চন্দ্রশেখর আজাদ। —ফাইল চিত্র
দিল্লির তিসহাজারি কোর্টের বিচারক কামিনী লাও কি নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহকে এক মুহূর্তও থমকাইতে পারিলেন? তাঁহার প্রবল ভর্ৎসনা কি দিল্লির পুলিশ-প্রশাসনকে একটুও হুঁশে ফিরাইতে পারিল? বুঝাইতে পারিল কি যে, নাগরিক অধিকারের একেবারে গোড়ার পাঠটিও তাহারা নিয়মিত পদদলিত করিতেছে? বাস্তবিক, যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে বিচারক মহাশয় পুলিশ ও প্রশাসন মহলকে তুলোধোনা করিয়াছেন, তাহাতে অন্য কোনও প্রশাসন হইলে হয়তো গভীর ভাবে বিব্রত বোধ করিত। শাসনবিভাগের নিকট বিচারবিভাগের মতামতের আজও খানিক গুরুত্ব থাকিলে বিচারকের এই ভর্ৎসনায় পুলিশের কর্তা ও তাঁহাদের নেতারা কিছু আলোড়িত হইতেন। কিন্তু, না, সেই সম্ভাবনা দূর অস্ত্। নরেন্দ্র মোদী সরকার ও তাহার পুলিশবাহিনী বিব্রত হইবে বলিয়া মনে হয় না, কেননা তাহারা ‘ভুল’ করে নাই, বরং অত্যন্ত পরিকল্পিত ভাবেই নাগরিকের প্রতি লাগাতার অন্যায় করিয়া চলিতেছে। গত কয়েক মাসের নিরবচ্ছিন্ন নাগরিক অধিকার নিষ্পেষণের পর এ কথা বলিতে কোনও অসুবিধা হইবার কথা নহে। আর তাই, জামা মসজিদের সামনে বিক্ষোভকারী দলিত নেতা চন্দ্রশেখর আজাদ বা রাবণের গ্রেফতার প্রসঙ্গে বিচারক লাও যে গুরুতর প্রশ্ন তুলিয়াছেন— প্রতিবাদ করিলে সমস্যা কোথায়? প্রতিবাদ করা কি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে না?— সেগুলি দ্বিগুণ প্রণিধানযোগ্য। কেননা, এই সরকার স্পষ্টতই মনে করে যে, প্রতিবাদ করা নাগরিক অধিকারের মধ্যে পড়ে না। মনে করে যে, সরকারের মতের বিরুদ্ধতা করার অর্থই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধতা করা। মনে করে যে, যে কোনও প্রতিবাদ কঠিন হাতে দমন করাই প্রশাসনিক ব্রত। দিল্লি পুলিশ ও তাহার নেপথ্যের নির্দেশদাতারা চাহেন, প্রতিবাদকে গুলাইয়া দিয়া দেশবিরোধিতার সহিত মিশাইয়া দিতে। শিখাইতে চাহেন, প্রধানমন্ত্রী মোদী কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে ভারত রাষ্ট্রের সহিত সমার্থক ভাবিতে। বিচারক লাও মোক্ষম জায়গাতেই তির ছুড়িয়াছেন।
চন্দ্রশেখর আজাদ গ্রেফতার হইলেন কেন, বিচারক মহাশয়ের এই প্রশ্নের সামনে দিল্লি পুলিশের আইনজীবী কিন্তু কোনও উপযুক্ত যুক্তি দর্শাইতে পারেন নাই। কেবল বলিয়াছেন, তিনি প্রতিবাদ করিতে লোক জড়ো করিতেছিলেন জামা মসজিদের সামনে। অর্থাৎ প্রতিবাদ আয়োজনই এখানে শাস্তিযোগ্য কাজ। ওই একই যুক্তিতে দিল্লির জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের উপর রক্তাক্ত পুলিশি নির্যাতন ঘটিল। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা রাজধানীর রাজপথে শান্তিপূর্ণ ভাবে মিছিল করিতে গেলে তাহাদের বেধড়ক পিটানো হইল। অর্থাৎ মোদী সরকারের মতে, ‘শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ’ বলিয়া কিছু হয় না, প্রতিবাদ মানেই শাস্তিযোগ্য দ্রোহ। অথচ ভারতীয় রাজনীতিতে প্রতিবাদের ধারা কিন্তু বহু কালের অভ্যাস, বহু দশকের বাস্তব। বিচারক লাও মনে করাইয়া দিয়াছেন যে বর্তমানে যাঁহারা শাসক, তাঁহাদের অধিকাংশ প্রতিবাদ-রাজনীতির মাধ্যমেই খ্যাত হইয়াছেন, ক্ষমতার অধিকারী হইয়াছেন। কেবল স্বাধীন দেশে নহে, পরাধীন দেশেও প্রতিবাদ-আন্দোলনের ধারাটি বেশ গৌরবজনকই ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘নষ্টনীড়’ কাহিনিতে ভূপতির মুখে তফাতটি স্পষ্ট করিয়া দিয়াছিলেন— প্রতিবাদ মানেই দেশদ্রোহ বা ‘সিডিশন’ নহে। বাস্তবিক, আজিকার বিজেপি শাসকদের তুলনায় ঔপনিবেশিক শাসকদেরও অধিকতর সহিষ্ণু বলা যায়— ইতিমধ্যেই ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব এমন একটি মন্তব্য করিয়াছেন তবে কিনা, ভারতীয় রাজনীতির এই দীর্ঘ সাংবিধানিক প্রতিবাদ-ঐতিহ্যের মধ্যেই লুকাইয়া ভরসার কথাটি। প্রতিবাদের উপর দমনপীড়ন প্রতিবাদীদের না দমাইয়া হয়তো আরও উদ্দীপিত করিয়া তুলিবে। যেমন এই মুহূর্তে করিতেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy