শীতের আবহাওয়ায় সেদিন হঠাৎ-ই উষ্ণতার আধিক্য। শীত চলে যাচ্ছে ভেবে আমরা অনেকেই খুশি হচ্ছিলাম। কিন্তু শীতপ্রিয় এক বন্ধু গায়ের সোয়েটার-মাফলার খুলতে খুলতে দুম করে প্যারডি করে বসল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের একটি গানের লাইন কয়েক। গাইলও সুর দিয়ে, ‘শীতের কথা বোলো না আর / বুঝেছি শীত কেবল ফাঁকি / গরমে আছি আছি ভাল/ গরমেই আমি ভাল থাকি।’
কথা হল, শীতবিলাসীদের কাছে শীত ফাঁকি হতেই পারে, কিন্তু সাধারণ ভাবে শীতকে কি সত্যি ফাঁকি বলা যাবে আর? দেরিতে এসে দেরিতে যাওয়া শীত মোটামুটি একটা নিয়ম করে ফেলেছে। আর এবার তো শীত একেবারে দেরিতে এসেছিল তা-ও নয়। বলা যায় বেশ বড়সড় ইনিংসই খেলল শীত এ মরসুমে।
বিশ্ব উষ্ণায়নের দোহাই পেড়ে, ‘সেরকম শীত আর এখন পড়ে না’ এ হা-হুতাশেরও জায়গা কই? পারদ এবার নেমেছিল যথেষ্টই। স্বাভাবিকের নীচে ছিল বেশ কয়েকটা দিন। আসলে শীতবিলাসীদের শীত নিয়ে প্রত্যাশাটা খুব বেশি। কিন্তু বাস করব গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে, আশা করব পাহাড়ের শীত, তা কি হয়? আর ‘সেরকম শীত’ বলতে ঠিক কতদিন আগের স্মৃতি হাতড়াতে চান শীতবিলাসীরা?
ঈশ্বরগুপ্তের ছড়ায় হিমঋতুর কথা আছে। আছে জলে দাঁত ওঠার (‘জলের উঠেছে দাঁত কার সাধ্য দেয় হাত’) অনুভবও। কিন্তু গিজার বা জল গরম অন্য কোনও ব্যবস্থা একদিন না থাকলে, স্নান করার সময় এ অনুভব এখনও কি বিলক্ষণ টের পাওয়া যায় না শীতকালে!
‘সেই শীত’ মিথ হয়ে রয়েছে যতটা না শীতের তীব্রতার কারণে, তার চেয়ে বেশি সম্ভবত শীত নিবারক পোশাক বা যন্ত্র না থাকার জন্য। আগে শীতবস্ত্র মানে বেশির ভাগই ক্ষেত্রেই তো কেবল একটা চাদর। অনেক ক্ষেত্রে আবার তাও নয়। মূলত ‘জানু ভানু কৃশানু’র আশ্রয়েই খুঁজতে হত ‘শীতের পরিত্রাণ’। এত জ্যাকেট সোয়েটার কবে ছিল গাঁ-গেরামে! আর তাপমাত্রা? কম দিন শীতকে তো দেখা হল না ধরাতলে! ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে তাপমাত্রা আগেও মেরেকেটে পাঁচ-ছয় দিনই নামত। আর তাতেই হু হু করতে হত পর্যাপ্ত শীতবস্ত্রের অভাবে। তাপমাত্রা ১০ বা ১০+ এ থাকলেও ওই একই কারণে আরামে থাকা যেত না খুব।
এখন যে ক’দিন শীত থাকে, সে ক’দিনের অভিজ্ঞতা একেক জনের কাছে একেক রকম। যেখানে শীত উপভোগের ঋতু সেখানে শীতের আদর স্বাভাবিক ভাবেই বেশি। তাকে আরও কিছুদিন পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও সেখানে প্রবল। কিন্তু যেখানে শীতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শীত-মোকাবিলার নানা গল্প সেখানে এই ঋতুর সমাদর সে রকম হবার কথা নয়। হয়ও না। ‘শীতটা গেলে বাঁচি’ এমন আর্তি সেখানে কান পাতলেই শোনা যায়।
সুখের গল্প সব ক্ষেত্রেই এক, কিন্তু যন্ত্রণার গল্প প্রতিটা ক্ষেত্রেই আলাদা। অনেকটা ঠিক এরকম একটা কথাই বলে গেছেন লিও টলস্টয়। শীত উপভোগের গল্প তাই থাক। ফেরা যাক, শীত-বিরোধীদের কিসসাতেই।
‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’ ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতার এই লাইন দিয়েই শুরু করা যাক। শীতপ্রেমীদের খুব প্রিয় এই লাইনটা। শীত পড়তে একটু দেরি হলেই তাঁদের মুখে পাক খেয়ে ফেরে এ লাইন। এ কিন্তু আসলে শীত বিরোধীদের কথা। কেননা কবিতাটির প্রথম লাইনের পরেই রয়েছে, ‘আমি তিন মাস ঘুমিয়ে থাকব’ এমন ইচ্ছা। এ কি প্রেম না শীতের আশ্রয়ে শীত থেকেই পলায়ন!
শীত এলে আমরা যাঁরা ঘোরতর শীত-বিরোধী তাঁরাও তো মনে করি এই সময় জীবন নির্বাসনে গেল তিন মাস। সন্ধে থেকে সব জানলা বন্ধ সেই যে নভেম্বরে, পোকাদের অত্যাচার রুখতে, তা একসময় ঠান্ডা রুখতে রয়ে যায় একই ভাবে। এরপর শুধু রাত নয় দিনেও আর খোলার সাহস হয় না সেগুলো। তারপর যা হয়। জানলা দিয়ে আকাশ, আকাশের গায়ে পাখিদের আঁকিবুকি দেখা হয় না কত কত দিন! রাস্তার ফেরিওয়ালা হেঁকে হেঁকে ফিরে যায়। বন্ধ জানলা টপকে ভিতরে আসে না তাঁর বয়ে নিয়ে যাওয়া সামগ্রীর আওয়াজ। পুরোনো খবরের কাগজও ডাঁই হতে থাকে। জানলা বন্ধের কারণে, কাগজ কেনার লোকের আর নাগাল পাওয়া যায় না।
এই এক বন্ধ জানলার কারণে ঘরটাও কেমন যেন ছোট হয়ে যায়। সমতল বিছানা লেপ-কম্বল-ব্ল্যাঙ্কেটে একেবারে মালভূমি হয়ে থাকে দিনের পর দিন। লেখাপড়া সব শিকেয় ওঠে। সব সময়েই মনে হয় বসে থাকি লেপ চাদর জড়িয়ে।
গাঁ-গেরামে সাতটা হতে না হতেই রাত্রি নামে ঘন হয়ে। মনের উপরেও সে রাত চেপে বসে পেপার-ওয়েটের মতো। স্নান সহ অন্য প্রাকৃতিক কাজ সারা এমনিতেই এ সময় কঠিন, তার উপর যদি কোনও গোলযোগে রাতের দিকে বড়-বাথরুম দু’একবার যেতে হয়, তবে তা সামলানো রীতিমত দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। রেডিয়োতে প্রভাতী অনুষ্ঠান শোনা বা মর্নিং ওয়াকের অভ্যেস থাকলে, সে সব অভ্যেস রাখাও কঠিন হয়ে যায় মাঝে মাঝে।
আর দিনের বেলার কথা তো কহতব্য নয়। অফিসকাছারি না থাকলে দিনটা যেন শুরুই হয় দুপুরে। লেপ কম্বল ছেড়ে একটু রোদের আশায় বারান্দায় বসারও জো নেই বয়স্কদের। রোদ নিতে গেলে তো সে রীতিমতো মশকরা শুরু করে দেয়। দু’মিনিট গা লাগিয়ে বসতে না বসতেই সে জায়গা পরিবর্তন করে। তারপর হঠাৎই একসময় বারান্দাটাকে নিঝুম ছায়ার অধীনে সঁপে দিয়ে সে গটগট করে নেমে যায় রাস্তায়।
যাঁরা কায়িক শ্রম করেন এবং সে কারণে বেরোতে হয় ভোর ভোর, তাঁদের দুঃখের বারমাস্যায় শীতের জন্য বরাদ্দ একটা বড় অনুচ্ছেদ। এবং সে অনুচ্ছেদের কালিও একেক জনের একেক রকম।
শীতের কিছু নিজস্ব ব্যাধি আছে, আর কিছু ব্যাধি সে উপহার দেয়, তার খাদ্য আর লেপ-কম্বলের ওমের মাধ্যমে। চর্মরোগ, পেটের রোগ, মনোরোগ সর্বোপরি হৃদরোগের আক্রমণ এ সময় শোনা যায় খুব। শুধু কী তাই! বার্ধক্যজনিত রোগে পীড়িত কোনও মানুষ সম্পর্কে কাছের মানুষেরা শীত শুরুর আগে অনেকসময় নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করতে থাকেন, ‘এই শীত টিকলে হয়।’ শীত তাই শুধু রোগের ঋতু নয়,প্রাণ হন্তারক ঋতুও বটে।
এই ঋতুতে যাপন মানে মনে-মনে নির্বাসনে যাওয়ারই সামিল। আমরা যাঁরা গ্রীষ্মের অলস মধ্যাহ্নে অক্ষয় কুমার বড়ালের ‘একেলা জগৎ ভুলে / পড়ে আছি নদীকূলে’ পড়ে গ্রীষ্মপ্রেমিক হয়েছি সেই কিশোরবেলায়, তাঁরা অস্কার ওয়াইল্ডের ‘সেলফিস জায়েন্ট’ পড়ে একই সঙ্গে শীতকে শত্রু ভাবতেও শিখেছি সে সময়। আমাদের পক্ষে, তাই শুধু প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে শীতকে কোনও রকমে সহ্য করে চলা। শীত নিয়ে আদিখ্যেতা? নৈব নৈব চ। দু’তিনটে নিম্নচাপে ভর করে শীত যখন বারে বারে ফিরে আসে, আক্রমণ শানায় নতুন উদ্দীপনায়,তখন পাগলা মেহের আলির মত আমাদেরও বলতে ইচ্ছা হয়, ‘তফাত যাও!’
শিক্ষক, ভগবানগোলা হাইস্কুল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy