Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Suchitra Sen

পুরুষরা ঠিক যে নারীকে চায়

সাত পাকে বাঁধা-য় অর্চনা ওরফে সুচিত্রা সেনের এই সংলাপ শুধু তো পিসিমাকে নিশ্চিন্ত করার সংলাপ নয়, গৃহস্থ বাঙালি পুরুষকে নিশ্চিন্ত করার সংলাপ।

শিলাদিত্য সেন
শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২০ ০০:৩৪
Share: Save:

অর্চনা সেই সন্ধ্যায় বাপের বাড়ি থেকে ফেরার পথে সুখেন্দুকে বলেছিল, ‘পিসিমা ঠিকই বলেন, রাগলে তুমি অন্য মানুষ।’ পিসিমা অর্চনাকে আলাদা ভাবে বুঝিয়েও ছিলেন বারে বারে: ‘সুখেন রাগলে আমার বড় ভয় করে, বউমা রাগটা বাসি হতে দিও না মা।... সংসারের নিয়ম, এক জন রাগ করলে আর এক জনকে ঠান্ডা হতে হয়।’ উত্তরে অর্চনা আশ্বস্ত করে বলেছিল: ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।’

সাত পাকে বাঁধা-য় অর্চনা ওরফে সুচিত্রা সেনের এই সংলাপ শুধু তো পিসিমাকে নিশ্চিন্ত করার সংলাপ নয়, গৃহস্থ বাঙালি পুরুষকে নিশ্চিন্ত করার সংলাপ। গোটা ছবিতে পিসিমা কখনও সুখেন্দুকে তার রাগ সংবরণ করতে বলেন না। সারা জীবনে যত চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুচিত্রা, প্রায় অধিকাংশ চরিত্রেই তিনি এ রকমই পুরুষের কাঙ্ক্ষিত নারীপ্রতিমা-র খোপে আঁটা, বার বার বাঙালির পরিবার-প্রথাকে ভারাডুবির হাত থেকে বাঁচিয়েছেন, চিরকেলে সংস্কার-মূল্যবোধগুলিকে বজায় রেখে সমাজ-সংসারের নিয়ম মেনে চলা মানুষজনকে রীতিমতো ভরসা জুগিয়েছেন। বিশেষত তিনি বিপন্ন বাঙালি পুরুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, তার কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে লাগাতার লড়াই করে গিয়েছেন।

ব্যতিক্রমী চরিত্র কি করেননি সুচিত্রা, নিশ্চয়ই করেছেন। ওই সাত পাকে বাঁধা-তেই তাঁর চরিত্রটি কত অন্য রকম। অর্চনা সেখানে সুখেন্দুর অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করতে এতটুকু পিছপা হয় না, এক রাতে সুখেন্দুর বানিয়ে-তোলা মিলন-মুহূর্তকে তছনছ করে দিতে-দিতে তাকে বলেছিল: ‘কী পেয়েছ আমাকে, মাটির পুতুল?’ আর ছাড়াছাড়ির সময় তো বলেই ছিল: ‘সমস্ত কিছু মানিয়ে চলার দায়িত্ব আমার— তোমার নয়?’ কিন্তু ছবির শেষে সেই অর্চনাই তার বোনের বিয়ের মন্ত্রোচ্চারণ শুনতে শুনতে ফের ফিরে যায় সুখেন্দুর বাড়িতে, নিজে ডিভোর্সি বলেই হয়তো, বা পুরুষসমাজের অতি পছন্দের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ যে বিবাহবন্ধন, তা ভুলতে পারে না বলেই হয়তো। শেষ সংলাপে নিঃসঙ্গ একাকী অর্চনা নিজেই তা স্পষ্ট করে তোলে আরও: ‘সব অভিমান জলাঞ্জলি দিয়ে নিঃশেষে তার হাতে নিজেকে তুলে দেব বলেই ছুটে গিয়েছিলাম... পেলাম না... পরিবর্তে পেলাম সারা জীবনের এই প্রতীক্ষা। সাত পাকের বাঁধনের চেয়ে প্রতীক্ষার এই বাঁধন কম কীসে!’

উনিশশো পঞ্চাশের দশকে একের পর এক ছবিতে, উত্তমের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে যখন খ্যাতির তুঙ্গে পৌঁছে যাচ্ছিলেন সুচিত্রা, সময়টা বড় দ্বিচারী ছিল। এক দিকে মারখাওয়া বাঙালি স্বপ্নদেখা প্রায় ভুলতে বসেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-দুর্ভিক্ষ-দাঙ্গা-দেশভাগ তার জীবন একেবারে ঝাঁঝরা করে ছেড়েছে, অন্য দিকে সেই বাঙালিরই তরুণ প্রজন্ম সদ্য-পাওয়া স্বাধীনতায় আবার নতুন স্বপ্নদেখা শুরু করেছে। বাঙালি পুরুষের তখন এমন এক বিশল্যকরণী দরকার ছিল যা তাকে ফের পৌঁছে দেবে সুখের দোরগোড়ায়, সুচিত্রা হয়ে উঠলেন সেই মানসপ্রতিমা। হয়ে উঠলেন এমনই এক প্রণয়িনী বা পত্নী, যে প্রতি দিন প্রতি মুহূর্তে তাকে খানাখন্দ থেকে টেনে তুলবে, হারানো পারিবারিক বন্ধন বা কাজকর্ম-অর্থ-সম্পত্তি ফিরে পেতে তৎপর করে তুলবে, নীতি-মূল্যবোধের প্রতি সৎ থাকতে বলবে, উচ্চাশা কী করে করতে হয় তা শেখাবে, এক উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখাবে, পাশাপাশি নিজেদের সম্পর্কটাকেও প্রণয় থেকে পরিণয়ে পৌঁছে দেবে, মোদ্দা কথা— এক সুস্থিত প্রতিষ্ঠিত জীবনের দিকে তাকে টেনে নিয়ে যাবে।

অগ্নিপরীক্ষা, শাপমোচন, সবার উপরে, সাগরিকা, হারানো সুর, পথে হল দেরি, জীবনতৃষ্ণা, ইন্দ্রাণী, সূর্যতোরণ, চাওয়া পাওয়া, সপ্তপদী... তালিকা বাড়িয়ে লাভ নেই, সব ছবিতেই উত্তমের চরিত্রগুলি অচল অথবা আধখানা হয়ে পড়ে থাকত, সুচিত্রাভিনীত চরিত্রগুলি যদি পাশে এসে না দাঁড়াত। সুচিত্রার চরিত্রগুলি যত বড়লোক বাড়ির মেয়েই হোক-না-কেন, জীবনযুদ্ধে তারা এক ইঞ্চিও জমি ছাড়তে নারাজ, মাটি কামড়ে পড়ে-থাকা অন্য মেয়েদের মতোই। একই সঙ্গে ‘অন্দর’ আর ‘বাহির’ দুই-ই সামলাচ্ছে, উচিত-কথা বললেও শেষ পর্যন্ত পারিবারিক বা সামাজিক অনুশাসন নষ্ট করছে না, মাতৃস্নেহে কিংবা প্রেমে বুঁদ করে রাখছে... রুপোলি পর্দায় এমন মেয়েকেই তো চেয়েছিল বাঙালি পুরুষ। আর প্রতিটি চরিত্রে তাঁর তেজস্বিনী ব্যক্তিত্ব আরোপ করতেন সুচিত্রা সেন, ফলে একে অসামান্য সুন্দরী তায় অমন ব্যক্তিত্বময়ী, বাঙালি পুরুষের যৌথ স্মৃতিতে ‘যে ছিল আমার স্বপনচারিণী’-র মিথ হয়ে রইলেন সুচিত্রা।

ছ’বছর হল তিনি আমাদের মধ্যে নেই, থাকলে নব্বই-এ পা দিতেন গতকাল। আদতে তিনি আমাদের মধ্যে নেই সেই সত্তর দশকের শেষ থেকে, তখন থেকেই তিনি অন্তরিন, রুপোলি পর্দায় আর তাঁকে দেখা যায়নি। এর জন্যেও দায়ী বাঙালি পুরুষরা, সুচিত্রাকে ঘিরে তাদের ‘রোম্যান্টিক অবসেশন’, সুচিত্রার যে বয়স বাড়তে পারে তা তারা মেনে নিতে পারেনি, ‘স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’-র বাইরে আর কিছু তাঁকে ভাবতে পারেনি। এ সবই কি কোনও অভিমানের জন্ম দিয়েছিল সুচিত্রার মনে, তাই কি তিনি নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখলেন আমৃত্যু?

ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

অন্য বিষয়গুলি:

Suchitra Sen Indian Cinema Tollywood
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy