোগান-না, নামও গোপন রাখেন তাঁর, তাঁকে ‘সেকুলার’ প্রমাণ করার তাগিদে। গণতন্ত্র যখন বিপন্ন, তখন এই প্রতিশোধস্পৃহাই আমাদের সম্বল, আত্মরক্ষার উপায়ও বটে— এমনই এক মিথ্যের উপর দাঁড়িয়ে পুলিশ-প্রশাসন ‘বিশেষ ক্ষমতা’র প্রতিভূ হয়ে ওঠে, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ‘যুক্তিযুক্ত’ হয়ে যায়, সংবিধানকে নস্যাৎ করে বন্দুক-ই শেষ কথা বলে।
অনেক দিন ধরে আমাদের দেখানো এবং শেখানো হয়েছে যে, হিংস্রতাও এক রকমের ন্যায়বিচার! পুলিশের গুলি কোনও সমস্যাই নয়, সমস্যার সমাধানমাত্র!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy